শিরোনাম
‘অশ্রুজল’ বিদায় করা যাবে না
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ০৮:৫৪
‘অশ্রুজল’ বিদায় করা যাবে না
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

অশ্রু বেদে ব্যবহৃত শব্দ। এটার মূলানুগ অর্থ ‘যা ব্যাপ্ত করে’। ফারসিতে অশক্, আবেস্তায় asru, গ্রিকে oakru, জার্মানে zahre। মধ্যযুগের বাংলায় অশ্রুর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘অঝুর’ ও ‘অঝোর’ শব্দ দুটি ব্যবহৃত হতো। যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর অভিধানে লিখেছেন ‘কৃত্তিবাস, চণ্ডীদাস প্রভৃতি প্রাচীন কবির প্রিয় শব্দ অঝরু ও অঝোর। তাঁদের কাব্যে ‘অঝরু ঝরয়ে আঁখি’, ‘অঝোর নয়’ ইত্যাদি প্রয়োগ পাওয়া যায়।’


চৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে ‘অঝোর নয়নে সবে করেন ক্রন্দন’। আর মাণিকগাঙ্গুলীর ধর্মমঙ্গলে রয়েছে ‘সুরগণ সকলের অঝোর নয়’।


আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও অশ্রু অতি পরিচিত শব্দ (তব অঙ্গনে প্রতি ঘাসে ঘাসে অশ্রু আমার বল- সিকান্দার আবু জাফর; নিখিল ব্যথিত উম্মত লাগি এখনো তোমার অশ্রু ঝরে- ইসমাইল হোসেন শিরাজী; এই যে এক বিন্দু অশ্রুর খবর তা ঊষাবালা নিজেই জানে না; পাষাণ টুটিয়া গলিয়া পড়িবে অশ্রুর জাহ্নবী; আমার অশ্রু লাগিবে না সখি তার চেয়ে বেশি লোনা- কাজী নজরুল ইসলাম; অশ্রুর প্রথম পলাশটা সবেগে বর্ষণ হইয়া গেল; অঝরে ঝরিল অশ্রু নিষ্পন্দ নয়নে; কত কষ্টে করেছিনু অশ্রুবারি রোধ; পড়ুক দু’ ফোঁটা অশ্রু জগতের পরে, যেন দুটি বাল্মিকীর শ্লোক- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।


কালিদাস রায় অশ্রু অর্থে ‘যমুনা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন (বিষ্ণুপ্রিয়ার হৃদয় গলিয়া যমুনা ঝরিয়া পড়ে, শচীনজননীর আঁধুয়া নয়নে সুরধুনী ধারা ঝরে)। আবার অশকবার মানে কান্নাসজল, অশ্রুসজল, কান্নাপেলব। ফারসিতে অশ্রু অর্থে ‘আবগীনা’ শব্দটিরও ব্যবহার রয়েছে। হিন্দিতে অশ্রুর সমতুল শব্দ ‘আঁসূ’।


মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলা একাডেমির অভিধানেও বলা হয়েছে ‘অশ্রুজল’ শব্দটি অশুদ্ধ। দাবি করা হয় বিহারীলাল চক্রবর্তী তার ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যে ‘প্রফুল্ল কপোল বহি বহে অশ্রুজল’ লিখেই বাংলা ভাষায় অতি বিতর্কিত শব্দটির জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শব্দটিকে গদ্য পদ্যে এমনভাবে ঠাঁই দিয়েছেন, অনেকে শব্দটার বিরোধিতা করার সাহস পাননি অথবা কবিগুরুর ভুল ধরাটা ঠিক মনে করেননি। পরে শরৎচন্দ্রও শব্দটিকে আপন করে নিয়েছেন (কেবল নিঃশব্দ রোধনে তাহার দুই কপোল বহিয়া অশ্রুজল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল- মেঘ ও রৌদ্র; অশ্রুজলের মালা পড়াইয়া এই সঙ্গীহীন মানুষটিকে সেদিন বিদায় দিতে কেউ ছিল না- শ্রীকান্ত, চতুর্থ পর্ব)।


এখন অশ্রুজল বাংলা ভাষায় গ্রহীত ও প্রতিষ্ঠিত শব্দ (গভীর ধেয়ানে বসিল বাবর শান্ত অচঞ্চল, প্রার্থনারত হাত দুটি তার নয়নে অশ্রুজল- জীবন বিনিময়, গোলাম মোস্তফা; দুই নেত্র পল্লব হইতে টপ টপ করিয়া অশ্রুজল পড়িতে লাগিল- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; দুটি ফোঁটা অশ্রুজলে মন্দির সোপান- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; দীপহীন ঘরে আধো নিমীলিত সে দুটি আঁখির কোলে বুঝি দুটি ফোঁটা অশ্রুজলের মধুর মিনতি দোলে- প্রেমেন্দ্র মিত্র)।


মজার ব্যাপার হচ্ছে শব্দদ্বিত্বের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই জোরালো মত দিয়েছেন তাঁর ‘শব্দতত্ত্ব’ ও ‘বাংলাভাষা পরিচয়’ গ্রন্থ দুটিতে।


তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখন আর অশ্রুজলকে বাংলা ভাষা থেকে বিদায় করা যাবে না, এটা চলবেই। কারণ ওটাকে বাদ দিতে গেলে ‘সচল’, ‘সঠিক’, ‘সকরুণ’, ‘সকাতর’ শব্দগুলোকেও একই দোষে বাংলা ভাষা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। তারপরও অনেকে ‘অশ্রুজল’ শব্দটিকে অশুদ্ধ দাবি করেন। অশ্রু বলতে চোখের জল বোঝায়। যেমন করে ‘বৃষ্টি’ বলতে মেঘের পানি বোঝায়। তবে বৃষ্টির পানিকে কেউ অশুদ্ধ বলেননি।


অশ্রুজলকে এভাবেই ভাবলেই সমস্যা থাকার কথা নয়। কারণ বাংলা ভাষায় শুধু অশ্রুজলই নয়, ‘স্বেদবারি’, ‘অশ্রুবারি’, ‘আঁখিবারি’ একই অপরাধ (?) করে বসে আছে। ‘শিশিরসলিল’ও একই কাতারে পড়ে।


শব্দের গঠন সব সময় ব্যাকরণ অনুসরণ করে গঠিত হয় না। এ কারণে আর্ষপ্রয়োগ, নিপাতনে সিদ্ধ ইত্যাদি টার্ম ব্যাকরণে চালু রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘অশ্রুজল’ শব্দটি চালুর মাধ্যমে বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর উদ্ভাবনী মেধার পরিচয় রেখেছেন।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অশ্রুজল শব্দটিকে অশুদ্ধ বলেননি, বলেছেন জোড়াশব্দ বা জোড়া মেলানো শব্দ। অন্যদিকে শব্দটিকে ভিন্ন প্রকৃতির জোড়াশব্দ বলেছেন সুভাষ ভট্টাচার্য। আর চিন্তাহরণ চক্রবর্তী বলেছেন ‘আতিশয্যবাচক স্বতন্ত্র শব্দ’।


তবে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্য অনুসরণ করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী (অশ্রুজল সিঞ্চন করে আমি যে প্রেমের বল্লরী বাড়িয়ে তুলেছি, তারই করুণ করস্পর্শে পুষ্পে পুষ্পে মঞ্জুরিত হবে সে একদিন- শবনম্), আবদুল কাদির (রাতের সত্য, দিনে দেখি মিছে, তবু আনন্দ ভরে, অশ্রুজলের পেয়ালা ভরেছি পৃথিবীর খেলাঘরে) শঙ্খঘোষসহ অনেকেই ‘অশ্রুজল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।


হরিচরণের অভিধানে ‘অশ্রুবারি’, ‘অশ্রসলিল’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু অশ্রুজলই ব্যবহার করেননি, ‘অশ্রুবারি’ ও ‘অশ্রুসলিল’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন (অশ্রুবারি মুছিল না; অশ্রুসলিল ধৌত হৃদয়ে থাক দিবসযামী)।


সুভাষ ভট্টাচার্য তাঁর প্রয়োগ অভিধানে লিখেছেন ‘সচল, সঠিক, সকাতর, সকরুণ প্রভৃতি শব্দকে যেমন ব্রাত্য বলে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না, অশ্রুজল সম্পর্কেও একই কথা।’ আর সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি বিখ্যাত প্রবন্ধের নাম ‘কত না অশ্রুজল’।


জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com