শিরোনাম
সাদ্দাম হোসেনের আত্মরক্ষা অ্যাপ তৈরির গল্প
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০১৭, ১৬:৪৩
সাদ্দাম হোসেনের আত্মরক্ষা অ্যাপ তৈরির গল্প
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

২০১২ সালের মার্চ মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে বাসায় (মেহেরপুর) ফিরছিলাম। হঠাৎ ৭-৮ জন ছিনতাইকারী এসে আমার মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে যায়। ঠিক তখনই আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। সারাদেশে প্রতিদিন আমার মতো অসংখ্য মানুষ ছিনতাইকারী কিংবা অপহরণকারীর কবলে পড়ছেন। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সময় খবরটা তাৎক্ষণিক কীভাবে আপনজন বা আশপাশের পুলিশ প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় - ভাবতে থাকি। বললেন তরুণ অ্যাপ ডেভেলপার মো. সাদ্দাম হোসেন।


তিনি বলেন, স্মার্টফোনে যদি এমন একটা অ্যাপ্লিকেশন (সফটওয়্যার) থাকত, যেটার মাধ্যমে একটা বাটন চাপার সাথে সাথেই বিপদের কথা পুলিশ প্রশাসনের কাছে জানানো সম্ভব, তাহলে হয়তো ছিনতাইকারীদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে হারানো মোবাইল ফোনটা ফিরে পাওয়া যেতো। সেদিন থেকেই আইডিয়াটিকে কীভাবে মোবাইল অ্যাপে রূপান্তরিত করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করতে থাকি।


সাদ্দাম হোসেন বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশব্যাপী পরিচালিত মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) উন্নয়নে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচির আওতায় সারা দেশের মতো চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এ ২০১৪ সালের ৮-১২ ফেব্রুয়ারি ৫ দিনের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) তৈরির প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে মোবাইল অ্যাপ তৈরির শিক্ষা লাভ করি।


তিনি বলেন, মোবাইল অ্যাপ ডেভলপমেণ্ট প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় প্রশিক্ষকদের সাথে আইডিয়াটিা শেয়ার করলে তারা আমাকে সব ধরনের সাহায্য করার আশ্বাস দেন। তখন স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ শুরু করি। তারপর থেকে প্রশিক্ষক ও মেন্টরদের সহযোগিতায় অ্যাপের বিভিন্ন ফিচার যোগ করতে থাকি। দীর্ঘ দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে শেষ হয় নাগরিক নিরাপত্তা, জরুরি সাহায্য ও অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে সহায়তাকারী মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ‘সেলফ প্রটেক্ট’অ্যাপের কাজ। এরপর বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা ও বিজ্ঞান মেলায় প্রদর্শন করতে থাকি। বর্তমানে এটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।


সম্প্রতি সাদ্দাম হোসেন অ্যাপটি নিয়ে বিবার্তা২৪ডটনেটের সঙ্গে কথা বলেন। জানান তার জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ‘সেলফ প্রটেক্ট’অ্যাপ তৈরির গল্প। ওই গল্প বিবার্তার পাঠকের কাছে তুলে ধরছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।


মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার বাবুপুর গ্রামে জন্ম মো. সাদ্দাম হোসেনের। বাবা মো. জামাত আলী, মা শাহানারা খাতুন গৃহিনী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় সাদ্দাম। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। মেহেরপুর পৌর কলেজ থেকে ২০০৯ সালে এইচএসসি পাস করে ডাক্তার হওয়ার জন্য ঢাকায় মেডিকেল কোচিংও শুরু করেন। কিন্তু সাদ্দামের স্বপ্ন ছিলো গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে ব্যতিক্রমী ও উদ্ভাবনী কিছু করার। তাই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করেনি, অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষা দেননি। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার উদ্দেশ্যে ভর্তি হন রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।


কয়েক সেমিস্টিার পড়ার পর জটিল রোগে আক্রান্ত হন। ঢাকায় দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ না হলে ডাক্তারের পরামর্শে সুস্থ হওয়ার জন্য রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয় সাদ্দামকে। দুই বছর বাড়িতে চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। চিকিৎসায় অনেক টাকা ব্যয় হওয়াতে আর্থিক সমস্যার জন্য তার আর ঢাকায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটিতে ফেরা সম্ভব হলো না। পরে চুয়াডাঙ্গায় ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। তখনই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশব্যাপী পরিচালিত মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) উন্নয়নে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচিতে অংশ নেন। এরপরেই শুরু হয় তার উদ্ভাবনী কার্যক্রম। কিন্তু পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে গবেষণা ও পড়াশুনা এক সাথে চালিয়ে যেতে অনেক কষ্ট হয় এই তরুণ উদ্ভাবকের।


ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি থেকে আবার ঢাকায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ফিরে আসেন সাদ্দাম। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, একদিন ড্যাফোডিল বিশ্বদ্যিালয়ের চেয়ারম্যান সবুর খান স্যারকে ফেসবুকে ম্যাসেজের মাধ্যমে আমার গবেষণা ও অ্যাপ সম্পর্কে জানালে তিনি বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে আমাকে দেখা করতে বলেন। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দুই বছর আগেও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ালেখা করা, চলে যাওয়ার কারণ এবং বর্তমানে পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে গবেষণা ও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে কষ্টের কথা জেনে নেন তিনি। শুনে স্যার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে স্কলারশিপ দেয়ার কথা জানান। তখন আমি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে সিএসইতে ভর্তি হই এবং এখান শেষ বর্ষে পড়াশুনা করছি।


সাদ্দাম বলেন, সবুর স্যার আমার স্বপ্নকে নতুনভাবে বাস্তবায়িত করার সুযোগ দিয়েছেন। তখন থেকেই তিনি আমাকে সার্বিকভাবে সহায়তা করছেন। তিনি আমাকে এই সাপোর্ট না দিলে হয়তো এই উদ্ভাবনের কাজটা আমার পক্ষে করা সম্ভব হতো না। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. সৈয়দ আখতার হোসেন স্যারও সহযোগিতা করছেন।


বিপদের সময় অ্যাপটি ব্যবহার সম্পর্কে সাদ্দাম জানালেন, সেবা পাওয়ার জন্য ব্যবহারকারীকে মোবাইলে (স্মার্টফোনের) অ্যাপটি ইন্সটল করে সবসময় সক্রিয় রাখতে হবে। যে কোনো বিপদের সময় স্মার্টফোনের পাওয়ার বাটনটি পরপর তিন বার প্রেস করলেই নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও ফ্রেন্ডস এবং ফ্যামিলির কাছে ব্যক্তির অডিও, ফুটেজ এবং অবস্থান মানচিত্রসহ প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে যাবে। এমনকি মোবাইল ফোনটি হারিয়ে গেলে বা ছিনতাইকারী নিয়ে যাওয়ার পর ফোনের সিম পরিবর্তন করলেও অ্যাপটি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই মোবাইল ফোনটির অবস্থান, ব্যবহৃত নতুন সিম নাম্বার, ফোনের আইইএমআইসহ পুলিশের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলির নাম্বারে চলে যাবে।


সাদ্দাম বলেন, অ্যাপটি ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট কানেকশন বা ডাটা অন থাকা লাগবে না। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট কানেকশন অফ থাকলেও জিপিএস অন থাকার কারণে সার্ভিস প্রোভাইডার বা মোবাইল অপারেটরের সাহায্যে সেন্ট্রাল সার্ভারের মাধ্যমে বার্তাটি নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে ও অ্যাপে সেটআপকৃত ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলির নাম্বারে পৌঁছোবে। মোবাইল ফোনটি ছিনতাইকারী নিয়ে যাওয়ার পর সিম পরিবর্তন করলে অ্যাপটি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই মোবাইল ফোনটির অবস্থান পুলিশের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলির নাম্বারে চলে আসবে। এতে ছিনতাইকারীর অবস্থান জানা এবং তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।


এছাড়াও এই অ্যাপের মাধ্যমে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা, আইনী সহায়তা কেন্দ্র, মানবাধিকার কমিশন, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সংস্থার কাছে প্রয়োজনীয় অভিযোগ ও মতামত জানাতে পারবেন। অ্যাপের মাধ্যমে জরুরী সেবা যেমন হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, ব্লাড ব্যাংক ইত্যাদির সাহায্য-সহায়তা নিতে পারবে। ব্যবহারকারীর নিকটস্থ হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, এটিএম বুথ, ব্যাংক, আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল ইত্যাদি অ্যাপ স্ক্রিনে দেখা যাবে এবং ব্যবহারকারী তা খেকে প্রয়োজনীয় সেবাটা গ্রহণ করতে পারবে।


অ্যাপটি মার্কেট প্লেসে আনা বিষয়ে সাদ্দামের ভাষ্য, অ্যাপটি জননিরাপত্তামূলক ও অপরাধ দমনসংক্রান্ত হওয়ায় গুগল প্লে-স্টোর, উইন্ডোজ অ্যাপ স্টোর ও আইওএস অ্যাপ স্টোরে দিতে পুলিশ সদর দপ্তর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। কারণ, অ্যাপটির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা প্রথমে পুলিশ বা আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রথমে জানাবে। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিটিকে সহায্য করতে এগিয়ে আসবে। এজন্য সরকারের পুলিশ সদরদপ্তর, আইসিটি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি ডিভিশন ও একসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম (এটুআই) প্রকল্পে আবেদন করা হয়েছে। সরকারের অনুমতিসাপেক্ষে অ্যাপটি মার্কেট প্লেসে আনা হবে।
‘সেলফ প্রটেক্ট’অ্যাপ তৈরির জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত খুলনা বিভাগীয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা এবং মেহেরপুর জেলা ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের সম্মাননা লাভ করেন সাদ্দাম হোসেন। খুলনার বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ তাকে অভিনন্দন জানান এবং মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ এটিকে মেহেরপুর জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার আশ্বাস দেন।


তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জনকল্যাণমূলক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও জননিরাপত্তামূলক যুগোপযোগী বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার তৈরি করে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ করে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে অংশীদার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। তিনি ইতিমধ্যে তার উদ্ভাবনী টিম নিয়ে উনকিটেক (WinkyTech) (www.winkytech.com) নামের একটি স্টার্টআপ আইটি ফার্ম শুরু করেছেন।


অ্যাপটি নিয়ে তার প্রত্যাশা হলো, সরকার যদি এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে অনুমতি, অ্যাপটির নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে এবং অ্যাপটির উন্নতি সাধনে সার্বিক সহযোগিতা করেন, তাহলে সরকারের জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। সেই সাথে সফলতার মুখ দেখবে তার উদ্ভাবন।


ইতোমধ্যে অ্যাপটি পাইলট প্রকল্প আকারে মেহেরপুর জেলায় প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ সদর দফতর ও সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত আইসিটি ডিভিশন ও একসেস টু ইনফরমেশনে (এ টু আই) আবেদন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক অ্যাপটি সরকারিভাবে কার্যকর করবেন বলে সাদ্দামকে আশ্বাস দিয়েছেন।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com