‘৭ই মার্চের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি স্বাধীনতার মহাকাব্য'
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩, ১১:২৬
‘৭ই মার্চের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি স্বাধীনতার মহাকাব্য'
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’


লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে এই কথাগুলো ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ইতিহাস ‍সৃষ্টিকারী কালজয়ী এই কথাগুলো বলেন। ফলে ৭ মার্চ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন। এই দিনে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের মূলমন্ত্রে পরিণত হয়।



দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার সাথে ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছেন। ফলে এই ভাষণের কৌশলগত অবস্থান পরবর্তীতে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছে। তাই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু একটি ভাষণ নয়, বরং এটি স্বাধীনতার মহাকাব্য। আর এ মহাকাব্য লিখেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যা যুগ যুগ ধরে জাতিকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।



ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, ৭ মার্চ ঐতিহাসিক দিবস। এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে অবিস্মরণীয় এক ভাষণ দিয়েছেন। কার্যত সেটি ছিল আমাদের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একদিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছেন অন্যদিকে জাতির ভবিষ্যত করণীয় নিয়েও দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এই ভাষণের ১৮ দিন পর আনুষ্ঠানিক বা আইনগত স্বাধীনতা করা হয়েছে। মূলত ৭ মার্চের ভাষণ ছিল জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত করার অনুপ্রেরণা।


তিনি বলেন, এই ভাষণ দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর হাতে কোন কাগজের টুকরো ছিল না। তবুও এর প্রতিটি শব্দ ও বাক্য যথার্থভাবে প্রয়োগ হয়েছে। তাই বলা যায়, এটি শুধু একটি ভাষণ নয়, বরং এটি স্বাধীনতার মহাকাব্য। তাছাড়া এই ভাষণকে জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর কথোপকথনও বলতে পারি। কারণ, তখন এই দেশের ১০ লক্ষ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ছিল। সেই প্রশ্নগুলোর নিখুঁত উপস্থাপন ছিল এই ভাষণে অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা ছিল এই ভাষণ।


তিনি আরো বলেন,এই ভাষণ সময়ের সীমারেখায় আবদ্ধ নয়, বরং সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ভাষণ শুনছেন আর ভবিষ্যতেও শুনবেন। কারণ, এই ভাষণে নানা সংকটের সমাধান দেওয়া হয়েছে। তাই এই ভাষণ যুগ যুগ ধরে জাতির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। ইতোমধ্যে এই ভাষণ
বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি হেরিটেজের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।


৭ ই মার্চের ভাষণ নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, ৭ ই মার্চ আমাদের জাতি রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রস্তুতির অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রাক্কালে একটি প্রস্তুতির আহ্বান ছিল। আমাদের সর্বাত্মক লড়াই অর্থাৎ মুক্ত প্রতিষ্ঠার যে লড়াই যেটি বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে তার দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে করেছেন। আর এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যখন আস্থার জায়গায় পৌঁছেছেন, গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন, সত্তরের নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন সেই পরিপ্রেক্ষিত সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জাতিকে মূলত সর্বাত্মক প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন। এক্ষেত্রে
তিনি ৭ মার্চের ভাষণে ছিলেন অত্যন্ত কৌশলী।


তিনি বলেন, একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদ এবং রাষ্টবিজ্ঞানীদের যে অভিমত সেই সমস্ত বিষয়কে বঙ্গবন্ধু একত্রিত করেছেন এই কারণে, অনেকের প্রত্যাশা ছিল ৭ মার্চের ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা আসুক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন যে ৭ মার্চে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপ নিতে পারতো। ফলে সেই জায়গায় বিচ্ছিন্নবাদী না হয়ে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র সৃষ্টির বিপ্লবটাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং তিনি সেইদিনে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণায় না গিয়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতিতে যাওয়ার দুটো দিক তুলে ধরেছেন। একটা হলো- তিনি বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলনের নেতা হননি। অন্যটি হলো সেই দিন ব্যাপক ধ্বংসত্মক কার্যক্রম হয়তোবা পশ্চিম পাকিস্তানিরা করতে পারতো। সেটিকেও তিনি এড়িয়েছেন। মূলত বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন যে, নিরপরাধ, নিরীহ বাঙালির উপর যাতে রক্তাক্ত হামলা না হোক কিন্তু রাষ্ট্র সৃষ্টির বিপ্লব এগিয়ে যাক।


ড. মশিউর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে, দ্রুততার সাথে একটি ভাষণ দিয়েছেন। ফলে এর মধ্য দিয়ে তাঁর যে রাজনৈতিক দক্ষতা, প্রজ্ঞার পরিচয় যেমন হয়েছে তেমনি এর মাধ্যমে বিশ্বজনমতও বাংলাদেশের পক্ষে তৈরি হয়েছে। ৭ মার্চের কৌশলগত অবস্থান পরবর্তীতে সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী না হওয়া এবং সর্বাত্মক প্রস্তুতি এই দুটি জিনিস করে বঙ্গবন্ধু কৌশল গ্রহণ করেছেন। যে সময়কে তিনি নিয়েছেন তারপর থেকে তাঁর নির্দেশে বাংলাদেশ চলেছে। আর এর মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চ তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। তিনি হয়তো জানতেন যে তাকে কারারুদ্ধ করা হবে, এমনকি পাকিস্তানীদের হত্যা পরিকল্পনায়ও তিনি ছিলেন।


৭ ই মার্চের ভাষণের সাথে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সংযোগ রয়েছে জানিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন,১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা মূলত ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিশোধের সংযোগ বলে আমি অন্তত দেখতে পাই। এটা এই কারণে যে, বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নেওয়ার পর থেকে তারা হত্যার পরিকল্পনা করছিল কিন্তু তার যে জনমত বিশেষ করে ৭ ই মার্চের ভাষণে তার যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে সেই কারণে তাকে হত্যার সাহস পশ্চিম পাকিস্তানিরা পায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের দোসররা বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে জিয়া পুরো পরিকল্পনার প্রেক্ষাপটটা তৈরি করে দেন। ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাও সূদুরপ্রসারী ছিল। সেই কারণে এই ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ভাষণে বলা হয়েছে, "আর দাবায়ে রাখতে পারবা না" এটার মধ্যে দিয়ে কী দাঁড়ায়? একবারেই একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিও যদি আলাদাভাবে দেখেন তাহলে তিনি যদি বিপ্লবী মানুষ হন, সম্ভাবনার মানুষ হোন কিংবা প্রতিশ্রুতিশীল মানুষ হোন না কেন?প্রতিকূলতার মধ্য নিজের শক্তি, সাহসকে উজার করে রুখে দাঁড়াতে এই বাক্যটটি অনেক বেশি কার্যকর। ফলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যুগ যুগ ধরে আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।


বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) রুটিন উপাচার্য ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক দিন। জাতীয় জীবনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এক অনন্য দিন ৭ই মার্চ। রাজনীতির শ্রেষ্ঠ কবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক কালজয়ী ভাষণের দিন এটি। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক সেইদিন যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। আজকের এই দিনে সেই ভাষণে উদ্ভাসিত হয়ে জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই চূড়ান্ত সময়।


তিনি বলেন,জাতির পিতার হাতে স্থাপিত বুটেক্সের পক্ষ থেকে আমি ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান (উপাচার্য, রুটিন দায়িত্ব) উন্নয়নের রুপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করছি, আগামীর দিনগুলোতে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করে যাবো। জয় বাংলা।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com