শিরোনাম
সুলতানা পারভীনের সফল ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার গল্প
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০১৭, ১৯:১৪
সুলতানা পারভীনের সফল ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার গল্প
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

প্রথম বর্ষ অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ৩/৪ মাস আগে বিয়ে হয়ে যায় সুলতানা পারভীনের। কিন্তু তাতেই অন্য অনেকের মতো জীবনের মোড় ঘুরে যায়নি তাঁর। বরং পড়াশোনায় স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা পান তিনি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫তম স্থান নিয়ে অনার্স এবং এরপর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাস করেন।


তবে স্বামীর বদলির চাকরি এবং দুই সন্তানের দেখাশুনা ও পড়ালেখার কারণে কোনো চাকরির জন্য চেষ্টা করা হয়নি। এ নিয়ে সবসময় তাঁর মনে একটা অতৃপ্তি কাজ করত। কেননা কিছু একটা করার অদম্য ইচ্ছা ছিল তার। বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও নিজে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তবুও কেন জানি অতৃপ্তিটা মিটছিল না। নানা ভাবনার মধ্যে হঠাৎ একদিন উঁকি দিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করার কথা। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ তিনি একজন সফল ফ্রিল্যান্সার।


কথা হয় ফ্রিল্যান্সার সুলতানা পারভীনের সঙ্গে। জানালেন স্বামী-সংসার সব সামলে কীভাবে জীবনের সঙ্গে প্রতিদিন যুদ্ধ করে হয়ে উঠলেন সফল ফ্রিল্যান্সার। এই পর্বে বিবার্তার পাঠকদের সুলতানা পারভিনের ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানান অভিজ্ঞতার কথা শোনাবো।



সুলতানা পারভিন বলেন, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাটা আমি নিজেই দেখতাম। সেজন্য অন্যকিছু করার সময়টা হয়ে ওঠেনি। ২০১২ সালের কথা। তখন আমার মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। ও কোচিংয়ে যেতে শুরু করল আমিও একটু বাড়তি সময় পেলাম কিছু একটা করার। সেই সময় পত্রপত্রিকায় আউটসোর্সিংয়ের ওপর লেখাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম, ইন্টারনেটেও কিছু পড়তাম। মনে ধরল বিষয়টা। কাজটা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে, নিজস্ব সময়ে, ঘরে বসে করা যায় বলে আউটসোর্সিং করার সিদ্ধান্ত নিলাম।


ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার শুরুর অভিজ্ঞতার বিষয়ে সুলতানা পারভিন জানালেন, ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে দুইদিনের একটা কোর্সে যোগ দিয়ে জানতে পারি আউটসোর্সিংয়ের আদ্যোপান্ত। এরপর মনে হলো শুধু কম্পিউটারের বেসিক দিয়ে শুরু করার চাইতে এসইও'র ওপর কোর্স করা থাকলে হয়ত কাজ করতে সুবিধা হবে। ২০১২ সালের শেষ দিকে দুই মাস মেয়াদি এসইও কোর্সে ভর্তি হই। কোর্স চলাকালীন আমি ওডেস্কে প্রোফাইল তৈরি করি। আল্লাহর কাছে অনেক শোকরিয়া যে প্রোফাইল তৈরি করার ১২ দিনের মাথায় আমি আমার প্রথম কাজটি পেয়ে যাই। সেটা ছিল ইয়াহু অ্যান্সারের মাত্র পাঁচ ডলারের একটা কাজ। এভাবেই আমার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের পথ চলা শুরু।


কাজ করতে গিয়ে সুলতানা পারভিন দেখেন ফ্রিল্যান্সিং জগতটা বিশাল। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, প্রথম দুটি কাজ এসইও সংক্রান্ত ছিল। কাজ করতে গিয়ে দেখি আউটসোর্সিংয়ের কাজ করার রয়েছে অবারিত সুযোগ। তাই নিজে যে বিষয়ে দক্ষ সে বিষয় নিয়ে কাজ করা শুরু করি। পরে এসইও কাজের পাশাপাশি ওয়েব কনটেন্ট, রেজিউম, সিভি, কাভার লেটার, রেসিপি ট্রান্সক্রিপশন, ট্রান্সলেশন ও বুক রিভিউসহ বিভিন্ন কাজ করা ‍শুরু করি এবং ভালো সাড়া পাই। ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমি ওডেস্ক, ই-ল্যান্স, ফাইভারসহ বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে ১০০টিরও বেশি প্রজেক্টের কাজ সম্পন্ন করি এবং আমার ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে ভালো ফিডব্যাক পাই।



আউটসোর্সিংয়ের প্রতি আগ্রহ প্রসঙ্গে সুলতানা বললেন, পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেটে আউটসোর্সিংয়ের ওপর বেশ কিছু লেখা পড়েই উদ্বুদ্ধ হয়েছি। এরপর যখন দেখলাম নানা কারণে বাইরে গিয়ে কাজ করার তেমন সুযোগ নেই তখন সেই জানাটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। শুরুতে টাকার চেয়েও নিজের অভিজ্ঞতা বাড়াতে চেষ্টা করেছি, যা পরবর্তীকালে আমার কাজের গতি বাড়াতেও সাহস জুগিয়েছে।


একের পর এক আউটসোর্সিংয়ে ভালো কাজ করছিলেন সুলতানা। তাই তার কাজের স্বীকৃতি দিল বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস)। ২০১৪ সালে তিনি বেস্ট ইন ফিমেল ক্যাটেগরিতে ‘বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড ২০১৪’ পান।


সুলতানা বর্তমানে ব্লগিং ও ট্রান্সলেটিংয়ের কাজ বেশি করছেন। http://sultanarecipe.com/ নামে নিজের একটা ওয়েবসাইট আছে। নিজের সাইটের জন্য কাজ করছেন। বিভিন্ন জায়গায় সভা-সেমিনার করছেন। সুলতানা বলেন, এসব করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই পেশাটার যে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, এখানে কাজের কোনো সীমা নেই, এখানে যে যার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারে তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। তাছাড়া ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে মানুষের যেসব ভ্রান্ত ধারণা আছে তা দূর করা। আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, এই পর্যন্ত আমি যেসব সেমিনার আয়োজন করেছি, আমার সেমিনার থেকে সবাই খুব ভালোভাবে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে তাদের ধারণা নিয়ে যেতে পেরেছেন।



ফ্রিল্যান্সিং করার সুবাদে অসংখ্য বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে সুলতানার। এতেও অর্জন করেছেন নানা ধরণের অভিজ্ঞতা। এবিষয়ে তিনি বলেন, আউসোর্সিং করতে গিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি। যেমন কাজ করিয়ে নিয়ে পেমেন্ট না দেয়া। তবে সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতাটা ছিল খারাপের চেয়ে খারাপ। ওডেস্কে আমার একাউন্টে ছিল ১০০০ ডলার। আমি যেদিন উথড্র দিতে যাব সেদিন দেখি আমার ওডেস্কের ফিনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড। তখন আমি খুবই হতাশ হয়ে গেলাম। তাদের সাথে যোগাযোগ করেও কোন সদুত্তর পেলাম না বরং তারা আমার টাকাগুলো আমার ক্লায়েন্টদের ফেরত দিয়ে দিল। আমাকে বলা হলো আমি যেন পার্সোনালি আমার ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করে টাকা ফেরত আনি। দূর্ভাগ্য আমার, এক ইন্ডিয়ান ক্লায়েন্ট এবং ২ জন ক্লায়েন্ট ছাড়া আর কেউ আমার টাকা ফেরত তো দেয়নি বরং খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট ছিল বিদেশি এবং আমার প্রোফাইলে কোনো ব্যাড রিভিউ অথবা কোনো ক্লায়েন্টের কোনো নেগেটিভ মন্তব্য ছিল না। আমার পাঁচ স্টার রিভিউ প্রোফাইল ছিল। আমার কথা হলো, ওডেস্কের তো কোন রাইট নাই আমার অর্জিত টাকা আমার ক্লায়েন্টকে ফেরত দেয়ার! এমনও না যে আমার ক্লায়েন্ট থেকে এমন কোনো রিকোয়েস্ট ছিল। তারা আমাকে আগে একটা ওয়ার্নিং দিতে পারত। এরপর আমি আর ওডেস্কে কাজ করিনি।


স্বামী-সংসারের প্রতি দায়িত্ব পালনের পর বাকি সময়টা ফ্রিল্যান্সিংয়ে ব্যয় করেন সুলতানা। তাঁর ভাষায়, আমার ফ্রিল্যান্সিং কাজের প্রেরণা আমার স্বামী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন এবং আমার সকল শুভাকাঙ্ক্ষী। আরো একটা কথা বলতে চাই, আমি আমার কাজের অনুপ্রেরণা পাই যখন দেখি আমাকে নিয়ে জাতীয় পাঠ্যক্রমে (ক্যারিয়ার শিক্ষা-২০১৬ শিক্ষাবর্ষ, নবম-দশম শ্রেণি, পৃষ্ঠা-৮৪) লেখা প্রকাশ পায়, যখন দেখি অনেক নারী তাদের ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসার পেছনে আমার কথা বলে, তখন মনে হয় আমাকে আরো অনেক দূর এগুতে হবে।


আউটসোর্সিংয়ের ব্যাপারে অনেক আশাবাদী সুলতানা বলেন, বাইরে চাকরির পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘোরার দরকার নেই। এখন চাইলে কেউ ঘরে বসেই আয় করতে পারেন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সে সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমি এ বিষয়ে বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের প্রায়ই বলে থাকি।


ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে অনেক স্বপ্ন সুলতানার। তিনি বলেন, আমার প্রতিদিনই মনে হয় আমি এখনো অনেক কিছু জানি না। যদি দিনটা আরো বড় হতো, যদি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতো আমার ব্রেইন থাকত তাহলে আমি একবার দেখেই অনেক কিছু শিখতে পারতাম। প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখছি। আমার আশা আছে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং নিয়ে কিছু করার। জানি না সম্ভব হবে কিনা।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com