করোনার কারণে নিম্নআয়ের মানুষ যতটা বিপদে পড়েছে, তার চেয়ে বেশি বিপদে ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তারা না পারছে নিজেদের সামাজিক অবস্থান ধরে রাখতে, না পারছে কারো কাছে হাত পাততে। তাদের অনেকেরই এখন ভেতরে ভেতরে গুমরে মরার দশা। চাকরি হারিয়ে কেউ হয়েছেন সবজি বিক্রেতা, কেউবা হয়েছেন রিকশাচালক। এখানেই শেষ নয়, করোনার লকডাউনের নির্মম বাস্তবতায় কেউ কেউ হারিয়েছেন সংসার। চলে গেছেন সহধর্মিনীও।
তেমনি একজন বারেক গাজী। বিবার্তার এ প্রতিবেদক বাংলামোটর থেকে রিকশায় মতিঝিল যাওয়ার পথে রিকশাচালক বারেক গাজীর মোবাইল ফোন একাধিকবার বাজছে দেখে 'ফোন কেন ধরছো না' জানতে চাইলে বললো, আমার ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ আমাকে ফোন দেয় না। পরে রিং ব্যাক করবো। কেন তোমার বউওতো ফোন করতে পারে? উত্তরে- স্যার বউ ভাইগ্যা গেছে। কেন তোমাকে ছেড়ে গেল? স্যার লকডাউনে চাকরি গেছে, তাই বউটাও আমার তিন বছরের একটি ছেলে রাইখ্যা ভাইগ্যা গেছে। ইনকাম নাই, তাই বউও নাই।
বারেক গাজী জানায়, সে পেশাদার রিকশাচালক না। সে এর আগে সিনিয়র বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেছে। সুনামের সাথে কাজ করেছে টু স্টার মানের হোটেল-রিসোর্টে। শান্তিনগর হোয়াইট হাউস, গাজীপুরের এক্সিলেন্টসহ বিভিন্ন হোটেলে হেড বাবুর্চির কাজ করেছে। সর্বশেষ কর্মরত ছিলো ফার্মগেট শুকতারা হোটেলে। বেতন পেতো ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকার মত। গত বছরের এপ্রিল থেকে মালিক অর্ধেক বেতন দিতে থাকে। সংসারে শুরু হয় অভাব-অনটন।
বারেক গাজী বলে, দুই বছর ভালবাইস্যা যে মালিয়াকে বিয়ে করলাম সেও কেমন যেন বাজে ব্যবহার করা শুরু করলো। এ বছরের ৫ জানুয়ারি আমার চাকরিটা চলেই গেলো। গত বছরে এ অভাবের মাঝেও দুবার আমার স্ক্রোটাম অপারেশন হয়েছে। মালিয়াকে বললাম, নিরাশ হইওনা বউ। আমি রিকশা চালিয়ে সংসার টেনে নেবো। তিন বছরের একটি ছেলে আছে আমার। চাকরি যাওয়ার সাত দিন পর রাতে রিকশা চালিয়ে বাসায় ফিরে দেখি আমার ছেলে একা একা কাঁদছে। মালিয়াকে ফোন দিয়ে কোথায় আছো জানতে চাইলে আমারে যা ইচ্ছে তাই বলে বকতে থাকলো। বললো ‘তুই আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবি না। আমি যেহানে আছি অনেক ভালা আছি, তোর মত ফক্কিনীর ঘর করতাম না।’
অপারেশনের পরও অভাবের তাড়নায় রিকশা চালিয়েছি। তারপরও বউটা থাকলো না। লকডাউন শুধু আমার চাকরিরই নয়, আমার পুরো জীবনটাই এলোমেলো করে দিয়েছে। বারেক আরো বলে, স্যার, পারলে আমারে একটা চাকরি দেন। রিকশা চালাতে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি আমার ছেলেটাকে মা ও বাবার ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করতে চাই।
বারেক গাজীর সাথে আলাপকালে সে জানায়, তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নে। থাকে রাজধানীর মুগদা এলাকায়। শ্বশুরবাড়ি বরিশালের ভাসানচর এলাকায়।
এদিকে এক পরিসংখ্যান দেখা গেছে, দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীতে প্রায় ২ কোটি মানুষ বসবাস করে, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা। কিন্তু গত মার্চে দেশে করোনাভাইরাস হানা দেয়ার পর খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনায় ৩৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। তিন শতাংশের চাকরি থাকলেও বেতন পান না। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন তাদের ৬২ শতাংশই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। সেই সঙ্গে ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ শতাংশ।
বিবার্তা/আরকে/বিআর
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]