ঢামেকে ডেঙ্গু রোগীদের বেহাল দশা, চলছে সিট বাণিজ্যও
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৩, ২১:৫২
ঢামেকে ডেঙ্গু রোগীদের বেহাল দশা, চলছে সিট বাণিজ্যও
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে সামনে হাঁটা-চলার জন্য যে ফাঁকা জায়গা থাকে, সেখানে চলছে তাদের চিকিৎসা। তা-ও আবার গাদাগাদি করে। এখানে কারো হাতে স্যালাইন দেওয়া, কেউ ওষুধ খাচ্ছেন, আবার কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করছেন! কিন্তু অতিষ্ঠ গরমে তাদের ঘুম আসবে কী করে? ফলে রোগীর আপনজনরা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছেন। এদিকে কেউবা ক্লান্ত হয়ে জায়গা না পেয়ে সিঁড়িতে শুয়ে পড়ছেন। এটাই এখন এখানকার দৃশ্য। তবে এই দৃশ্য কষ্টের, এই দৃশ্য হতাশার। আর এতে ভুক্তভোগী হচ্ছেন ডেঙ্গু রোগী ও তাদের স্বজনরা। তাদের অভিযোগ এখানে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে এসে তারা নানা ধরণের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এখানে সিট বাণিজ্যও চলছে রমরমা। ফলে হাসপাতালটিতে অসহায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই!



বলছি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কথা। দেশের সরকারি পর্যায়ের সবচেয়ে বড় এই মেডিকেলে এখন ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগীরা চিকিৎসা নিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। হাসপাতালটির নতুন ভবনের ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ৬০১, ৬০২,৭০১, ৭০২, ৮০১, ৮০২ নম্বর ওয়ার্ড পরিদর্শন করে এই দৃশ্য দেখা যায়। এদিকে এসব ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের পাশাপাশি সাধারণ রোগীরাও চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিছানার পাশাপাশি তাদের রাখা হয়েছে ফ্লোরসহ লিফটের আশপাশে।




৬০১ ও ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝখানে থাকা ফাঁকা জায়গায় লিফটের পাশে অবস্থান নিয়ে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন কামরুল ইসলাম। তিনি ঢাকার কেরাণীগঞ্জ থেকে এসেছেন। তার সাথে রয়েছে স্ত্রী ও এক সন্তান। এই রোগীর ছেলে আরিফুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, বাবার ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো দেখা দেওয়ায় সুচিকিৎসার জন্য গত ৯ তারখে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। পরে এখানে এসে টেস্ট করার পর জানতে পারি বাবার ডেঙ্গু হয়েছে। এরপর চিকিৎসার জন্য ভর্তি করাই। কিন্তু প্রায় ৫ দিন হয়ে গেলেও এখনো বাবার জন্য একটা সিট ম্যানেজ করতে পারিনি। আমি ও আমার মা এখানে কিভাবে আছি, তা বলে বোঝাতে পারবো না। আমরা নিজেরা অসুস্থ হয়ে যায় কি না, সেটা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।


অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন, আমাদের পরে এসে অনেকে দেখতেছি আনসারদের সাথে কথা বলে কিভাবে যেন সিট ম্যানেজ করে ফেলেছেন। আর আমাদের শুধু আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে -অপেক্ষা করেন- সিট পাবেন, চাপ বেশিসহ আরও নানা কথা। তবে এখন আমি এটা বুঝতে পারছি টাকা দিতে পারলে আমরাও সিট পেতাম।



৬০১ নম্বর ওয়ার্ডের এক সিটে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে আছেন গফুর মিয়া। বয়স্ক এই লোকের পাশে বসে আছেন তার ছোট ছেলে মো. আনিসুর রহমান। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ৬ দিন ফ্লোরে থাকার পর অনেক কষ্টে এই সিট ম্যানেজ করেছি।


কিভাবে ম্যানেজ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক আনসার সদস্য তাকে কিছু অর্থের বিনিময়ে এটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওই আনসার সদস্যের নাম ও মোবাইল নাম্বার দেওয়ার অনুরোধ করলে তিনি তাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।


হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে জানতে চাইলে আনিসুর বলেন, হাসপাতাল থেকে স্যালাইন ও কিছু ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। বাকী সব ওষুধ বাহির থেকে আনতে হচ্ছে।



৭০১ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা মো. মামুন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমি ডেঙ্গু রোগী নই। আমার অন্য রোগ হলেও আমাকেও ডেঙ্গু রোগীদের সাথে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। ফলে না ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ভালো হচ্ছে, না আমাদের। অথচ আলাদা আলাদা ইউনিট করলে সবার জন্য ভালো হত।



সরেজমিনে দেখা যায়, ডেঙ্গুর ইউনিটগুলোর দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এতে লেখা আছে, 'সকল কাজে স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা করুন। আর আপনার বেডের আশপাশে পরিষ্কার রাখুন।'



রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, এসব পরিষ্কারের বিষয় শুধু লেখাতেই সীমাবদ্ধ। রোগীরা ঝুঁড়িতে ময়লা রাখলেও অনেক সময় দায়িত্বরতরা এগুলো নিয়ে যান না। ফলে এখানে মশা-মাছি ভোঁ ভোঁ করে। তাদের এসব অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়।


৬০১ ইউনিটের ৯ নম্বর রুমের পাশে ওয়াশরুমের সামনে ময়লার বিনগুলো অনেক দিন পরিষ্কার না করায় এখান থেকে গন্ধ বের হচ্ছে, আর মশা-মাছিও উড়ছে৷ ফলে এই ওয়াশরুমে যারা আসছেন তাদের কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে দেখা যায়।


এই বিষয়ে অবগত করে জানতে চাইলে এই ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা মফিজুল হায়দার বিবার্তাকে বলেন, যার এই কাজ করার কথা, সে গত দুইদিন না আসায় এই সমস্যা হয়েছে। তবে এটাকে আজই পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।


এই ওয়ার্ডে কতজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৬০১ ওয়ার্ডের ৬০৯ ও ৬১০ রুমকে আলাদা করা হয়েছে শুধুমাত্র ডেঙ্গু রোগীর জন্য। এই ইউনিটে আজ ১৩ জন ভর্তি হয়েছে। এছাড়া ৮ জনকে আজ রিলিজ দেওয়া হয়েছে। এই ইউনিটের দুই রুম ছাড়া অন্যান্য ইউনিটগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ও অন্যান্য রোগীদের একসাথে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।


ঢামেকের তথ্যকেন্দ্র জানায়, শুক্রবার, ১৪ জুলাই প্রায় ৫০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন তার আগের দিনের চেয়ে রোগী বেড়েই চলেছে। এখানে এখন আগত রোগীর ৫০ শতাংশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বলে জানায় তারা।



ডেঙ্গু আক্রান্তদের রোগের ধরণ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাইমিন ফেরদৌস বিবার্তাকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের একটা বড় অংশের গল্প অনেকটা একই রকম। শুরুতে জ্বর, ব্যথা কিংবা পাতলা পায়খানা। ফার্মেসি থেকে মেডিসিন নেওয়া এবং অবস্থা খারাপ হলে পরীক্ষা করতে গিয়ে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর তারা হাসপাতালে এসে ভর্তি হন।


তিনি বলেন, ঢামেকে প্রতিদিন যে হারে রোগী আসছে তা হাসপাতালটির ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে রোগীরাও সিট না পেয়ে এখানে সেখানে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এদিকে আমরাও তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। তবে একটা আক্ষেপের বিষয়, রোগীদের মশারি টাঙিয়ে রাখার কথা বলা হলেও তারা তা মানতে চান না। আবার এটাও ঠিক যারা এখানে সেখানে গাদাগাদি করে আছেন, তারা মশারি টাঙাবেন কিভাবে? এরপরেও যারা সিটে আছেন তাদের মশার টাঙানোসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ আমার।



ঢামেকে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ও চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. নাজমুল হক বিবার্তাকে বলেন, দিনকে দিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে আমরাও তাদের চিকিৎসা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। হাসপাতাল থেকে ওষুধপত্র দেয়া হচ্ছে।


সিট বাণিজ্যসহ রোগীদের ভোগান্তির বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই রকম অভিযোগ আগেও ছিল। আর এখনও আছে। তবে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যারা টাকা দিয়ে সিট নেয় তাদের বলবেন তারা যেন জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্তার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে এসে অভিযোগ দেয়। তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।


ঢামেক পরিচালক আরো বলেন, টাকা দিয়ে সিট নেয়ার বিষয়ে অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করেনি। এছাড়া হাসপাতালে বিভিন্ন দেয়ালে দালাল থেকে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেয়া আছে। আমি আশা করব, সবাই নির্দেশনা মেনে দালাল থেকে দূরে থাকবেন।


বিবার্তা/রাসেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com