‘বছর ঘুরে ফিরে এলো বড়দিন, অনন্ত খুশি আর মিলনের দিন’।
২৫ ডিসেম্বর শুভ বড়দিন। সারাবিশ্বের খ্রিস্টবিশ্বাসী ভাই-বোনেরা এই দিনকে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন বা বড়দিন হিসাবে উদযাপন করে থাকে। এই দিন সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ঈশ্বর ত্রি-ব্যক্তি পরমেশ্বর তাঁর দ্বিতীয় ব্যক্তি এবং পুত্র যিশুর মধ্য দিয়ে মানবদেহ ধারণ করেছেন বলেই খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস।
যেদিনটিতে সৃষ্টিকর্তা নিজেই মানুষরূপে এ পৃথিবীতে এসেছেন সেদিনটি কোনো সাধারণ ছোট দিন হতে পারে না। তাই এদিনটি বড়দিন।
বিশ্বায়নে নিত্যনতুন আবিষ্কারের ঘনঘটার মাঝে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বড়দিন মানুষের মিলন ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বহু দিনের প্রতীক্ষার পর বড়দিনে খ্রিস্টের মানবদেহ ধারণে পূর্ণতা পেল। তাঁর দেহধারণ উৎসব রূপান্তরিত হয়েছে মানুষের মিলন উৎসবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে বড়দিন উদযাপনের কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ ছিল না। মঙ্গলসমাচার রচয়িতাগণ যিশু খিস্টের জন্মের কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখও উল্লেখ করেননি। ঐতিহাসিকভাবেও কোনো দিন-তারিখ পাওয়া যায় না। তবে যিশু খ্রিস্ট যে মানবদেহ নিয়ে পৃথিবীতে জন্মেছেন, সেটা চিরন্তন সত্য। খ্রিস্টের জন্ম তারিখের উপর নির্ভর করে বড়দিনের গুরুত্ব বহন করে না, বরং দিনটির তাৎপর্যের ভিত্তিতে বড় হয়েছে।
এই দিনটি খ্রিস্টমণ্ডলীর জন্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মণ্ডলী এই খ্রিস্টেরই দেহ. . . তিনি তো দেহের, অর্থাৎ মণ্ডলীর মাথা (কলসীয় ১: ১৮), . . . তাঁর দেহের জন্য, যে দেহ স্বয়ং মণ্ডলী (২৪), যে মণ্ডলী তাঁর দেহ, তাঁরই (খ্রিস্টের) পরিপূর্ণতা যিনি সবকিছুতে সম্পূর্ণরূপে পরিপূর্ণ (এফেসীয় ১: ২৩)।
‘দেখ কুমারী কন্যাটি হবে গর্ভবর্তী ...’। যিশু খ্রিস্টের দেহধারণের ফলে ঈশ্বরের সকল প্রতিশ্রুতি পূর্ণতা পেল। ঈশ্বর যে প্রতিশ্রুতি আব্রাহামের কাছে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রবক্তার মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন, সেই একই প্রতিশ্রুতি খ্রিস্ট যিশুর মাধ্যমে পূর্ণ হল। তিনি মানবদেহধারী শাশ্বত ঐশীবাণীর মাধ্যমে প্রত্যাশা ও ঈশ্বরের ভালোবাসার এক মহা-মিলন। এই মিলন ঈশ্বর ও মানুষের সাথে পারস্পারিক মিলনেই পূর্ণতা লাভ করে, যার ফলে স্বর্গীয় পিতার সন্তানরূপে সকল মানুষ নিজেদের একটি পরিবাররূপে গণ্য করতে পারে। তাই বড়দিনে খ্রিস্টবিশ্বাসীরা সকল প্রকার ভেদাভেদ ভুলে খ্রিস্টের সাথে এক হয়। আনন্দোৎসব করে।
বড়দিনে খ্রিস্টের দেহধারণ করেছেন তা আমরা অনুভব পারি করতে হৃদয়ে। ঈশ্বর ও মানুষের এই যে মিলন ও মানব জীবনের নতুন আশা তা কোন নতুন ঘটনা নয়। বড়দিন বাস্তব, সত্য ও অর্থপূর্ণ একটি ঘটনা। তিনি এখনও প্রতিনিয়ত আমাদের অন্তরে, হৃদয় গোশালায় জন্ম নিতে চান। মিলন ভ্রাতৃত্বের জীবনযাপন করতে প্রেরণা যুগিয়ে থাকেন।
খ্রিস্টের দেহধারণের ২০১৬ টি বছর অতিক্রম করতে চলছি, কিন্তু আজও মানুষ তাঁর প্রেমের ও মিলনের বাণী পূর্ণভাবে শুনতে পায়নি। যে বিশ্বাস, ভালোবাসা, মুক্তি, আশা ও মিলনের বাণী নিয়ে খ্রিস্ট পৃথিবীতে এসেছিলেন, বর্তমান পৃথিবী সেই একই ভালোবাসা ও মুক্তির প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে। কিসের যেন এক শূন্যতা বিরাজ করছে। মানুষ আজ বড় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে জাগতিকতার মোহে। স্বার্থপরতার বেড়াজালে একজাতি-অন্য জাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরছে। ভালোবাসার অভাবে আমাদের খ্রিস্টীয় পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। দিনদিন যুব সমাজ অবক্ষয় ও অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে।
ঈশ্বর সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা, প্রভু ও অধিকর্তা হয়েও ক্ষমতার দাপট দেখান না, তিনি কোমলপ্রাণ ও দয়ালু। তিনি মানুষের উপর কর্তৃত্ব করেন না, বলপ্রয়োগ করেন না। মানুষের কাছে তার সার্বক্ষণিক আহ্বান হলো ভালোবাসা ও মিলনের পথে। তাই মানুষের কাছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ আদেশ হচ্ছে, ‘সমস্ত মনপ্রাণ শক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ভালোবাসা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মতোই ভালোবাস'।
আজকাল দুনিয়াতে কিন্তু আমার এই ভালোবাসার চরম অভাব দেখতে পাই। সমাজে আমরা দেখতে পাই ক্ষমতার দাপট, দরিদ্রদের উপর শোষণ-নির্যাতন। ভোগলিপ্সু বিত্তবান মানুষ অপরকে বঞ্চিত করে ক্রমাগত আরও বিত্তবান হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ছলেবলে কৌশলে তারা দীনদরিদ্রদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। তারা নিজেদেরকে পরাশক্তি ভাবতে ও অনুরূপ আচরণ করতে পছন্দ করে। সরলতা, ক্ষমা, নম্রতাকে তারা দুর্বলতা মনে করে। এ ধরনের লোকদের কাছে বড়দিনের অর্থ অবশ্যই ভিন্নতর হবে।
বড়দিন হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে অন্তরাত্মায় বড় হওয়ার দিন। এ দিন মানুষের সাথে মিলনের দিন, ক্ষমা করার দিন, নম্র হওয়ার দিন। এদিনে ভক্তমানুষ বুঝতে পারে, তার নিজের মধ্যে গর্ব করার মতো অর্জন কিছুই নেই, তার যা আছে বা সে যা-কিছু হয়েছে তার সবটাই অনুগ্রহ।
‘বাণী একদিন হলেন রক্তমাংসের মানুষ; বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে। আর আমরা তাঁর মহিমা প্রত্যক্ষ করলাম, একমাত্র পুত্র হিসাবে পিতার কাছ থেকে পাওয়া সেই যে-মহিমা, ঐশ অনুগ্রহ ও সত্যের সেই যে-পূর্ণতা। ... সত্যিই তো আমরা সকলে তাঁর সেই পূর্ণতা থেকে লাভবান হয়েছি, লাভ করেছি অনুগ্রহ আর অনুগ্রহ’ (যোহন ১:১৪,১৬)।
বড়দিন শুধু আধ্যাত্মিক অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা নয়, বরং বর্তমান বাস্তবতায় তা চলমান। বড়দিন হচ্ছে উৎসব ও আনন্দ করার দিন। পুরাতন যত ব্যথা-বেদনা, হতাশা-নিরাশা, জরা-জীর্ণতা ভুলে নতুনভাবে মিলন ও শান্তির উৎসব করার দিন। ঈশ্বর ও মানুষের মিলন উৎসবের দিন, সৃষ্টি-কৃষ্টি-ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতায় পুনর্মিলিত হবার দিন। এদিন স্বর্গীয় সম্পদে, মনুষ্যত্বের মহিমায়, মিলন ও ভ্রাতৃত্বের সুষমায়, অন্তরাত্মায় বড় হওয়ার দিন। বড়দিন নিজেকে ভুলে গিয়ে সবার সাথে মিলনের দিন।
বিবার্তা/হুমায়ুন/উজ্জ্বল
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]