শিরোনাম
বাংলা ‘সই’ থেকে ‘সক্কর’
প্রকাশ : ১৯ মে ২০১৭, ০৯:১৯
বাংলা ‘সই’ থেকে ‘সক্কর’
জিয়াউদ্দিন সাইমুম
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা সই শব্দটির মূল সংস্কৃত ‘সখী’। শব্দটির বিবর্তন এ রকম: সংস্কৃত সখী > প্রাকৃত > সহী > সই।


সই অর্থ সঙ্গী, সঙ্গিনী, বয়স্যা (তোরা কেনে সখি! বলিস রাধার জয়, তোরা বলগো সই! শ্যামচাঁদের জয়- দাশরথি রায়; শরমে সরমা সই মরিলা- মধুসূধন দত্ত; ওলো সই ওলো সই, আমার ইচ্ছা করে তোদের মত মনের কথা কই; একী সই গোসা কেন; পাড়ার সই সাঙাতিদের সঙ্গে মিলিবার জন্যই তখন আমার মন ছুটিত- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সই ভালো করে বিনোদন বেনী বাঁধিয়া দে- কাজী নজরুল ইসলাম; সই, কেমনে ধরিব হিয়া আমার বধুয়া আন বাড়ি যায় আমার আঙিনা দিয়া- চণ্ডীদাস; মাছ ধরে সে বড়শী আমার বুকে এসে বেঁধে, ওলো সই বুকে এসে বেঁধে- কাজী নজরুল ইসলাম; কি বলিব সই- সই মনের কথা সই, সই মনের কথা সই- কাণে কাণে কি কথাটি বলে দিলি ওই- মৃণালিনী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। উল্লেখ্য, সংস্কৃত কর্ণ থেকে আসার কারণে এক সময় ‘কান’ শব্দের বানান ছিল ‘কাণ’। একই কায়দায় সংস্কৃত স্বর্ণ থেকে আসার কারণে সোনা শব্দের বানান ছিল ‘সোণা’। যেমন করে বানান শব্দের বানান ছিল ‘বাণান’।


আবার আরবি ‘সহীহ্’ থেকে বাংলায় যে সই শব্দটি এসেছে, তার অর্থ স্বাক্ষর, দস্তখত। তবে শব্দটি সরাসরি বাংলায় আসেনি, হিন্দি ভাষার পাসপোর্ট নিয়ে বাংলায় ঢুকেছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস শব্দটির বিবর্তন দেখিয়েছেন এভাবে: আরবি সহীহ্ > হিন্দি সহী > বাংলা সই (দাঁ মহাশয় বাঙ্লা ও ইংরাজি নাম সই কত্তে পারেন- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ; ভৈরবীর আসন ত্যাগ করে যে আপনি ইতিমধ্যে ছাড়পত্র পর্যন্ত সই করে রেখেছেন, এ খবর ত আমাকে ঘুণাগ্রে জানান নি?- ষোড়শী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।


আর টিপসই অর্থ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের মাথার ছাপ।


আবার আরবি সহীহ্ অর্থ সমান আর বাংলা সই অর্থ উপযোগী, অনুরূপ মত। যেমন মাপসই। আবার এই সই শব্দটি প্রমাণ ও পর্যন্ত অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন মাথাসই, হাতসই জল (খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে এই ‘কাছের বাড়ি বলরাম’ বলে গোস্বামীকে রুলসই কত্তে লাগলেন; সখের সংকীর্তন ওয়ালারা গোছসই বারান্দার নীচে, চৌমাথায় ও চকের কামনে থেমে থেমে গান করে যাচ্চেন- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ; তেমন যুৎসই নয়- আবু রুশদ; তোমার মাফিকসই জিনিষ এনেছিলেন- কেদারনাথ মজুমদার)।


সংস্কৃত ‘শায়ী’ থেকেও বাংলায় সই এসেছে। এই সই অর্থ শায়িত, মধ্যগত, মধ্যে নিক্ষিপ্ত (তাকে জল সই করে দিলে)।


সংস্কৃত সহ থেকেও বাংলায় সই শব্দটি এসেছে। এ সই ক্রিয়া পদ। এটার অর্থ সহ্য করি (এতো জ্বালা সই কি করে?)।


এদিকে সক্কর বা শাকর প্রাকৃত বাংলা। সংস্কৃত শর্করা থেকে বাংলায় সক্কর শব্দটি এসেছে। আরবি সুকর থেকেও বাংলায় সক্কর শব্দটি আসতে পারে। বাংলা একাডেমির অভিধানে এটাই বলা হয়েছে। সক্কর মানে চিনি (যেন মিষ্ট ফল ইক্ষু সক্কর চাবায়- সৈয়দ আলাওল)।


রোমানরা চিনিকে মিষ্টি লবণ বা ভারতীয় লবণ বলতো। ভারতীয় উপমহাদেশ হতে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে সক্কর (আখ থেকে তৈরি চিনি) পৃথিবীর নানা প্রান্তে রফতানি হতো।


প্রাচীন বাংলায় সক্কর ‘শুক্রা’নামেও পরিচিত ছিল (ঘৃতে ভাজি শুক্রাতে ফেলহ ফুলবড়ি- কবিকঙ্কণ চণ্ডী)।


আবার প্রাকৃত বাংলায় সক্করকে শাকর বলা হতো (সুমধুর মধুর লীলা হইব তোমার, শাকর হতে তুমি কাঁকর আকর- গিরিধর)।


উল্লেখ্য, ফারসিতে চিনি শাকর বা শক্কর, আরবিতে সক্কর বা আসক্কর, লাতিনে স্যাকরম (saccharum), ডাচে সুকার (sukker), স্পেনিশ ও পর্তুগিজে আজক্কর (ajucar), ফ্রেঞ্চে সক্রু (sucre), সুইডিশে সুকার (socker), রুশে সেকার (sachar), ইতালিতে জাক্কেরো (zacchero), জার্মানে জাক্কার (zucker), ইংরেজিতে সুগার (sugar) নামে পরিচিত।


● লেখাটি লেখকের ব্লগ থেকে নেয়া


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com