
ফারজানা মিতু একজন কবি, উপন্যাসিক ও গল্পকার। তিনি তার কল্পনার বিশালতা ছড়িয়ে দেন লেখায়। যখন কষ্ট কিংবা শূন্যতা তাকে গ্রাস করে তখন লেখা তাকে নিঃশ্বাস ফেলতে সাহায্য করে। তার আমিকে তিনি খুঁজে ফেরেন লেখায়। রাতদুপুরে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, মিতু উঠে বসে যান লেখার টেবিলে। তার ভাষায়, আমার লেখার চরিত্ররা আমাকে ডাকে, আমি ওদের যন্ত্রণা শুনি, কান্না শুনি। তখন আমি না লিখে থাকতে পারি না।
সম্প্রতি বিবার্তার সঙ্গে কথা বলেন ফারজানা মিতু। একান্ত আলাপে বেরিয়ে আসে তার লেখক জীবনের নানা কথা। বিবার্তা পাঠকদের ফারজানা মিতুর লেখক হয়ে ওঠার গল্প জানাচ্ছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।
ফারজানা মিতুর জন্ম, বেড়ে উঠা সবই ঢাকায়। জন্ম হয়েছিলো একান্নবর্তী পরিবারে। দাদা, দাদী, চাচারা, আব্বা, আম্মার মাঝে ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে তার। পেয়েছেন দাদার অনেক আদর-স্নেহ আর ভালোবাসা। খুব সচ্ছল ছিল তার ছেলেবেলা। কোনো কিছু চেয়ে পাননি - এমন হয়নি কখনো। যখন যা চেয়েছেন, আব্বা পূরণ করেছেন তার অনেক বেশি। কখনোই তার ওপর কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়নি। নিজের মতো হেসেখেলেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। তাই তার কাছে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হলো পরিবার।
লেখালেখির হাতেখড়ি হলো কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ফারজানা বলেন, আসলে একটু একটু করেই শুরু। স্কুলজীবনে টুকটাক লেখা। মনে আছে স্কুলে রচনা লিখতে দিলে নিজের মনে যা আসতো সাজিয়ে লিখে দিতাম। খুব সাজিয়ে কিছু লিখার অভ্যাস সেই থেকে শুরু। কখনো গিফট কার্ডে, উপহারের সাথে লিখে দিয়েছি ৩/৪ লাইন। একদিন দেখলাম এই ৩/৪ লাইন থেকে জন্ম নিয়েছে আরও ৮/১০ লাইন, তারপর আরও বেশি। এভাবে দাঁড়িয়ে গেলো একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা। একটি থেকে জন্ম নিলো আরেকটি। এভাবে আজকে আমার ভাণ্ডারে আছে ১৪০০র অধিক কবিতা।
আর লেখার উৎসাহের বিষয়ে ফারজানার সোজাসাপ্টা জবাব, লেখালেখি যখন সত্যিকারভাবে গুরুত্বের সাথে শুরু করলাম তখন আসলে সেভাবে কারও উৎসাহ আমি পাইনি। অনেকে বুঝেই উঠতে পারেনি আমি কি লিখছি। লিখতে লিখতে আজকে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে এখন এসে অনেকেই উৎসাহ দেন। উৎসাহ-উদ্দীপনা পাওয়া শুরু আমার অনেক পরে এসে। শুরু থেকে অনেকটা পথ একাই পাড়ি দিয়েছি। তবে পরিবার আমার সাথে আছে। আর আছে বলেই লিখে যেতে পারছি।
ফারজানার প্রথম লেখা ছিল কবিতা। শুধু প্রথম নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় সবই কবিতা। লেখার শুরুটা ছিল তার কবিতা দিয়ে। তার পর পর ৩ টি বই ছিল কবিতার। উপন্যাস লেখা শুরু তার অনেক পরে এসে।
ফারজানা জানালেন, আমি রোমান্টিক ঘরানার লেখা বেশি লিখি। আমি খুব কল্পনাপ্রবণ মানুষ। কল্পনায় আমি যেভাবে আকাশ ছুঁতে পারি, সেটা বাস্তবে পারি না। আমার লেখায় মানুষের সুখ, দুঃখ-কষ্ট, মূল্যবোধ, পরিবার, সম্পর্ক সবই নিয়ে আসি। আমার লেখায় আমিই স্রষ্টা, আমি যা যেভাবে চাই সেভাবেইকাহিনী সাজাই। আমার লেখার চরিত্রের মাঝে আমি সবসময় ভালো দিকটা নিয়ে আসি। কারণ একটা বই কিংবা একটা চরিত্র পাঠককে ভাবায়, চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করে। আমি চাই আমার পাঠক যা ভাববে কিংবা চিন্তা করবে সেটা পজিটিভ হোক। মানুষের সঙ্কীর্ণতা আমাকে ব্যথিত করে। তাই আমি চাই আমার সৃষ্টি চরিত্ররা সেই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকুক।
মিতু এখন বড় পরিসরে একটা উপন্যাস লিখছেন। বলা যায় এটা তার প্রথম সাহসী লেখা। সচরাচর যা লেখেন তার বাইরে অন্যরকম কিছু একটা লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে তা প্রেম-ভালোবাসার বাইরে নয়, যদিও একটু অন্যভাবে, অন্য আঙ্গিকে। আপাতত এটাই আগে শেষ করবেন বলে সংকল্প করেছেন। এটা শেষ না করে চাচ্ছেন না নতুন কোনো লেখায় হাত দিতে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ‘বইমেলা ২০১৮’তে পাঠক বইটি হাতে পাবেন। উপন্যাসটির নাম ‘পরকীয়া’।
আলাপ প্রসঙ্গে জানা গেল মিতুর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২২ টি। ৩টি কবিতার - ভালোবাসার চাদর, তোমার সঙ্গে বহুদূর ও ভালোবাসা কোনো ঝরাপাতার শব্দ না। আর ১৯ টি উপন্যাস - নিশীথ রাতের বাদলধারা, তোমার লাগি আছি জেগে, মিতু তোমাকে ভালোবাসি, কে জানে কাহার তরে, পথে যেতে যদি আসি কাছাকাছি, আমার অদৃষ্টে তুমি, ভালোবেসে রুমাল দিতে নেই, তোমাতে করিবো বাস, কেটেছে একেলা বিরহের বেলা, আমারে না হয় না জানো, গল্পটি অন্যরকম হতে পারতো, ভৌতিক উপন্যাস লীলা, আজ দিঘীর বিয়ে, শ্রাবণধারায় এসো, প্রিয়তমেষু আমার, তিতিরের মন ভালো নেই, থাকো আমার না থাকা জুড়ে এবং শুধু তোমারে জানি। শেষের বইটি এবার দেশসেরা পাণ্ডুলিপি পুরস্কার পেয়েছে বলে জানালেন মিতু।
লেখার অনুপ্রেরণা বিষয়ে মিতু বলেন, আমার লেখার মূল অনুপ্রেরণা আমার পাঠক। বইমেলায় বের হওয়া অনেক বই পাওয়ার পরেও পাঠকের চাহিদা থাকে আরও লেখা পাওয়ার। পাঠকের অনুপ্রেরণা পাই বলেই এভাবে লিখতে পারি। ফেসবুকে আমার একটা পেইজ আছে। সেখানে আমার অনেক পাঠক আছেন, যাদের জন্য নিয়মিত কিছু না কিছু লিখতেই হয়। কখনো কখনো লিখতে বসে মনে হয়, নাহ লিখবো না কিছুদিন। কিন্তু তারপরই মনে পড়ে যায় আমার কিছু পাগল পাঠকের কথা, যাদের প্রতিনিয়ত চাওয়া থাকে আমার লেখার। পাঠকের কথা চিন্তা করলে আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আমি অনবরত লিখে যেতে থাকি।
লেখালেখির তিক্ত অভিজ্ঞতা বিষয়ে মিতু জানালেন, অনেক সময় অনেক মানুষের আচরণে কষ্ট পেয়েছি। আমাকে উৎসাহ দেবার বদলে প্রতিযোগিতামূলক আচরণ আমাকে বিষণ্ণ করেছে। যাদের পাশে পাওয়ার ছিল তাদের পাইনি, যাদের সাথে না থাকলেও চলে তাদের পেয়ে যাচ্ছি পাশে।
মিতুর ভাষায় লেখালেখির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ টিকে থাকা। আমাদের লেখালেখির লাইনে টিকে যাওয়া কিংবা নিজেকে ভালো লেখক হিসেবে দাঁড় করানো অনেক কঠিন ব্যাপার। নিজেরটাই সেরা - এই মনোভাব খুব বেশি এখানে। নিজে না পড়ে সেই লেখাকে খারাপ বলা আমাদের একটা ধর্ম। ফেসবুকে অনেক সময় অনেকের কমেন্ট পড়ে অবাক হয়ে যাই, একজন লেখকের কিংবা একজন কবির মানসিকতা এতোটা সংকীর্ণ, কল্পনাও করা যায় না। কার বই কয়টা বিক্রি হলো, কেন তাকে সেরা বলা হলো এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে কিছু কবি-সাহিত্যিক, যা খুবই বিব্রতকর। আমার কাছে মনে হয় লেখালেখির জগতে আমরা যারা আছি সবাই একটা পরিবারের অংশ। আমি বইমেলায় অনেক নতুন, তরুণ লেখকের বই কিনেছি, একটাই কারণ তাদের উৎসাহ দেয়া এবং তাদের লেখার সাথে পরিচয় হওয়া। আমি যদি এখন ব্যস্ত হয়ে যাই কাদা ছোড়াছুড়িতে, তাহলে লিখবো কখন? একজন কবি কিংবা সাহিত্যিককে বলা হয় সমাজের ক্রিম। সেই ক্রিম যদি নষ্ট থাকে তাহলে ভালো কেক আসবে কোথা থেকে?
মিতুর চিন্তাভাবনা, সবকিছু দখল করে ছিল একজন লেখকের বই, তিনি হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর বই তাকে নেশার মতো টানে। তিনি আরও অনেকের লেখা পড়েন,সমরেশ, শীর্ষেন্দু, সুচিত্রা। কিছু বই শুধু একবার না, বার বার পড়েছেন কিন্তু প্রিয় একজন লেখক বললে তিনি শুধু হুমায়ূন আহমেদের কথাই বলেন। আর এখন যাদের বই তার ভালো লাগে... তাদের অন্যতম হলেন সাদাত হোসেন, লুৎফর হাসান, আবদুল্লাহ আল ইমরান, জান্নাতুন নাইম প্রীতি, ইশতিয়াক, অপূর্ব শর্মাসহ অনেকেই।
মিতুর এখন অবসরের বড়ই অভাব। দিন দিন আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তার সত্যিকার অবসর মেলে রাতে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে গান শোনেন, বই পড়েন। গান তাকে শুনতেই হয়। আর শপিং মিতুর আরেকটি প্রিয় কাজ। তিনি সাধারণত একটা দোকান থেকেই কাপড় কেনেন। তাই সুযোগ পেলে কিংবা লিখতে লিখতে ক্লান্ত হলে ওখানে চলে যান। রান্নাও করেন মাঝে মাঝে। আর আরেকটা পছন্দের কাজ আপ্যায়ন করা।
মিতু বলেন, লিখে যেতে চাই। আমার লেখা পড়ে মানুষ আনন্দিত হবে, আমার লেখার চরিত্রর মাঝে তারা নিজেকে খুঁজে পাবে। মানুষের না বলতে পারা কথাগুলো, কষ্টগুলো তুলে ধরতে চাই।
এভাবেই ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনার কথা জানালেন ওপন্যাসিক মিতু। পাঠকের যাতে মনে হয় ফারজানা মিতুর বই মানে নিজের ইচ্ছে আর কল্পনাগুলোর সমষ্টিগত সমাবেশ। পাঠক চিনুক, বই পড়ুক এটাই একমাত্র তার চাওয়া।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]