নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মা ইলিশ শিকার; টাকায় মিলছে অনুমতি
প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:২৯
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মা ইলিশ শিকার; টাকায় মিলছে অনুমতি
পাবনা থেকে পলাশ হোসাইন
প্রিন্ট অ-অ+

ইলিশ প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা ও বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পাবনা বেড়ায় চলছে ইলিশ শিকার। জেলেদের দাবি সরকারি সহযোগিতা না পেয়েই বেঁচে থাকার তাগিদে করছেন ইলিশ শিকার। মৎস অফিস বলছে বেশি বরাদ্দ না থাকায় সব জেলেকে সরকারি প্রণোদনা দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে মাঝে-মধ্যে উপজেলা প্রশাসন মৎস কর্মকর্তা নৌ-পুলিশের যৌথ উদ্যোগে চলছে অভিযান। অভিযানের মধ্যেও টাকায় মিলছে ইলিশ ধরার অনুমতি।


গত ১২ অক্টেবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুদ বাজারজাতকরণ ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করেছে সরকার।



উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, বেড়া উপজেলার দশটি ইউনিয়নের বেড়া পৌরসভা, হাটুরিয়া-নাকালিয়া, মাছখালি, ঘিওর, রাকশা, নগড়বাড়ি এলাকা তালিকাভুক্ত তিন হাজার মৎস্যজীবীর পরিবার রয়েছে। যারা মাছ আহরণ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে উপজেলার কয়েকটি মৎস্যজীবী সমিতির তথ্য হিসাব অনুযায়ী জেলে পরিবারের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। তাদের বিকল্প কোন আয়ের উৎস নেই। প্রজনন মৌসুমে ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে এসময় মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।



এ বছর বেড়া উপজেলার তিন হাজার জেলের মধ্যে সাড়ে সাতশ জেলে পরিবারকে প্রনোদনা হিসেবে ২৫ কেজি করে চাউল দেয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ১৩ দিনে ৩০ জন জেলেকে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে প্রায় এক লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ৯টি নিয়মিত মামলা হয়েছে।


সরেজমিন অনুসন্ধানে কাজিরহাট কাজিশরিফপুর গিয়ে দেখা যায়, বেইলি ব্রিজের দুই পাশে দাঁড়িয়ে কিছু লোকজন পথযাত্রীদের ডেকে বলছেন- ভাই মাছ লাগবে না কি-না? অনেকেই তাদের সাথে গিয়ে জেলেদের বাড়ি থেকে দরদাম করে মাছ কিনে আনছে। অথচ ৫০০ মিটার দূরে রয়েছে কাজিরহাট নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। জেলে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, কাজিরহাট নৌ-পুলিশ সদস্যদের নৌকাপ্রতি প্রতিরাতের জন্য একহাজার করে উৎকোচ দিয়ে নদীতে মাছ ধরার অনুমতি নিচ্ছেন।



এছাড়াও একটি দালালচক্রের সাথে সমন্বয় না করলে জেলেদের নদীতে মাছ ধরার অনুমতি মিলে না। আবার যে সকল জেলেরা নৌ-পুলিশের অগোচরে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন- তাদেরকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছেন বলে জানা যায়।



ইলিশ ক্রেতা হিসেবে এ প্রতিবেদক কাজিশরিফপুর গ্রামে গেলে দেখা যায় পুরো গ্রামটিই যেন ইলিশ বিক্রির হাট। গ্রামটি যমুনা নদীর কিনারে হওয়ায় জেলেরা নদী থেকে মাছ শিকার করে সরাসরি এই গ্রামেই প্রবেশ করে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে সকালে ও বিকেলে বিক্রি হয় মনকে মন ইলিশ মাছ।


কাজিরহাট কাজিশরিফপুর নটাখোলা ঘাট ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশটি ইলিশ ধরা নৌকা জালসহ ঘাটে ভেড়ানো রয়েছে। এ যেন উৎসবমুখর পরিবেশে শিকার হচ্ছে মা ইলিশ। ৭শত থেকে ৯শ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯শত টাকা ও ছোট সাইজের ইলিশ সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১২শ থেকে ১৪ শ টাকা দরে।


নগরবাড়ি রঘুনাথপুর মৎস্যজীবী সমিতির মো. আব্দুল মালেক বিবার্তাকে জানান, আমার ইউনিয়নের সমিতির তালিকাভুক্ত জেলে আছে চারশতের মতো। এর মধ্যে সরকারি অনুদান হিসেবে প্রায় একশজনের মতো ২৫ কেজি করে চাউল পেয়েছে। এই চাউলে কয়দিন খাবে একটি পরিবার? শুধু অভিযান পরিচালনা করেই ইলিশ ধরা বন্ধ করা যাবে না। বরং ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকালে উপজেলার সকল জেলেদেরকে সরকারি সহায়তার আওতায় আনা হলে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা অনেক কমানো যাবে। মৌসুম শুরুর আগেই বেশিরভাগ জেলে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জাল কেনে। কিন্তু এই সময়ে আয় না থাকলেও তাদের কিস্তির টাকা শোধ করতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই নদীতে নামে।


টাকার বিনিময়ে ইলিশ ধরার অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে কাজিরহাট নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মাহিদুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বিবার্তাকে জানান, আমার নৌ-পুলিশের কোন কর্মকর্তা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়। মা ইলিশ রক্ষার্থে দিনরাত আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি।


বেড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো নাছির উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তার প্রতিদিনই আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার তের দিনে ৩৫ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে, যার বাজার মূল্য সাড়ে চার লক্ষ টাকা। সেগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। নগরবাড়ি ও কাজিরহাট নৌ পুলিশের সহযোগিতায় নয়জনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়েছে। আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা এসব জেলের জন্য সরকারি সহায়তা চেয়ে বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখে চলেছি।


উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোরশেদুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের শুরু থেকেই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে ইলিশ একটু বেশি ধরা পরছে- একারণে আমাদের অভিযান আরও জোড়ালো ভাবে পরিচালনা করা হবে। নৌ পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান এ বিষয়ে কোন তথ্য প্রমাণ পেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করা হবে।


বিবার্তা/পলাশ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com