
জীবনে কখনো ভাবেননি বড় হয়ে ফ্রিল্যান্সিং করবেন। এ বিষয়ে কোনো ধারণাও ছিল না তাঁর। জীবনের তাগিদে অ্যাড ফার্মে চাকরি নেন। সেখানে নিজ কাজের ফাঁকে গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের কাজ দেখে দেখে গ্রাফিক্সের কিছু কৌশল আয়ত্ব করেন। এরপর চাকরির পাশাপশি গ্রাফিক্স ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের উপরে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। দীর্ঘ ৯ বছর ফ্রিল্যান্সিংয়ের পর আজ তাঁর নাম বিশ্বের সেরা ফ্রিল্যান্সারদের তালিকায়।
তিনি হচ্ছেন বিশ্বে ফ্রিল্যান্সারদের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংগঠন, ২৫ মিলিয়ন সদস্যবিশিষ্ট ফ্রিল্যান্সারডটকম পরিবারের টপ ফ্রিল্যান্সার লিস্টের চারে স্থান করে নেয়া সালাউদ্দিন ইশাদ।
কাজকে ভালোবেসে নিরলস পরিশ্রম করে গেলে সফলতা যে একদিন ধরা দেয়, এরই প্রমাণ ফ্রিল্যান্সার সালাউদ্দিন ইশাদ। সম্প্রতি ফ্রিল্যান্সারডটকম তাদের শীর্ষস্থানীয় ফ্রিল্যান্সারদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে।সেই তালিকায় সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছেন সালাউদ্দিন ইশাদ। বিশ্বের দরবারে এখন সেরা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
ফ্রিল্যান্সার ডটকমে বর্তমানে ২৫ মিলিয়ন সদস্য রয়েছেন যারা নিয়মিত এই সাইটে কাজ করছেন। লাখো ফ্রিল্যান্সারকে পেছনে ফেলে সালাউদ্দিন ইশাদ কীভাবে শীর্ষ-৪এ জায়গা করে নিয়েছেন এই পর্বে বিবার্তার পাঠকদের সেই গল্প জানাচ্ছেন প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।
পুরানো ঢাকার গেন্ডারিয়ায় বেড়ে ওঠা ইশাদের। ২০০৮ সালে মতিঝিল মডেল স্কুল থেকে এসএসসি, ২০১২ সালে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করায় বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল তাঁকে ডাক্তার বানানোর। এতে নিজেরও মত ছিল। কিন্তু জীবনের তাগিদে ওই স্বপ্নের প্লট যায় বদলে। মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই থেকেই চাকরি নামক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে তাঁকে।
রাজধানীর দৈনিক বাংলা এলাকায় একটা অ্যাড ফার্মে চাকরির মধ্য দিয়ে ইশাদের কর্মজীবন শুরু হয়। তখন কম্পিউটার চালানোর প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও ছিল না তাঁর। বাসায়ও ছিল না কোনো কম্পিউটার। কিছুদিন কাজ করার পর ওই প্রতিষ্ঠানের গ্রাফিক্স ডিজাইনার হঠাৎ অন্য জায়গায় চলে গেলে তখন সমস্ত গ্রাফিক্সের দায়িত্ব এসে পড়ে ইশাদের উপর। অফিসের কলিগ ও বিভিন্ন প্রেসে গিয়ে একটু একটু করে গ্রাফিক্সের কাজ শিখে দুই বছর কাজ করেন সেখানে।
কোনোরকমের কাজ জানা ইশাদ এবার যোগ দেন সংগীতা মিউজিক প্রতিষ্ঠানে। এখানে অনেক গুণী গ্রাফিক্স ডিজাইনারের সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ হয় তাঁর। কিন্তু সহজে কেউ তাঁকে গ্রাফিক্সের কাজ শেখাতে চাইতেন না। বড় শিল্পীদের কাজ দেখে আর ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে সেগুলো নিজে অ্যাপ্লাই করে কাজ শিখতে থাকেন। এক সময় কঠোর সাধনার মধ্যদিয়ে অ্যাডোবি ফটোশপ ও ইলাস্ট্রেটরের মৌলিক কাজগুলো মোটামুটি আয়ত্ব করে ফেলেন। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় তাঁর। বাসায় একটা পিসিও কিনে ফেলেন। এরপর যোগ দেন ধানমন্ডির একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে।
ইশাদ বলেন, একদিন ফেসবুকিং করার সময় ক্রিয়েটিভ আইটির ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের বিজ্ঞাপন দেখে কৌতূহল জাগে। ইন্টারনেটে এ বিষয়ে বিস্তারিত পড়ে জেনেছি। কিন্তু কীভাবে করবো তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ২০১৩ সালে ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনির হাসান ভাইয়ের কাছে গেলে তিনি আমাকে প্রশিক্ষণে যোগ দিতে বলেন। শুরু করি গ্রাফিক্স ও আউটসোর্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ। আগে থেকে গ্রাফিক্সের কাজ জানা থাকায় ক্লাসে যে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দিলে সবার আগে করে দিতাম। অন্য ছাত্রছাত্রীরা অবাক হতো। প্রশিক্ষণ শেষে ক্রিয়েটিভ আইটিতেই সিনিয়র গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে চাকরি হয়ে যায়।
ইশাদ সকাল ৯ থেকে বিকেল ৫টা চাকরি করেন, রাতে শুরু করেন আউটসোর্সিং কাজ। প্রথমে ওডেস্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে বিটের জন্য অ্যাপ্লাই করলে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে রিপ্লাইও পেয়ে যান। কাজটা ছিল একটা কম্পানির লগো বানানোর। কাজটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই করে দেন। টাকা পাওয়ার প্রসেসটা জানা না থাকায় ক্লায়েন্টও টাকা দেননি। আর ইশাদও কিছু বলেননি। পরে আরো জেনেবুঝে কাজ করে যান।
ইশাদের ভাষায়, চাকরির পাশাপাশি আউটসোর্সিং করায় যখন ক্লায়েন্টরা প্রজেক্টের জন্য নক করতেন তখন সাথে সাথে রিপ্লাই দিতে না পারলে ওই ক্লায়েন্ট আর যোগাযোগ করতেন না। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই চাকরি আর আউটসোর্সিং সমান তালে করে যেতে থাকি। রাতে এক বা দুই ঘন্টা ঘুম হতো, কোনো দিন তাও হতো না। সকালে আবার চাকরি। এভাবেই কাজ করেছি দুই বছর।
২০১৬ সালে হঠাৎ একদিন আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার সংগঠন ফ্রিল্যান্সারডটকম টিমের পক্ষ থেকে ইশাদকে মেইল করা হয়। মেইলে তাঁর বায়োডাটা চাওয়া হয়। তাঁকে নিয়ে একটা ফিচার করার কথা জানান ওই টিম। সব তথ্য দিয়ে মেইলের রিপ্লাই করেন ইশাদ। সেটি ফ্রিল্যান্সারডটকমে প্রকাশও করা হয়। দেখে ইশাদের কাজের গতি যায় বেড়ে। এতো প্রজেক্টের প্রস্তাব আসতে থাকে যে রাতে কাজ করে শেষ করতে পারতেন না। এক সময় ক্রিয়েটিভের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আউটসোর্সিংয়ে পুরো সময় দেয়া শুরু করেন ইশাদ।
ইশাদ বলেন, চাকরিটা ছাড়ার পরে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করা শুরু করি। দিনে-রাতে ইচ্ছেমতো কাজ করি। কেউ কোনো প্রেসার দেয় না। প্রজেক্ট নেই আর নিজের মতো করে সঠিক সময়ে তা সম্পন্ন করে দেই। ইচ্ছে হলে করি, না হলে করি না। আয়ও চাকরির চেয়ে ভাল। এটা একটা স্বাধীন পেশা।
আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার সংগঠন ফ্রিল্যান্সারডটকমে নিজের নাম লেখানোর বিষয়ে ইশাদ জানান, গত জুলাই মাসে ফ্রিল্যান্সারডটকম টিমের পক্ষ থেকে একটা মেইলে আমাকে নিয়ে ফিচার করার কথা বলেন। আমিও তাঁদের সহযোগিতা করি। গত ১২ আগস্ট ওই ফিচারটা আন্তর্জাতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয় এবং ওই ফ্রিল্যান্সার সংগঠনের ২৫ মিলিয়ন সদস্য পরিবারের টপ ফ্রিল্যান্সার লিস্টের চারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমাকে স্থান দেয়া হয়। এই স্বীকৃতি আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের। অনেক কৃতজ্ঞতা ক্রিয়েটিভ আইটিকে।
এই সাফল্য অর্জনের পেছনে অনেক মানুষের অবদান রয়েছে বলে জানান ইশাদ। বলেন, প্রথমে বলবো আমার বাবা-মা। কাকা আবুল কালাম আজাদ, আমার বড় ভাই শাহেদ হাসান। যিনি ঢাকা ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সেই শুরু থেকেই তিনি আমাকে সাহায্য সহযোগিতা পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়াও আমার কিছু কাছের মানুষের অবদান সত্যিই ভোলার নয়।
ভবিষ্যত আইসিটি সেক্টর নিয়ে কল্যাণমূলক কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইশাদের। প্রযুক্তিতে যারা অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, এসব ছাত্র-ছাত্রীর জন্য একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে চান এই সফল ফ্রিল্যান্সার। এছাড়া ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কীভাবে আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় সেই চেষ্টা করছেন। তিনি বিশ্বের একনম্বর ফ্রিল্যান্সার হতে চান।
ইশাদ বলেন, আউটসোর্সিং কাজ করে জীবনকে আরও বদলাতে চাই। আগ্রহী তরুণ-তরুণীদের, আপনারা ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য এগিয়ে আসুন। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে অনেক সম্ভাবনা।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]