
বৈষম্যমুক্ত, স্বনির্ভর, গণতান্ত্রিক, ন্যায় ও সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারে মঙ্গলবার দেশব্যাপী উদযাপিত হলো ৫৫তম মহান বিজয় দিবস। ঢাকাসহ গোটা দেশে নানা কর্মসূচিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে জনআকাঙ্ক্ষার উন্নত-সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত হয় কোটি কণ্ঠে।
এদিন গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিনম্র চিত্তে স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় শহীদ বীর সেনানীদের স্মরণ করে গোটা জাতি। লাখো শহীদের প্রতি প্রাণের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের সঙ্গে সঙ্গে বিজয় উৎসবে মেতে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে হারানো স্বজনের জন্য কাঁদে স্বজন। প্রতিটি আয়োজনে সমবেত লাখো মানুষের কণ্ঠে প্রত্যাশিত রাষ্ট্র সংস্কার এবং দুর্নীতি ও নির্যাতন-নিপীড়নমুক্ত দেশ গঠনের দাবি উচ্চারিত হয়।
দিনটি ছিল সরকারি ছুটি। রাজধানীর তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর এলাকায় প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনের কর্মসূচি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি-বেসরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ভবন শীর্ষে উত্তোলিত হয় লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। সব রকমের যানবাহনেও শোভা পেয়েছে ছোট ছোট পতাকা।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের ঢল নামে। সকাল থেকেই হাতে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে রংবেরঙের ফুল আর ব্যানারসহ জাতীয় স্মৃতিসৌধে আসেন তারা। মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হন মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদরা।
দিনের শুরুতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি আলাদাভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে রাষ্ট্রপতি এবং সকাল ৬টা ৫৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
পুষ্পস্তবক অর্পণের পর তারা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। তিন বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল সশস্ত্র সালাম জানায়। পরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা স্মৃতিসৌধে সংরক্ষিত দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
এর কিছুক্ষণ পর স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যরা এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরা। তিন বাহিনী প্রধান এবং বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমের নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের সদস্যরাও স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তথ্য ও সম্প্রচার; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করবে। এটি গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করবে এবং সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহির আওতায় আনবে। বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার যে স্বপ্ন এখনও পূর্ণতা পায়নি, সেই লক্ষ্য অর্জনের যাত্রা এখান থেকেই শুরু করা সম্ভব হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। এ সময় বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় গোটা স্মৃতিসৌধ এলাকা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ভিড় বাড়তে শুরু করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবং ব্যক্তির শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে স্মৃতিসৌধের বেদি ফুলে ফুলে ভরে ওঠে।
সকালে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানসহ দলের নেতারা।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মির্জা আব্বাস বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান যার যার অবস্থানে স্বমহিমায় বিরাজমান। একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশের কোনো তুলনা চলে না। স্বাধীনতাবিরোধীরা নানা কৌশলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা চায় দেশে অশান্ত পরিবেশ তৈরি হোক এবং দেশ বিপাকে পড়ুক। গোলাম আযম ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে সূর্যসন্তান আখ্যা দিয়ে জামায়াত মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত অপমান করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলটির নেতাকর্মীরা স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে নাহিদ ইসলাম বলেন, পতিত ও ফ্যাসিস্ট শক্তি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে। দেশ এমন পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, সরকার ও পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জুলাইযোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিশ্চিত করতে হবে।
দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, স্বাধীনতা যার জন্য, সেই মর্যাদা এখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি। এ দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। ভালো নির্বাচন হয়নি বলেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস সরকারের যে কর্মকাণ্ড, যাদের নিয়ে তিনি ওঠেন-বসেন, তারাই বাংলাদেশ নয়। তারা দেশের হয়তো ২৫ ভাগও নয়।
তিনি বলেন, সার্বিকভাবে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে আমরা অবশ্যই নির্বাচন করব। কিন্তু কোনো পাতানো নির্বাচনে আমরা যাব না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও কেউ কেউ বিজয়কে পরাজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তার গৌরবকে ছোট করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের পরাজয়ের গ্লানিও তারা এখনও ভুলতে পারেনি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যাদের আমরা ক্ষমতায় বসিয়েছি, বাস্তবে তারাও মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করতে পারেনি।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে আরও শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, এলডিপি, গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বাসদ (মার্কসবাদী), জাকের পার্টি, এবি পার্টি, লেবার পার্টি, ন্যাপ-ভাসানী, জাগপা, এনপিপি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, পিপলস পার্টিসহ এসব দলের অঙ্গ সহযোগী সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ সারাদেশের মসজিদগুলোতে দেশ ও জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ অন্য উপাসনালয়ে অনুরূপ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়।
বিকেলে বঙ্গভবনে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন রাষ্ট্রপতি। সকালে তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী পৃথকভাবে ফ্লাই পাস্ট, প্যারাজাম্প ও বিশেষ অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে একটি বিশেষ বিজয় দিবস ব্যান্ড শো অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্লাই পাস্ট ও প্যারাজাম্প প্রত্যক্ষ করেন।
এ সময় দেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘টিম বাংলাদেশ’-এর ৫৪ প্যারাট্রুপার জাতীয় পতাকা বহন করে স্কাইডাইভ প্রদর্শনী হয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পতাকা-প্যারাশুটিং প্রদর্শনী, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নতুন সংযোজন হিসেবে স্বীকৃতির প্রত্যাশা করছে।
বিকেল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয় দিবসের গান পরিবেশিত হয়। একই সঙ্গে দেশের ৬৪টি জেলায় নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান পরিবেশন করেন।
শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
এ ছাড়া নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। এসব জাহাজ চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা, পায়রা বন্দরসহ ঢাকার সদরঘাট, পাগলা ও বরিশালের বিআইডব্লিউটিসি ঘাটে নোঙর করে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে। জামায়াতে ইসলামী সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুব ম্যারাথনের আয়োজন করে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সকালে গুলিস্তানের শহীদ কর্নেল তাহের মিলনায়তনে আলোচনা সভা করে।
বিবার্তা/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]