শিরোনাম
সোনাদীঘির টুঁটি টিপে ধরেছে রাসিক
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০১৭, ১০:৫৭
সোনাদীঘির টুঁটি টিপে ধরেছে রাসিক
রাজশাহী ব্যুরো
প্রিন্ট অ-অ+

রাজশাহী মহানগরীর ঐতিহ্যবাহী সোনাদীঘি ভরাট করে বহুল বিতর্কিত ‘সিটি সেন্টার’ নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দীঘির বেশকিছু অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তার ওপর পাইলিং করে বসানো হয়েছে ২০-২৫টি পিলার। এতে অনেকটাই ছোট হয়ে এসেছে শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ দীঘিটি।


অথচ ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ঘোষণা দিয়েছিলেন তার প্রথম কাজ হবে শহরের প্রাণকেন্দ্রের সোনাদীঘি সংস্কার করে আগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা। সোনাদীঘিকে ঘিরে অত্যাধুনিক কিছু পরিকল্পনা ঘোষণা করে নগরবাসীকে স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি।


ওই সময় রাসিক বলেছিল, সোনাদীঘিকে সংস্কার করে নীল পানির লেকে পরিণত করা হবে। লেকে থাকবে মিনি প্যাডেল বোট। আর দীঘির চারদিকে থাকবে পায়ে চলার পথ। মাঝখানে থাকবে সুদৃশ্য কৃত্রিম আইল্যান্ড। থাকবে ন্যাচারাল পাখির রাজ্য। দীঘিতে শাপলা-পদ্ম ফুল ফোটানোর ব্যবস্থাও থাকবে। তাতে নগরবাসী অন্যরকম সৌন্দর্য্য উপভোগ করবে। এর পাশে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে নির্মাণ হবে ১৬ তলা বিশিষ্ট ‘সিটি সেন্টার’।


এই সিটি সেন্টারের নির্মাণ কাজ এখন চলছে। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন সিটি সেন্টারের জন্য মেরে ফেলা হচ্ছে সোনাদীঘিকে। পাশাপাশি দখল আর দূষণ তো আছেই। এতে দারুণ ক্ষোভ দেখা দিয়েছে নগরবাসীর মধ্যে।


তারা মনে করছেন, সিটি সেন্টার নির্মাণ সোনাদীঘি দখলের একটি কৌশলমাত্র। এজন্য মেয়াদ পার হয়ে গেলেও দীর্ঘদিন ধরে সিটি সেন্টারের নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়নি। এখন সিটি সেন্টারের সম্প্রসারণের নামেই দখল করা হচ্ছে সোনাদীঘি।


শনিবার বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, ১৬তলা সিটি সেন্টারের ১৩তলা পর্যন্ত কাঠামো নির্মাণ হয়েছে। সিটি সেন্টারটি পূর্ব দিকে আরো সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। দীঘির পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের বেশকিছু অংশ ভরাট করে এরই মধ্যে মধ্যে ২০-২৫টি পিলার বসানো হয়েছে। মাটি থেকে প্রায় পাঁচ ফুট পর্যন্ত ওপরে উঠেছে পিলারগুলো। এর ওপর নির্মিত হবে ভবন। পুরো দীঘিতে ময়লা-আবর্জনা ভাসতেও দেখা গেল। এভাবে দখলে-দূষণে প্রাণ হারাতে বসেছে সোনাদীঘি।


দীঘির পশ্চিম দিকে মোগলস বিরিয়ানী নামে একটি রেস্তোরাঁর রান্নাঘর তৈরি করা হয়েছে। এর কিছু অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করা। আর কিছু অংশ পানির ওপরেই বাঁশের কাঠামো দিয়ে তৈরি করা। সোনাদীঘি দখল করে রান্নাঘর কেন, জানতে চাইলে ওই রেস্তোরাঁর মালিক নজরুল ইসলাম সোহানের ভাই মিজানুর রহমান সোহাগ বলেন, শুনেছি পুরো দীঘিটিই ভরাট হবে। তাই ময়লা পড়ে যে অংশটি ভরাট হয়েছে, আমরা সে অংশে রান্নাঘর বসিয়েছি।


স্থানীয়রা জানালেন, রাসিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ বাগমারা আসনের সরকারদলীয় এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের প্রতিষ্ঠান এনা প্রোপার্টিজ সিটি সেন্টারের নির্মাণকাজ করতে গিয়ে প্রথমে সোনাদীঘির পশ্চিম পাড়ের কিছু অংশ কৌশলে ভরাট করে। এরপর তারা সেখানে বাঁশের খুঁটি ও বেড়া দীঘির ভেতরের অংশে বেঁধে বালু ফেলে। তখন দূর থেকে বেড়াটি দেখলে মনে হতো সোনাদীঘিকে রক্ষা করতেই এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন সেই বালুর ওপরেই ভবন নির্মাণের জন্য পাইলিং করে পিলার বসানো হয়েছে।



সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প অনুযায়ী ঐতিহ্যবাহী সোনাদীঘি ও মসজিদকে ঠিক রেখে ১৬ তলা সিটি সেন্টারটি নির্মাণ করার কথা। ভবনটি থেকে সিটি করপোরেশন পাবে মাত্র ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান পাবে ৭৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ সম্পদ। অর্থাৎ ১৬ তলার মধ্যে মাত্র চারটি ফ্লোর পাবে সিটি করপোরেশন। আর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান পাবে ১২টি ফ্লোর। অভিযোগ উঠেছে, সিটি সেন্টারের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এতো বেশি অংশ পাওয়ায় কৌশলে তারাই সোনাদীঘি ভরাট করে ভবনের পরিধি বৃদ্ধি করছে। এতে তারা নিজেরা লাভবান হবে।


তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে এনা প্রোপ্রার্টিজের রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক সারোয়ার জাহান বলেন, ‘আমরা শুধুমাত্র ডেভলপার। আমরা নিজের থেকে দীঘি ভরাট করতে পারি না। রাসিক আমাদের অনুমতি দিয়েছে। আমরা শুধু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছি। দীঘির ওই অংশটিতে সিটি সেন্টারের সাথে সংযুক্ত একটি একতলা ভবন হবে। সেখানে শুধু বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ থাকবে।’


নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রাসিকের নির্দেশনার কথা বলা হলেও রাসিক বলছে অন্য কথা। রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘সোনাদীঘির ওপর ভবন হচ্ছে এটিই জানি না। পুকুর-দীঘি-জলাশয় ভরাটের ক্ষেত্রে দেশে আইন হয়েছে। সে অনুযায়ী দীঘি ভরাট করার কথা না। রাসিকও এমন নির্দেশনা দিতে পারে না। আমার জানামতে তাদের কোনো নির্দেশনাও দেয়া হয়নি। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো। প্রয়োজনে সরেজমিনে গিয়ে ব্যবস্থা নেব।’


এদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) তার আওতাধীন নগরীর ১৬৫টি পুকুর ও জলাশয় সংরক্ষণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। আরডিএর পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত এসব জলাশয় ও পুকুর কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। আরডিএ’র মহাপরিকল্পনায় ১৬৫টি পুকুরকে সংরক্ষণের তালিকায় রেখেছে। এসব পুকুর ভরাট করা হলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে আরডিএ। কিন্তু তালিকায় সোনাদীঘি থাকা সত্ত্বেও এর ভরাটের ক্ষেত্রে নিশ্চুপ এই সংস্থাটি।


বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আরডিএ’র চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ বজলুর রহমান বলেন, ‘সোনাদীঘি ভরাট হচ্ছে কী না তা জানি না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবো। সিটি সেন্টারের কাজটিও একটি সরকারি সংস্থা করছে। সোনাদীঘি ভরাট করলে তারা কীভাবে করছে তা জানতে হবে। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নিব। সোনাদীঘি রক্ষায় প্রয়োজনে রাসিককে নোটিশ করবো।’


দীঘিটি ভরাটে ক্ষোভ জানিয়ে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, ‘সিটি সেন্টার নির্মাণের আগে আমাদের একটি নকশা দেখানো হয়েছিল। ওই নকশায় সোনাদীঘি ঘিরে নানা পরিকল্পনা ছিল। সে নকশা বাদ দিয়ে সোনাদীঘি ভরাট করা হচ্ছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। আমরা জানতে চাই, আগের নকশা গেল কোথায়? সোনাদীঘিকে রক্ষার উদ্যোগ না নেয়া হলে রাজশাহীবাসীকে সাথে নিয়ে আমরা আন্দোলনে নামবো।’


রাজশাহী নাগরিক সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব সেকেন্দার আলী (৬০) বলেন, ‘যখন ছোট ছিলাম, তখন দেখতাম মা-চাচীরা সোনাদীঘির পানি দিয়ে ডাল পাকাতেন। ওই ডাল আমরা খেতাম। তাই সোনাদীঘিকে সংস্কারের মাধ্যমে আগের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। এটি রক্ষার জন্য আমরা কয়েকবার রাসিককে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু সোনাদীঘিটি রক্ষা না করে ভরাটের বিষয়টি খুবই নিকৃষ্টতম কাজ। এ ব্যাপারে রাজশাহীবাসীর প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন।’


এদিকে সোনাদীঘির অপমৃত্যু হলে রাজশাহী শহরের ওপর বিরূপ প্রভাবের কথা বলছেন পরিবেশবিদরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সমন্বয়ক তন্ময় স্যানাল বলেন, ‘শহরের প্রাণকেন্দ্রের এই দীঘিটি পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী। এর মৃত্যু হলে শহরের প্রাণীকূলের ওপর বিরুপ প্রভাব পড়বে। তাছাড়া ওই এলাকাটিই শহরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান জায়গা। সেখানে অগ্নিকাণ্ডের মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে শুধু দমকল বাহিনীর গাড়ির পানিতে আগুন নেভানো সম্ভব হবে না। সোনাদীঘি থাকলে সে পানি আমাদের জানমালের নিরাপত্তাও দেবে।’


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা কমিটির সভাপতি জামাত খান বলেন, ‘সোনাদীঘি আমাদের রাজশাহীর পরিচয় বহন করে। আমরা এর অপমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেব না। রাসিক, ভূমি অফিস, আরডিএ’র নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় সোনাদীঘি ভরাট হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আমরা আন্দোলনে নেমেই তাদের ঘুম ভাঙাবো। আমরা আমাদের ঐতিহ্যের মৃত্যু হতে দেব না।’


সোনাদীঘি ওপর ভবন নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় উপ-পরিচালক মামুনুর রশিদ বলছেন, দেশের চলমান আইনে কোনো জলাশয়ই কেউ ভরাট করতে পারবে না। সোনাদীঘির ভরাটের বিষয়টি তিনি জানতেন না। তাই কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেননি। তবে দু’একদিনের মধ্যে তিনি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।


বিবার্তা/রিমন/জেমি/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com