
চাঁদপুর মতলব উপজেলার ছেংগারচরের মেয়ে রোমানা পাপড়ি।বাবা আমির হোসেন (মৃত) ছিলেন স্কুলশিক্ষক। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বাবাকে হারান পাপড়ি। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে পাপড়ি সবার ছোট। মা শিরীনা বেগম গৃহিনী। জীবনের সাথে অনেক সংগ্রাম করে পড়ালেখা করেন পাপড়ি। পরিবার চাইতো তাকে ডাক্তার বানাতে। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষাও দেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল ভিন্ন।
শৈশব থেকেই আদর্শ শিক্ষক বাবার অনুপ্রেরণা ও মুসলিম পরিবার পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা পাপড়ির জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নানান ঘটনা।
মুসলিম হয়েও তিনি কেন উচ্চশিক্ষার জন্য পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট বিষয়টা বেছে নিলেন, আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল অবস্থার সাথে সংগ্রাম করে দেশের সেরা বিদ্যাপিঠ থেকে এমফিল করছেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে কী কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন। সম্প্রতি বিবার্তার কার্যালয়ে এসব বিষয় নিয়ে পাপড়ি মুখোমুখি হন বিবার্তার। এই পর্বে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে উঠে আসা পাপড়ির জীবনের গল্প জানাচ্ছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।
জীবনের সাথে অনেক সংগ্রাম করে পাপড়িকে পড়ালেখা করতে হয়েছে। পাপড়ি বলেন, ২০০১ সালে বড় ভাই কলেজে পড়ার সময়ে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান আমার শিক্ষক বাবা। তখন আমাদের সংসারে ব্যাকআপ দেয়ার মতো কেউ ছিল না। আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে আমার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষাটাও দেয়া সম্ভব হয়নি।
সৎ ও আদর্শ বাবা পরিবারের জন্য কিছুই রেখে যাননি। সবসময় নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সমাজসেবামূলক কাজ করতে পছন্দ করতেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে প্রাইভেট পড়াতেন। অসংখ্য গরিব ছাত্রছাত্রী মানুষ হয়েছে এই শিক্ষকের হাতে। পরিবারের জন্য তার সময় থাকতো না। ছেলে-মেয়েরা ঠিকমতো পড়ালেখা করছে কিনা সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল থাকতো না। স্কুল আর মানবকল্যাণমূলক কাজেই সময় ব্যয় করতে ভালোবাসতেন তিনি।
পাপড়ি বলেন, বাবা চলে যাওয়ার পরে আমরা তিন ভাই-বোন টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি। আমার মা ভাই-বোনদের পড়ালেখার বিষয়ে অনেক আগ্রহী ছিলেন। মা মেট্রিক পাস করেছেন। তাই পড়ালেখার গুরুত্ব বুঝতেন আর সেভাবেই আমাদের শিক্ষক বাবার আদর্শে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করেছেন। আমরা টিউশনি করে যে যা পেতাম তা মা'র কাছে দিতাম। মা ওই টাকা থেকে আমাদের পড়ালেখার খরচ রেখে বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন।
মৃত্যুর ১৬ বছর পরও গ্রামের মানুষ যখন তার বাবাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে, সফলতা, সততা ও আদর্শের প্রশংসা করে এসব বিষয়গুলো পাপড়িকে গর্বিত করে। পাপড়ি বলেন, একদিন হাইস্কুলে ক্লাসে স্যার সবাইকে বড় হয়ে কে কি হবে জানতে চেয়ে হাত তুলতে বললে আমি হাত তুলি। স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,কি হতে চাও। আমার সোজাসাপ্টা উত্তর, বাবার মতো শিক্ষক।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে পাপড়ি বলেন, আমার মা কোনো দিনও আমাদের পড়ালেখার বিষয়ে কোনো কিছু বলতেন না। বড় ভাই যখন ঢাকায় চলে আসতো তখন সন্ধ্যা হলেই আমরা তিন বোন তিন রুমে বই নিয়ে বসে যেতাম। কে কার আগে কত দ্রুত বেশি পড়ালেখা করতে পারে এই প্রতিযোগিতা চলতো। আর পড়ার শেষে সারাদিনের গল্পগুলো সবাই শেয়ার করতাম আর মা সেগুলো মন দিয়ে শুনতো।
ছেংগারচর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং ঢাকায় এসে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস পাস করেন পাপড়ি। পরিবারের স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষাও দেন। কোনো কারণে সেটা বানচাল হয়ে যায়। তখন পাপড়ি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে পাস করলে ভাইভাতে অংশগ্রহণ করেন। ভাইভা বোর্ডে স্যাররা সব কাগপত্র দেখে তাকে বললেন, এই পাপড়ি তুমি পড়ার জন্য পালি নাও। স্যারদের মুখের উপরে আর 'না' করতে পারেননি পাপড়ি।
পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিষয়ে পাপড়ির আগে কোনো ধারণাও ছিল না। সায়েন্সের ছাত্রী হওয়ায় মনে জোরটা ছিল তার একটু বেশি। ভাইভার পরের দিন ছিল শুক্রবার। ডিপার্টমেন্টে এসে সব বন্ধ দেখে এক বন্ধুকে ফোনে জিজ্ঞাসা করলেন, দোস পালি কি রে? বন্ধু জবাবে জানালেন, এটা তো বৌদ্ধদের সাবজেক্ট। কোনো আগপিছ চিন্তা না করেই শুরু করেন অনার্সের পড়ালেখা। বিষয়টা কঠিন হলেও ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতায় ধীরে ধীরে ভাল রেজাল্ট করতে থাকেন পাপড়ি। প্রথম সেমিস্টারে তৃতীয় এবং এরপর থেকে একেবারে শেষ বর্ষ পর্যন্ত প্রতি সেমিস্টারে প্রথম হয়েছেন।
পাপড়ি তার মেধা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন ঢাবির বিভিন্ন অঙ্গনে। বর্তমানে তিনি ঢাবির গবেষণা সংসদের নৃ-তাত্ত্বিক দলের সমন্বয়ক, ঢাবির সাহিত্য সংসদ সদস্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত।
২০১৩ সালে অনার্সেফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন পাপড়ি। ২০১৪ সালে মাস্টার্স পাস করেন এবং এবারও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। মাস্টার্সে ভাল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে গোল্ড মেডেল পান কৃতি এই শিক্ষার্থী। অনার্স ও মাস্টার্সে ভাল করারজন্য ডীনস্ অ্যাওয়ার্ডও লাভ করেন।
অ্যাওয়ার্ড পেয়ে ঢাবির শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পাপড়ি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবনে সবথেকে বেশি অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ পেয়েছি আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে। আমাকে অভিভাবকের মতো করে ছায়া দিয়েছেন যেকোন সময়ে-অসময়ে। আন্তরিক সাহয্য-সহযোগিতার জন্য আজ বিবার্তার মাধ্যমে শ্রদ্ধেয় স্যার-ম্যামদেরকে কৃতজ্ঞতাসহ অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই আমার পরিবারের সবাইকে যারা অনেক সহযোগিতা করে আমাকে এই পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছে। আমাকে নিয়ে এমন সুন্দর ফিচার প্রকাশ করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই বিবার্তার সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি আপুসহ বিবার্তা পরিবারের সকলকে।
ঢাবিতে যখন ভতি হন তখন নিজের ডিপার্টমেন্ট চিনতেন না পাপড়ি। একদিন এসে ঘুরেফিরে খুঁজে না পেয়ে চলে গেলেন। পাপড়ি বলেন, পরে আরেক দিন নবীন বরণের জন্য ঢাবিতে আসি। এসে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও ডিপার্টমেন্ট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নবীন বরণের অডিটোরিয়াম খুঁজে বের করতেই অনেক সময় কেটে যায় আমার। শেষে খুঁজে পাই। এই ঘটনাটি মনে পড়লে এখানো অনেক হাসি।
পাপড়ি এখন ‘বৌদ্ধদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা : পরিপ্রেক্ষিত ঢাকা শহর’ বিষয় নিয়ে এমফিল করছেন। এই বিভাগের ছাত্রী হিসেবে বিষয়টাকে নিয়ে গবেষণা কাজ করার ইচ্ছা আছে তার। গবেষণার পাশাপাশি পিএইচডি করার স্বপ্ন আছে মনে। আর শৈশবের স্বপ্নকে বাস্তবে শিক্ষক হয়ে রূপ দিয়ে বাবার মতো আদর্শ শিক্ষক হতে চান তিনি।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]