শিরোনাম
রাজশাহীতে গ্যাস-পানির সংযোগে ক্ষতবিক্ষত সড়ক
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০১৭, ১০:৫১
রাজশাহীতে গ্যাস-পানির সংযোগে ক্ষতবিক্ষত সড়ক
রাজশাহী ব্যুরো
প্রিন্ট অ-অ+

ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছে রাজশাহী মহানগরীর প্রায় সবগুলো সড়ক। এক মাইল পথ পেরোতেই ২০-৩০টি ক্ষত পার হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। কোনো কোনো এলাকায় এ সংখ্যা আরো বেশি। গ্যাস ও পানির সংযোগ স্থাপনে নগরীর অলিগলির এসব সড়ক কেটে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে।


সড়ক কাটার জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) গ্রাহকদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করেছে ঠিকই। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে এসব সড়ক মেরামত করা হয়নি। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। অভিযোগ উঠেছে, গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণের টাকা হরিলুট হয়ে যাওয়ায় এখন সড়কগুলো মেরামত করতে পারছে না রাসিক।


নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব সড়কের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। একটু পর পর সড়ক আড়াআড়ি করে গ্যাস-পানির সংযোগের গর্ত। এসব গর্ত পেরিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। কোথাও কোথাও সড়ক কাটা গর্তগুলো মেরামত করা হলেও নিম্নমানের কাজের কারণে কিছু দিন পরই সেগুলো নিচের দিকে দেবে গিয়ে আবার আড়াআড়ি গর্ত হয়ে গেছে। ফলে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সড়কগুলো। এর ওপর দিয়েই চলছে হাজার হাজার রিকশা-অটোরিকশা। চালকেরা বলছেন, অসাবধানতাবশত একটু অসতর্ক হলেই ঘটছে দুর্ঘটনা।


নগরীর বর্ণালী মোড় থেকে হেতেম খাঁ হয়ে সাহেববাজার, লক্ষ্মীপুর থেকে ভাটাপাড়া হয়ে কোর্ট স্টেশন এবং আলুপট্টি মোড় থেকে বোসপাড়া হয়ে তালাইমারী পর্যন্ত সরু সড়কগুলোর অবস্থা একেবারেই বেহাল। এসব সড়কের এক কিলোমিটার পথ পার হতে অন্তত ২০-৩০টি গ্যাস অথবা পানির সংযোগের ক্ষত পার হতে হচ্ছে। এসব গর্ত কমিয়ে দিয়েছে ব্যস্ত নগরীর যানবাহনগুলোর চাকার গতি। তবু বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে অসংখ্য গর্ত মাড়িয়ে সড়কগুলো দিয়ে চলাচল করছে ছোট বড় নানা ধরনের যানবাহন।


এদিকে নগরীর বর্ণালী মোড় থেকে হেতেমখাঁ হয়ে সাহেববাজার পর্যন্ত সড়কটিরও প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জায়গায় রয়েছে পানি ও গ্যাস সংযোগের কাটা। যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, গত প্রায় দু’বছর ধরে সড়কে এসব গর্ত রয়েছে। বাসাবাড়িতে গ্যাস ও পানির সংযোগ স্থাপনের পর সঠিকভাবে সংস্কার না করে শুধুমাত্র ইটের খোয়া ফেলে রাখায় এসব গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।


নগরীর সাগরপাড়া, ছোট বটতলা, বালিয়াপুকুর ও মঠপুকুর এলাকায় গিয়েও দেখা মিলল একই চিত্র। যত্রতত্র সড়ক খুঁড়ে বাসা বাড়িতে গ্যাস ও পানির সংযোগ স্থাপনের ফলে এ এলাকাগুলোর সড়কের প্রতি কিলোমিটারে অন্তত ২০ থেকে ৩০ স্থানে রয়েছে প্রায় ৫ থেকে ১০ ইঞ্চি বরাবর গর্ত। একই অবস্থা নগরীর কলাবাগান, ফকিরপাড়া, সরকারিপাড়া, হোসনীগঞ্জ, সিপাইপাড়া ও রামচন্দ্রপুরসহ প্রায় সব এলাকার সড়কগুলোর।


স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সড়কগুলো সংস্কারের জন্য তারা স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদেরকে বারবার অনুরোধ করলেও তারা তা আমলে নিচ্ছেন না। ফলে এসব গর্তের ওপর দিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে যানবাহনগুলোকে। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে যানবাহনও।


মঠপুকুর এলাকার বাসিন্দা রেজাউল করিম (৭০) বলেন, ‘সড়ক সংস্কার না হওয়ায় এখন রিকশায় উঠতেই ভয় লাগে। রিকশার চাকা যখন এসব গর্তে পড়ে, তখন মনে হয়- কোমর বুঝি এবার গেল!’ বিনোদপুর এলাকার বাসিন্দা আবদুর রউফ বলেন, ‘সড়ক কাটার জন্য রাসিক ক্ষতিপূরণের টাকা তো ঠিকই নিয়েছে, এখন কাজ হচ্ছে না কেন? টাকা গেল কোথায়? খোঁজ নেয়া দরকার।’


বুধবার সকালে নগরীর সাহেববাজার এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক জুলমত আলীর (৪৫) সঙ্গে। জুলমত বলছিলেন, গর্তের কারণে অনেক সময় আচমকা ঝাঁকুনিতে রিকশা থেকে যাত্রী ছিটকে পড়ে আহত হন। আবার রিকশায় কোনো অসুস্থ রোগী থাকলে তার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে ওঠে। সড়কের গর্ত পার হতে গিয়ে মাঝে মাঝেই রিকশার নাট-বোল্ট ও প্রিং খুলে যাচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে চাকার বিয়ারিংও।


সামাউন আলী (২৫) নামে অপর এক অটোরিকশা চলক বলেন, সড়কের গর্তগুলো পার হতে বার বার ব্রেক করতে হয়। এতে অটোরিকশার চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। বার বার ব্রেক করলে ১২০ কিলোমিটার চলতে সক্ষম একটি অটোরিকশা চলে ৯০ থেকে বড়জোর ১০০ কিলোমিটার। ফলে অনেক সময় তাদের চার্জ খরচ তুলতেই সারাদিন চলে যাচ্ছে। এতে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর গাড়ির তো ক্ষতি হচ্ছেই।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোনো বাসায় গ্যাস বা পানির সংযোগ স্থাপনের আগেই সিটি করপোরেশন থেকে গ্রাহকদের সড়ক কাটার জন্য অনুমতি নিতে হয়। সড়ক মেরামতের জন্য সিটি করপোরেশন গ্রাহকের কাছ থেকে নির্ধারিত টাকা নিয়ে থাকে। রাজশাহী শহরের কার্পেটিং সড়কের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার ১৯০ টাকা, ফুটপাতের জন্য এক হাজার ৯৩৯ টাকা, সিসি রাস্তার জন্য এক হাজার ৮২৪ টাকা, হেরিংবন্ডের (ইটের রাস্তা) জন্য ৯৯০ টাকা এবং কাঁচা রাস্তার জন্য ৯৭ টাকা করে ক্ষতিপূরণ নেয় রাসিক। তারপর গ্যাস ও পানির সংযোগের জন্য রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী রাস্তা খোঁড়ার অনুমতি দেন।


নগরীতে গ্যাস সংযোগের পাইপ বসানোর জন্যও গ্রাহকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েছে রাসিক। আবার সড়ক কেটে পানির সংযোগ স্থাপনেও টাকা নেয় রাসিক। কিন্তু খোঁড়াখুড়ির অনেক দিন পেরিয়ে গেলেও সড়কগুলো সংস্কার করেনি নগর সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। অভিযোগ উঠেছে, সড়ক সংস্কারের টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাওয়ায় এ দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে নগরবাসীকে।


নগরীর মঠপুকুর এলাকার বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম (৪৫) বলেন, গ্যাস সংযোগ বসাতে রাসিকের সড়ক কাটার অনুমতি নিয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল তিনি ক্ষতিপূরণ জমা দিয়েছেন ব্যাংকে। কিন্তু এই অনুমতি পেতে হিসাবের টাকার বাইরেও তাকে আরও ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বাড়ির সামনের সড়কটি মেরামত করা হয়নি।


পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৭ জুন থেকে রাজশাহী মহানগরীতে আবাসিক গ্যাস সংযোগ দেয়া শুরু হয়। গত বছরের মে মাস পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে নগরীর ৯ হাজার ১০৩ জন গ্রাহক তাদের বাড়িতে সংযোগ পান। এসব গ্রাহকদের সবাইকে রাসিককে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে হয়েছে। ক্ষতিপূরণ দেয়ার রশিদের কাগজ না পাওয়া পর্যন্ত একজন গ্রাহককেও সংযোগ দেয়া হয়নি।


পিজিসিএলের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক আ.ফ.ম আজাদ কামাল বলেন, ‘গ্রাহক সড়ক কাটলে রাসিক তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নেয়। মূল লাইনের সম্প্রসারণের সময় তারা আমাদের কাছ থেকেও ক্ষতিপূরণ নেয়। রাস্তা মেরামতের পুরো দায়িত্ব রাসিকের। কেন মেরামত করা হচ্ছে না তা তারাই ভালো বলতে পারবে।’


একই কথা বলছে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশণ কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা)। সংস্থাটির রাজশাহী কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজাহার আলী বলেন, ‘গ্রাহক সড়ক কাটার জন্য রাসিককে ক্ষতিপূরণ না দিলে আমরা তাকে সংযোগই দেই না। মূল লাইনের সঞ্চালনের সময় আমরা নিজেরাও রাসিককে ক্ষতিপূরণ দিই। সামনের মাসেই তারা আমাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের একটা অর্থ পাবে। এতো টাকা পেয়েও কেন রাস্তা মেরামত হয় না তা বলতে পারবো না।’


রাসিকের একটি সূত্র জানিয়েছে, শুধু গ্যাস সংযোগ দেয়ার সময়ই গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে। পানির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ আদায় চলমান রয়েছে। নগরীর কিছু কিছু এলাকায় ঠিকাদারের মাধ্যমে সড়ক সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ঠিকাদারকে এখন পর্যন্ত বিল পরিশোধ করতে পারেনি রাসিক। আবার অনেক জায়গায় দরপত্র আহ্বান করেও টাকার অভাবে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেয়া হয়নি। সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছে রাসিকের ওই সূত্রটি।


তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে রাসিকের উন্নয়ন শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী নূর ইসলাম বলেন, যে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়, সড়ক মেরামতে তার চেয়েও বেশি খরচ হয়। এ জন্য সব জায়গার কাজ শেষ করা যায়নি। এতে নগরবাসীর ভোগান্তির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, সংস্কারের ব্যাপারটি একটি চলমান কাজ। ধীরে ধীরে সব জায়গারই কাজ শেষ করা হবে।


বিবার্তা/রিমন/প্লাবন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com