মো. সোহাগ মিয়া। চাঁদপুরের কচুয়া ১০নং গোহট ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ছিলেন নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও কাজ করেছেন নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে। ছিলেন আনারস প্রতীকের প্রার্থীর কেন্দ্র কমিটির আহবায়ক।
এছাড়া ২০০৪ সালের দিকে বিএনপির সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আনম এহসানুল হক মিলনের অনুসারী ছিলেন সোহাগ। সে সময় নূরপুর ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ে এমপি মিলন এবং বিএনপি কর্মীদের জন্য বিশাল ভূরিভোজের আয়োজন করিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তন হলে ধীরে ধীরে রূপ বদলাতে থাকেন সোহাগ। ২০১১ সালে উপজেলা যুবলীগকে ম্যানেজ করে হয়ে যান ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক। এরপর আর পেছন তাকাতে হয়নি তাকে। শিক্ষাগত যোগ্যতায় স্বশিক্ষিত সেই সোহাগ এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটির সদস্য।
একই উপজেলার এনামুল হক শামীম। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস। ছিলেন চাঁদপুরের কচুয়া আশ্রাফপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। হাবিব মজুমদার জয়। চলতি বছরের শুরুর দিকেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যার নামের পদবী থাকতো উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। সোহাগের মতো তারা দু’জনও এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটির সদস্য।
কচুয়া উপজেলার নানা অনুষ্ঠানে উপ-কমিটিতে জায়গা পাওয়া এসব নেতাদের নিয়ে হাজির হন সেলিম মাহমুদ
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, কচুয়ার পৃথক ইউনিয়নে তাদের বাড়ি হলেও এক জায়গায় তাদের মিল রয়েছে। পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তাদের সবার অবস্থান ছিলো নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটির সদস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিতর্কিত ও যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকাদের নিজ স্বার্থে ব্যবহারের জন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-কমিটিতে পদ দিয়েছেন তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ।
অভিযোগ আছে শুধু নিজের উপজেলা থেকেই নয় জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকেও আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য করেছেন সেলিম মাহমুদ। ‘বঙ্গবন্ধু তথ্যপ্রযুক্তি ফোরাম’ নামে ভুঁইফোড় একটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মো. সারোয়ার মামুন চৌধুরী ও সদর উপজেলার রাকিব উদ্দিন জুয়েল ঢালীসহ আরো বেশ কয়েকজন রয়েছেন এই তালিকায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কচুয়া উপজেলার নানা অনুষ্ঠানে উপ- কমিটিতে জায়গা পাওয়া এসব নেতাদের নিয়ে হাজির হন সেলিম মাহমুদ। সেলিম মাহমুদের অনুপস্থিতে তারাই কচুয়া নিয়ন্ত্রণ করেন। আগামী দিনে চাঁদপুর-১ আসনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিকল্পনা থেকেই তিনি এসব কাজ করছেন। এনিয়ে চলমান রয়েছে ডিজিটাল প্রচারণা।
অন্যদিকে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’হিসেবে পরিচিত তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটি। এই উপ-কমিটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণপূর্বক সেগুলো দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে উপস্থাপন করেন। দলের প্রয়োজনে সব প্রাসঙ্গিক বিষয়ে গবেষণা কর্ম পরিচালনা ও তার ফলাফল নিয়মিত জানিয়ে থাকে সর্বোচ্চ নেতাদের।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই উপ-কমিটির অনুমোদন দেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার ড. সাইদুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান এবং আইন ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম মাহমুদকে সদস্য সচিব করে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা-বিষয়ক উপ-কমিটি গঠিত হয়।
কমিটিতে অর্থনীতিবিদ, গবেষক, প্রযুক্তিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকদের রাখা হয়। তবে তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটি গঠনের পর থেকে এ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনা অনুযায়ী উপ-কমিটির সদস্য সংখ্যা ৩৫ হওয়ার কথা থাকলেও সদস্য সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়েছে।
কমিটি প্রকাশের সাতদিনের মাথায় বিতর্কের মুখে ওই কমিটির সদস্য অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে বাদ দেয়া হয়। নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীকের বিরোধীতা, দলে অনুপ্রবেশকারী বিতর্কিত ব্যক্তি, এসএসসি পাস করা ব্যক্তিদের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়ায় জন্মদেয় নতুন বিতর্কের।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং আইন ও জ্বালানী বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম মাহমুদ বিবার্তাকে বলেন, আমার কমিটিতে বিতর্কিত কেউ নেই। আমি একজন আইনজীবী। আমার কমিটির বিরুদ্ধে আপনি যদি কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান আমি কিন্তু ডিজিটাল অ্যাক্টে মামলা করবো। যদি আপনারা কোনো কিছু করেন, আমি সাবধান করে দিচ্ছি। আপনাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল অ্যাক্টে ব্যবস্থা নিবো।
তিনি বলেন, আমাদের এটা একটা ন্যাশনাল কমিটি। আমরা যাদেরকে প্রয়োজন মনে করেছি, তাদেরকে রেখেছি। সারা দেশের কাজ শুধু কেন্দ্রে হয় না। সারা দেশের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, তথ্য উপাত্ত যাচাই-বাছাই এজন্য আমাদের কিছু ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, যুবলীগের নেতা-কর্মী আমাদের দরকার। সবাইকে কি পিএইচডি হতে হবে? আমরা যেভাবে সেন্ট্রালে কমিটি করি বা করার কথা সেভাবে করেছি। অতীতে কারও বিরুদ্ধে সিরিয়াস কোনো অভিযোগ কি ছিল। আমার জানা মতে ছিলো না। ঐটা আমার উপজেলা, আমি জানি। এগুলো সব মিথ্যা কথা। আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এই কমিটি নিয়ে যদি আপনি কোনো ধরনের উদ্দেশ্যমূলক কাজ করেন, আমি কিন্তু তথ্য ও গবেষণা-বিষয়ক সম্পাদক। যদি টার্গেট করে কিছু করেন তাহলে কিন্তু ছাড় দেবো না।
অভিযুক্ত সোহাগের বিষয়ে আইন ও জ্বালানী বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, আমি যে তথ্য জানি সোহাগ নমিনেশন চেয়েছিলো কিন্তু পায়নি। পরে সে কোনো নির্বাচন করেনি। অনেক উপকমিটি হয়েছে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, সম্পাদকের তার নিজের জেলা থেকে দুই চারজন থাকে, এটা স্বাভাবিক। থাকতে পারে। এগুলো বিষয় না। প্রশ্ন হচ্ছে তারা কি অন্য দলের কিনা? তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অপরাধের অভিযোগ আছে কিনা?
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগ আছে এমন প্রশ্নে ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, না না না, এগুলো মিথ্যা কথা। যিনি এগুলো করছেন তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুমোদন পাওয়া তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটির সদস্য সচিব ড. সেলিম মাহমুদের কাছে বর্তমান কমিটির সদস্য সংখ্যা কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকদিন হয়ে গেছে, এই মুহূর্তে সঠিক সদস্য সংখ্যাটা আমার মনে নেই। তবে অন্যান্য উপ-কমিটির মতোই হয়েছে।আমাদের সাধারণ সম্পাদক মহোদয় তিনি যতুটুকু যৌক্তিক মনে করেছেন ততটুকু রেখেছেন। এটা বেশিও না, কমও না। এটা অন্যান্য কমিটির মতো মডারেট। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অভিযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিবার্তাকে বলেন, নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেছে এমন কোনো ব্যক্তির তালিকা থাকলে আমাদের দ্রুত দেন। তদন্ত করে যদি সত্য হয়, দল থেকে বহিষ্কার করে দেবো। প্রয়োজনে আইনের হাতে তুলে দেবো। এরকম লোকেরা ভবিষ্যতে যাতে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট না করতে পারে আমরা সেই ব্যবস্থা নেবো।
উপ-কমিটির সদস্যের সংখ্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্য সংখ্যার বিষয়ে আমাদের পার্টির মুখপাত্র জননেতা ওবায়দুল কাদের সাহেব যেটা বলেছেন সেটাই।
বিবার্তা/সোহেল/গমেজ/শাহিন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]