শিরোনাম
সব ফ্রিল্যান্সারকে উদ্যোক্তা বানানোর স্বপ্ন রুবেল রানার
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৪২
সব ফ্রিল্যান্সারকে উদ্যোক্তা বানানোর স্বপ্ন রুবেল রানার
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

''নিজেক এখনো আমি উদ্যোক্তা মনে করি না। অনেক কিছু শেখার বাকি আছে আমার। প্রতিদিন একটু একটু করে শিখছি। ছোটবেলা থেকেই নেতৃত্ব দেয়ার প্রবণতা কাজ করত মনে। ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচের আগে আমাকে প্ল্যান করার দায়িত্ব দেয়া হতো। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হতাম। আসলে সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা থেকে আমার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা, যেখানে প্রতিনিয়ত কিছু শেখা যায়, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নেয়া যায়। আমি আমার জায়গা থেকে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস একদিন সফল হবোই- ইনশাআল্লাহ্।''


কথাগুলো বলেন উদীয়মান তরুণ উদ্যোক্তা রুবেল রানা, যিনি স্বপ্ন দেখেন সব ফ্রিল্যান্সারকে উদ্যোক্তা করে গড়ে তোলার। আর তরুণদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে থেকেই সরকারের এলইডিপি প্রোজেক্টের (লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট) সাথে যুক্ত হন। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করার ইচ্ছে ছিল আগেই, যা এলইডিপি প্রোজেক্টের মাধ্যমে আস্তে আস্তে পূরণ হচ্ছে।


সম্প্রতি বিবার্তার মুখোমুখি হন রুবেল রানা। জানালেন উদ্যোক্তা হওয়ার পথে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার করে কীভাবে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা যায়, সে কথা। বিবার্তার পাঠকদের জন্য ওই গল্প তুলে ধরছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।


রানার জন্ম নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার দক্ষিণ সাধারচর গ্রামে। শৈশবে খুব চঞ্চল আর দুষ্টু প্রকৃতির ছিলেন। এজন্য মা-বাবার বকা খেতে হতো, মাঝে মাঝে উত্তম-মধ্যমও জুটতো। মা-বাবা সব সময় তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন। মা ছিলেন সহজ-সরল প্রকৃতির। তাকে যা বোঝাতেন অনেক সময় তা-ই বুঝতেন। কিন্তু বাবা ছিলেন কঠোর স্বভাবের। তাকে ভয় পেতেন রানা।


পড়াশোনা করতে ভালো লাগত না রানার। আবার খুব ভালো ছাত্রও ছিলেন না। কিন্তু স্কুলের সকল শিক্ষক তাকে চিনতেন। গান, কবিতা আর দুষ্টুমি - তিনে মিলে স্যারদের কাছে পরিচিত মুখ ছিলেন। রানা বলেন, স্কুলজীবনে কমেডি করতে ভালো লাগতো। স্কুলে স্ট্যান্ডআপ কমেডিতে অনেক পুরস্কারও আছে আমার। আছে সেরা বক্তা হিসেবেও পেয়েছি পুরস্কার।



রানাকে জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখান তার দাদী, যিনি জান্নাতবাসী হয়েছে তিন বছর আগে।


দক্ষিণ সাধারচর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি পাস করার পর দক্ষিণ সাধারচর উচ্চ বিদ্যালয়য়ে ভর্তি হন। কিন্তু বাবার পরামর্শে গ্রামের স্কুল ছেড়ে নরসিংদী আসেন। নরসিংদী টিটিসি থেকে এসএসসি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া পলিটেকনিক থেকে কম্পিউটার সাইন্সে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। বর্তমানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি ইন কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে শেষ বর্ষে পড়াশুনা করছেন।


রানা বলেন, ফুপির বাসায় বেড়াতে এসে প্রথম কাছ থেকে কম্পিউটার দেখা, তা আনুমানিক ২০০৫ সাল হবে। কম্পিউটার চালাতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু অনেক ছোট থাকার কারণে সাহস পেলাম না। বাবা-মা চাইতো পড়াশোনা করে ভালো একটা চাকরি করি। কিন্তু আমার স্বপ্ন, আমি নিজে কিছু করব। তবে আমাকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হেল্প করেছেন আমার বাবা। ২০০৫ সাল থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবো। বাবাকে এই কথা বলার সাহস ছিল না, তাই মাকেই বলেছিলাম আমার স্বপ্নের কথা। তবে বাবার দিকনির্দেশনা ও আমার একান্ত ইচ্ছায় আমি আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছি।


উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা জানতে চাইলে রানা বলেন, শুরুটা হয় আর আর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা রাসেল আহমেদ ভাইয়ের হাত ধরে। আমি রাসেল ভাইয়ের বাসায় থেকে তিন মাসের ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ট্রেনিং নেই। ভাইয়ের উদ্যোক্তা জীবনের গল্প শুনে আমারও উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন জাগে মনে। পরে একটা কম্পানিতে জব করার সুবাদে হাই-টেক পার্কের অ্যাডভান্স চিফ লেভেল ট্রেনিং করার সুযোগ পাই। ১৫ দিনের ট্রেনিংটা হয়েছিল কক্সবাজারে। দেশ-বিদেশের বড় বড় উদ্যোক্তা আমাদের ট্রেনিং করিয়েছেন। ওই ট্রেনিংয়ে আমি ছাড়াও বাংলাদেশের টপ লেভেলের ২০টা কম্পানির প্রধানগণ ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁদের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প তুলে ধরেন। এরপর থেকেই আমি কাজ শুরু করি।


২০১৪ সালে রানা ও দুই বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করেন বিগটেক আইটি (www.bigtechit.net)। প্রথমে রানা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পলিটেকনিকের ৩য়, ৫ম ও ৭ম সেমিস্টারের ছাত্রছাত্রীদের ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ট্রেনিং দেন, যারা এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জব ও নিজ উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সিং করছেন। হঠাৎ মাথায় এক আইডিয়া এল রানার। সকল ট্রেনিং সেশনের ভিডিও টিউটোরিয়াল আকারে রেখে দেন যাতে বাকি ছাত্রছাত্রীরা এসব ভিডিও দেখে সহজে শিখতে পারে। সবগুলোই লাইভ ক্লাসের ভিডিও। বর্তমানে তাদের চ্যানেলে প্রায় ৭০ টির মতো টিউটোরিয়াল আছে, যা দেখে মানুষ সহজে কাজ শিখতে পারছেন। এরপর থেকে বিগটেক আইটির পক্ষ থেকে অনলাইনে ট্রেনিং দেয়া শুরু করা হয় এবং বর্তমানেও ওই ট্রেনিং চলছে।



বিগটেগ আইটির লক্ষ্য শুধু দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরি করা নয়, ফ্রিল্যান্সার তৈরি করে তাকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা, যেন সে আরও কিছু তরুণের কর্মসংস্থানের পথ করে দিতে পারে। বিগটেগ আইটিতে ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশান ডেভেলপমেন্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সেবা দেয়া হয়।


শুরুর দিকে রুবেল রানাকে নানান ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। পরিবারের অনুপ্রেরণা পেলেও এক শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে অনেক তিরস্কার শুনতে হয়েছে। তবে এটি রানার উপরে ওঠার মনোবলকে আরও দৃঢ় করেছে।


রানা বলেন, আমাদের সমাজব্যবস্থায় চাকরি ছেড়ে দেয়াকে মানুষ ভালো চোখে দেখে না। আপনি পড়াশোনা করে ব্যবসা করছেন তা অনেকে মেনে নিতে পারেন না। বর্তমানে যে রিসোর্সগুলো সহজে পাওয়া যায় আমাদের সময় এত রিসোর্স ছিল না। পরামর্শ পাওয়ার জন্য আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু কুষ্টিয়া গিয়েছিলাম। আমি বলতে চাইছি এখন সব কিছু যেমন সহজে মেলে, আমরা যখন শুরু করি তখন বিষয়গুলো তেমন সহজ ছিল না। তারপর ছিল ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য, সব জায়গায় থ্রিজি কাভারেজ ছিল না। অনেকে রিসোর্স শেয়ার করত না, তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করত না, আমাদের একাধিক সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে, যা বর্তমানে অনেকটাই কমে গেছে।


কিছু ব্যক্তির ধারণা, আইটি বিজনেস যদি প্রচার-প্রসার হয় তাহলে তাঁদের মার্কেট ছোট হয়ে আসবে। তাদের এই ভুল ধারণার কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের বুঝতে হবে, আইটি একটি ওপেন সোর্স প্লাটফর্ম। তাই আমরা সবাই, বিশেষ করে তরুণরা, যদি মিলেমিশে কাজ করি তাহলে আইটি বিজনেসে ভালো একটি প্লাটফর্ম দাঁড় করানো সম্ভব।


এখন কী কাজ করছেন? জবাবে রুবেল জানান, এতো দিন বাংলাদেশ সরকারের এলইডি প্রজেক্টের নোয়াখালী জেলার ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত ছিলাম। ওই প্রোজেক্টের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। বর্তমানে চলছে মেন্টরিং ক্লাস। সেইসাথে ইউএসএ’র একটা প্রোজেক্টে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হলাম। এই চুক্তির আওতায় ২০ হাজার ওয়েবসাইট করে দিতে হবে, যার ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছি আমি। আমাদের আরও একটা টিম আছে, যে টিম শুধু এনভাটো মার্কেট নিয়ে কাজ ও এনালাইসিস করে প্রোডাক্ট তৈরি করে থাকে। আমাদের আরেকটা টিম সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছে।



অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কাজ শুরু করেও সফল হতে না পারার কারণ হিসেবে রানা বলেন, আপনারা (আইটি সাংবাদিক) দেখে থাকবেন, আমাদের দেশের তরুণসমাজের বিশাল একটা অংশ আইটি উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী এবং উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কাজ করছেন, অনেকে সফল হচ্ছেন আবার অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। আর হারিয়ে যাওয়া উদ্যোক্তাদের গল্প শুনে অনেক তরুণ হয়তো এই পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। আইটি উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে সফল না হওয়ার অন্যতম কারণ হল - ধৈর্যের অভাব, পার্টনার নিয়ে সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, সঠিক প্লানের অভাব, নিজের লক্ষ্য ঠিক না করা এবং ঝুঁকি না নেয়া।


বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের কী কী সমস্যা রয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রানা বলেন, আইটি উদ্যোক্তাদের নিয়ে সরকারের অনেক পরিকল্পনা আছে, কিছু বাস্তবায়নও হয়েছে। যেমন সরকার আইটি প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স মওকুফ করেছে। আইসিটি খাতে ইক্যুইটি এন্টারপ্রেনারশিপ ফান্ড ( ইইএফ ফান্ড) রয়েছে। কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার নেই বললেই চলে। যদি এই ফান্ড সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতো তাহলে আইটি উদ্যোক্তারা সফল হওয়ার ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে যেতো।


অন্যদিকে একজন উদ্যোক্তা আরও যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হলো, উদ্যোক্তাদের কোনো ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। আরও একটি বড় সমস্যা হলো, ভালো পার্টনার না পাওয়া বা পার্টনার সংক্রান্ত ঝামেলা। ভালো পার্টনার না থাকলে ব্যবসায়ে উন্নতি করা কঠিন। তাছাড়া আমাদের দেশে নারী উদ্যোক্তার প্রতিবন্ধকতা অনেক বেশি।


ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ে রানা জানালেন, আমরা যারা ঢাকায় থাকি তাঁরা অনেক কিছু খুব সহজে পেয়ে যাই। যেমন ফ্রি ট্রেনিং, ফ্রি সেমিনার, ফ্রি ওয়ার্কশপ, ফ্রি মোটিভেশন। এমনকি ফ্রি ইন্টার্নশিপ করার সুযোগও। কিন্তু যারা গ্রামে বা উপজেলা শহরে থাকে তাঁদের কাছে এই সেবাগুলো সহজলভ্য নয়। আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা হল নিজ উদ্যোগে বিগটেক আইটির মাধ্যমে তাঁদের ফ্রি প্রশিক্ষণ দেয়া, ওয়ার্কশপ করা, ফ্রি সেমিনার করা ও ফ্রি মোটিভেশন দেয়া। বাংলাদেশের গ্রামকে অন্ধকারে রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্ভব না। তাই আমি বলব, প্রতিটি গ্রাম ডিজিটাল হলেই কেবল হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com