শিরোনাম
‘এতো দায়িত্ববান নগরপিতা আমি খুব কমই দেখেছি’
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:৩৭
‘এতো দায়িত্ববান নগরপিতা আমি খুব কমই দেখেছি’
খলিলুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

‘আমি কাজল। মিরপুর ১৩ নম্বরে থাকি। আমি একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করি। বাসায় ফেরার সময় প্রায়ই আমাকে মিরপুর ১০ নং ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে-ব্রিজ থেকে নেমে ১৩ নম্বরের দিকে যাবার সময় আমিসহ অনেক মেয়েকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। আপনারা ফুটপাতটি ব্যারিকেট দিয়ে আটকে দিয়েছেন, সেই জায়গাতে আবার হকার। ফলে একটুখানি জায়গা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পুরুষদের ধাক্কাসহ নানা ঝামেলার শিকার হচ্ছি। আপনার কাছে অনুরোধ, খুব দ্রুত এর একটা সমাধান করবেন। আপনার সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি।’


উপরোক্ত কথাগুলো লিখে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র সদ্যপ্রয়াত আনিসুল হকের ব্যক্তিগত মোবাইলে মেসেজ দিয়েছিলেন মিরপুর ১৩ নম্বরের বাসিন্দা কাজল কেয়া। গত বছরের ১৫ নভেম্বর তিনি এমন মেসেজ দেন। মেসেজ দেয়ার পর সাথে সাথে উত্তর দিয়েছিলেন আনিসুল হক। কালজলকে ধন্যবাদ দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সাথে দেখবেন। পরবর্তীতে কথা মতো ৩০ নভেম্বরের মধ্যে কাজও করেছিলেন নগরপিতা। পুরো এলাকায় হকারদের উচ্ছেদ করেছিলেন তিনি।


নগরবাসীর অভিভাবকের এমন ব্যবহার ও দায়িত্বশীল কাজে অনেক খুশিও হয়েছেন ব্যাংকার কাজল কেয়া। সেই আনন্দে মেয়রের মেসেজটি স্কিনসট দিয়ে বিবার্তা২৪ডটনেটের এই প্রতিবেদকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মেসেজটি সংরক্ষণে রাখা হয়েছিল। শনিবার রাতে এই মেসেজের সূত্র ধরে সেই কাজল কেয়ার সাথে কথা হয়।


শনিবার রাতে বিবার্তার এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে কাজল কেয়া বলেন, ‘দেখো আমি ভাবতেও পারিনি ম্যাসেজটি এইভাবে নিউজ হবে! এতো দায়িত্ববান নগরপিতা আমি খুব কমই দেখেছি। যদিও আমার দেখার বয়স তেমন বেশি নয়। তার মৃত্যুতে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। মনে হচ্ছে নিজের পরিবারেরই কেউ। তিনি আমার পরিচিত নন, তবুও তার মৃত্যুর পর তাকে অনেক পরিচিত মনে হচ্ছে। তার মতো মানুষ এই অস্থির সময়ের জন্য অনেক বেশি দরকার ছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।’



শুধু কাজল কেয়া নয়, নগরীতে বসবাসকারী সকল নাগরিককের দিকে তিনি সমানভাবে নজর দিতেন। তার কাছে ধনী-গরীব কোন ভেদাভেদ ছিল না। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সহজে আপন করে নিতেন তিনি। নগরপিতার মৃত্যুর পর এর প্রমাণও মিলেছে।


রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন মাহাদী জানিয়েছেন, সার্চ ফর হিউম্যানিটি নামের তার একটি সামাজিক সংগঠন রয়েছে। সেই সংগঠনের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ দেয়ার জন্য চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় অতি সহজে নগরপিতার সাথে দেখা করেছিলেন।


তবে নগরপিতা লন্ডনে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মাহাদী তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছেন।


তিনি লিখেছেন, ‘Search For Humanity এর প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রধান অতিথী হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক স্যারকে দাওয়াত করেছিলাম। তিনি খুব আন্তরিকতার সহিত আমার দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন। যখন তাকে আমি পরিচয় দিলাম স্যার আমি আপনার এলাকার ছেলে। তখন আমার প্রতি তার আন্তরিকতা আরো বেড়ে গেল। তিনি খুব খুশি হয়ে হাসি মুখে বললেন, ‘ছোট ভাই আমি তো তোমার দাওয়াত গ্রহণ করলাম। হয়তো যাওয়া হবে না কারণ সে দিন আমার অনেকগুলো প্রোগ্রাম রয়েছে। যা কোনভাবেই মিস করা যাবে না। তুমি মন খারাপ করো না তোমাদের আগামী প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমি থাকবো।’ স্যার Search For Humanity এর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী চলে আসছে। আর মাত্র অল্প কিছুদিন। আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। দ্রুত ফিরে আসুন স্যার। আমাকে কথা দিয়েছিলেন আপনি অতিথী হয়ে আমাদের অনুষ্ঠানে থাকবেন। আপনাকে ছাড়া অনুষ্ঠানটা শূন্য মনে হবে। অনেক দোয়া আর ভালোবাসা স্যার আপনার জন্য।’


তবে শনিবার রাতে বিবার্তার পক্ষ থেকে সেই সোহরাব হোসেন মাহাদীর সাথে যোগাযোগ করা হয়। এ সময় নিজেকে সার্চ ফর হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘স্যার এভাবে চলে যেতে পারলেন? আপনি না আমাকে বলেছিলেন আপনার সার্চ ফর হিউম্যানিটির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষীকিতে অতিথি হয়ে থাকবেন। আর তো অল্প কয়টি দিন মাত্র। এ কয়েকটা দিন থেকে গেলেও পারতেন স্যার। জানেন স্যার আপনাকে যে এতোটা ভালোবসি আগে জানতাম না। আপনার বিদায়ের সংবাদটা শোনার পর অনুভব করছি কতটা ভালোবাসি আপনাকে। স্যার আপনার গ্রীন ঢাকা আর ক্লিন ঢাকার জন্য কিছু করতে চায় সার্চ ফর হিউম্যানিটি। ওপারে ভালো থাকবেন। আল্লাহ্ আপনাকে জান্নাতবাসী করুক।’


এছাড়াও শনিবার রাতে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা প্রধান, সাংবাদিক রেজোয়ান হক ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে স্মরণ করেছেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে। তিনি জানিয়েছেন গত জুলাই মাসের ২৭ তারিখ মেসেজের মাধ্যমে মেয়রের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। পরবর্তীতে ২৭ জুলাইও মেয়র মোবাইলের মাধ্যমে শেষ বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই দুটি মেসেজও তিনি ফেসবুকে দিয়েছেন।


রেজোয়ান হক ফেসবুকে তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘প্রথম পর্বে আনিস ভাইকে অতিথি করে আমাদের টিভিতে একটি নতুন অনুষ্ঠান শুরু করার সব প্রস্তুতি গত জুলাইতে শেষ করেছিলাম। তারও বেশ আগে এ পরিকল্পনা মাথায় এলে প্রথমেই তার সাথে পরামর্শ করি। শুধু এজন্যে নয় যে এ অনুষ্ঠানে তাকে দরকার হবে, অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো তিনি একজন সফল টিভি উপস্থাপক। মেয়র নির্বাচনের আগে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি করে তাকে নিয়ে শেষ যে অনুষ্ঠানটি করেছিলাম বা তারও আগে বেশ কয়েকটি টক শো-তে এসে নানা পরামর্শ দিয়ে অনুষ্ঠানের মান বাড়ানোর চেষ্টা করতেন তিনি। নতুন অনুষ্ঠানটির ব্যাপারে বেশ কয়েক দফা ফোনে আলোচনার পর ১৬ জুলাই গুলশানে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নতুন অফিসে তার সঙ্গে চূড়ান্ত কথা বলতে যাই। ওই দিন সকালে সেখানে তিন মন্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে সমন্বয় সভা করেন। বিকেলে যখন তার রুমে ঢুকি তিনি তখন বাস চলাচলে শৃংখলা ফেরানোর পরিকল্পনা নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমার সঙ্গেও কথা ফাইনাল হলো মাসের শেষদিকে একটা ডেট দেবেন।’



‘২৭ তারিখে ফোনে বার্তা পেলাম-‘আমি কঠিন ভার্টিগো রোগে ভুগছি। ডাক্তার যতটা সম্ভব বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। পরে ফোন করবো’। ২৯ তারিখে শেষ বার্তা-‘হঠাৎ করেই যুক্তরাজ্যে যাচ্ছি। ফিরে যোগাযোগ করবো’। বিকেলে আর্মি স্টেডিয়ামে জনারন্যে দাঁড়িয়ে বারবার মনে হচ্ছিল কফিনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি-কি আনিস ভাই, আপনার তো ফিরে যোগাযোগ করার কথা ছিল? কিন্তু হাজারো মানুষের ভিড় ঠেলে সেটা করা সম্ভব হয়নি।’


27/07/17
Rejoan Bhai
I am having very strong vertigo. Doctor advising rest as much possible . Trying to be at home next few days
I will call you .


29/07/17
I am suddenly going to U.K. This morning . Will contact when back.
Annis bhai


প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবার যুক্তরাজ্য গিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। পরে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে গত ১৩ আগস্ট তাকে লন্ডনের ন্যাশনাল নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার মস্তিষ্কে প্রদাহজনিত রোগ ‘সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস’শনাক্ত করেন চিকিৎসকরা। এরপর তাকে দীর্ঘদিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল।


একপর্যায়ে তার শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় ৩১ আগস্ট আইসিইউ থেকে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। পরে তাকে ওয়েলিংটন হাসপাতালে আনা হয়। মেয়রের শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় তার কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র খুলে নেয়া হয়। কিন্তু গত মঙ্গলবার মেয়রের পরিবারের সদস্যরা জানান, রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ায় তাকে আবার আইসিইউতে নেয়া হয়। পরে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২৩ মিনিটে মেয়রকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।


লন্ডনে প্রথম জানাজা শেষে শনিবার মেয়রের লাশ দেশে আনা হয়। ওই দিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মেয়রের লাশবাহী বহনকারী বিমানটি সিলেটে এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এরপর বেলা ১টার দিকে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায় ফ্লাইটটি। পরে সেখান থেকে দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে লাশ বনানীতে তার নিজ বাসায় নেয়া হয়। মেয়রের বাড়িতে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক দলের নেতাকর্মীরাও মেয়রের বাসভবেনে শেষ বিদায় জানান। এ সময় মেয়রের বাড়িতে আবেগঘন পরিবেশের সৃস্টি হয়।


পরে বিকালে বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে মরহুমের জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। মন্ত্রী, এমপিসহ রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এতে অংশ নেন। জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনপ্রিয় অভিভাবককে।


বিবার্তা/খলিল/সোহাগ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com