শিরোনাম
সগোত্র সঘন আর সঙিন
প্রকাশ : ২১ মে ২০১৭, ০৮:৪৮
সগোত্র সঘন আর সঙিন
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

সগোত্র শব্দের মৌলিক অর্থ ‘এক গোয়ালে গরু রাখা’ (সূত্র: সুকুমার সেনের ভাষার ইতিবৃত্ত)। আভিধানিক অর্থে সগোত্র মানে একবংশজাত, জ্ঞাতি, আত্মীয়, এক মনোধর্মবিশিষ্ট (অমনি নতুন কালের কড়া গন্ধ মেলে ধুলো জেগে উঠল, গাড়ির পেট্রোল-বাষ্পের সঙ্গে তার সগোত্র আত্মীয়তা- পারস্যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আসামি এবং উড়িয়া যদি বাংলার সগোত্র ভাষা না হইত তবে আমাদের এত কথা বলিবার কোনো অধিকার থাকিত না- বাংলা শব্দতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তোমার সগোত্র সখিগণের মধ্যে অনেকেরই গুণ এই দুনিয়াতে জাজ্বল্যমান- দেবী চৌধুরাণী, বঙ্কিমচন্দ্র্র চট্টোপাধ্যায়)।


স্ত্রীলিঙ্গে সগোত্রা। শব্দটির গঠন হচ্ছে সংস্কৃত স (সমান) + গোত্র।


তবে ‘সঘন’ একটা জোড়কলম শব্দ। বাংলা স এবং সংস্কৃত ঘন মিলে সঘন হয়েছে। এটা বিশেষণ বা ক্রিয়া-বিশেষণ হিসেবে বাংলায় ব্যবহৃত হয়। সঘন মানে নিরন্তর, ঘনঘন, বারবার (সঘন সারি দাঁড়ায়ে ঘেঁষে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; বরিষার মেঘে যেন বরিষে সঘন- সরদার জয়েনউদ্দীন; মাঠের পরে মাঠ, মাঠের শেষে সুদূর গ্রামখানি আকাশে মেশে, এ ধারে পুরাতন শ্যামল তালবন সঘন সারি দিয়ে দাঁড়ায় ঘেঁষে- বধূ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সঘন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া, স্তিমিত দশ দিশি, স্তম্ভিত কানন, সব চরাচর আকুল- কি হবে কে জানে, ঘোরা রজনী, দিকললনা ভয়বিভলা- কালমৃগয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; হাতপায়ের নিরন্তর আক্ষেপে, গামছার সঘন সঞ্চালনে কিছুতেই তাদের আক্রমণ প্রতিহত করা যায় না- লালু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; কোথা হতে আচম্বিতে মুহূর্তেকে দিক্ দিগন্তর করি অন্তরাল স্নিগ্ধ কৃষ্ণ ভয়ংকর তোমার সঘন অন্ধকারে রহো ক্ষণকাল- বর্ষশেষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।


আবার পদ্যে ক্রিয়া-বিশেষণ হিসেবে সঘনে মানে মুহূর্মুহু, বারে বারে (দাদুরি ডাকিছে সঘনে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; উৎসঙ্গা প্রদেশে, ধূর্জটির পাদপদ্মে পড়িছে সঘনে অশ্রুবারি- মধুসূধন দত্ত)।


আবার সংস্কৃত সহ ও সংস্কৃত ঘন যোগে গঠিত সঘন শব্দটিও বাংলায় চালু রয়েছে। এ সঘন অর্থ মেঘযুক্ত বা মেঘাবৃত (সঘন মেঘ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।


অন্যদিকে অভিধানে সঙ্গিন, সঙ্গীন, সঙীন, সঙিন বানানগুলো মেনে নেয়া হয়েছে। ফারসি সঙ্গীন শব্দ থেকে আগত বিশেষ্য হিসেবে বাংলা সঙিন শব্দের অর্থ ‘বন্দুকের মুখের ছোরা বা কিরিচ’ (হাতে নিয়ে সঙ্গীন আলো সেনারা হানা দেয় প্রতিদিন- মো. মাহফুজউল্লাহ)। এটা ইংরেজি bayonet শব্দের সমতুল। অন্যদিকে বিশেষণে সঙিন মানে শক্ত, কঠিন, জটিল (ব্যাপারটা কেমন যেন সঙ্গিন হয়ে উঠেছে- মো. ওয়ালিউল্লাহ; কেবল একটিমাত্র শব্দের মধ্যে একটা দুষ্ট অক্ষর নিঃশব্দ পদসঞ্চারে প্রবেশ করিয়াছে, তীক্ষ্ম সঙিন ঘাড়ে করিয়া শিশুদিগকে ভয় দেখাইতেছে, সেটা আর কেহ নয়, গবর্নমেণ্ট শব্দের মূর্ধন্য ণ- বাংলা শব্দতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; শির হ’তে পাঁও তক্ ভাই লাল-লালে-লাল খুন মেখে রণভীতুদের শান্তিবাণী শুনবে কে? পিন্ডারীদের খুনরঙীন নোখভাঙা এই নীল সঙীন তৈয়ার হেয়্ হর্দ্দম ভাই ফাড়্তে যিগর শত্রুদের!- কামালপাশা, কাজী নজরুল ইসলাম; এসব তো সিপাহিদের মতো ছোরা-ছুরি-সঙ্গিন ওচানো সার-বাঁধা পোশাকপরা অক্ষর- লেখা কুমারী ও ছাপা সুন্দরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; অন্বেষণ-ক্ষুব্ধ ভাঙা গড়ার অভিযানে, তীক্ষ্ম অভীপ্সায় সমুদ্যত গারদ ভাঙার সঙ্গিন সময়ে পৃথিবীর আদিম শক্তির মতো তুমি আছ আমাকে দুর্গের মতো দৃঢ় করে রাখে- তোমাকে, রাম বসু; সঙ্গীন উঁচু করিয়া অতি দ্রুতবেগে, পর্বতবিমুক্ত বিশালতটিনীপ্রপাতবৎ দুর্দমনীয় অলঙ্ঘ্য অজেয় ব্রিটিশসেনা, পলায়নপর সন্তানসেনার পশ্চাৎ ধাবিত হইল- আনন্দমঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে, আমি তার সুরকার, তার রক্তে স্বরলিপি লিখি- রিপোর্ট ১৯৭১, আসাদ চৌধুরী), ভয়ানক, গুরুতর (হঠাৎ বেকার হয়ে তার অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠেছে)।


আবার ইংরেজি sanguine থেকে আসা বাংলা সঙিন শব্দটির অর্থ সাংঘাতিক, দারুণ, ঘোরতর, সংকট। ইংরেজিতে প্রাচীন প্রয়োগ হিসেবে sanguinary শব্দের অর্থ ছিল রক্তাক্ত, রক্তপাতবহুল, রক্তক্ষয়ী (a sanguinary battle)।


বর্তমানে sanguine অর্থ আশাবাদী। তবে রক্তিম অর্থেও শব্দটির প্রয়োগ রয়েছে।


● লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com