শিরোনাম
তথ্য পরিবেশনের ওপর নির্ভর করে মিডিয়ার সফলতা
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০১৭, ১৮:৩৯
তথ্য পরিবেশনের ওপর নির্ভর করে মিডিয়ার সফলতা
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। কম্পিউটারে বাংলা লেখার বিজয় কীবোর্ড, বিজয় বাংলা সফটওয়্যার এবং বিজয় এর শিক্ষামূলক সফটওয়্যারের নির্মাতা। লিখেছেন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের কম্পিউটার বিষয়ক বই। ''ডিজিটাল বাংলাদেশ'' ধারণার পথিকৃৎ এই প্রযুক্তিবিদ ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করে আসছেন।


২০১৬ সালের ২৫ জুন সফটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) ২০১৬-১৯ সেশনের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সভাপতি হিসেবে বেসিসকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। সভাপতি হিসেবে চলতি বছরের ১৪ জুলাই এক বছর পূর্ণ হয়েছে।


সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল সার্কুলার রোডে আনন্দ কম্পিউটার্স অফিসে বিবার্তা২৪ডটনেটের সঙ্গে বেসিসের সভাপতি হিসেবে এক বছর পূর্তিতে সফলতা ও ব্যর্থতাসহ সম-সাময়িক নানান বিষয় নিয়ে কথা হয় তাঁর। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তা২৪.নেটের প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ



বিবার্তা : বেসিসের সভাপতি হিসেবে এক বছর কেমন কাটলো আপনার?


মোস্তাফা জব্বার : ২০ বছর আগে একটা ছোট সংগঠন হিসেবে জন্ম নিয়েছিল বেসিস। সে সময় দেশের সফটওয়্যার খাতটাও ছোট ছিল। ২০ বছরে বেসিস অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং একই সাথে দেশের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিটা বড় হয়েছে। এই বড় হওয়ার মধ্যে ৮-৯ বছর ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যেটি এই সরকার পালন করছে। এক সময়ের ২৬ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি এখন ৭০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হয়েছে, সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েছে, সাথে সাথে আমার ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তাটা এমন হয়েছে যে, বেসিসকে তার ভূমিকা পালন করতেই হয়, আইন-কানুনের পরিবর্তন, নীতিমালার পরিবর্তন এসব কিছুই যেন ঠিকভাবে হয় সেটা আমাকে দেখতে হয়েছে। আমার সময়ে সদস্যদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। এর ফলে সদস্যদের যোগাযোগের দক্ষতা বেড়েছে। এখন আমাদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ সদস্যের মধ্যে যোগাযোগ হয় বাংলা মাধ্যমে। আগে বেসিস সরকারের সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করতো। আমরাও সেগুলো যথারীতি করেছি। ‘বেসিস সফটএক্সপো’ নামে একটা ইভেন্ট বন্ধ হয়েছিল, সেটা আমরা এবার করেছি। এটা আমাদের নিজস্ব ইভেন্ট হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে নিজেদের সফটওয়্যারগুলো দেখানোর একটা সুযোগ ছিল। আমার মতে এটা বেসিসের একটা শূন্যতা পূরণের বিষয় ছিল। এছাড়াও আরও কিছু বিষয় ছিল যেমন, আমাদের সদস্য কোম্পানিগুলো যারা তাদের পণ্য বিদেশে আমদানি-রপ্তানি করে তাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা ছিল। ছিল আয়কর ও ভ্যাটের ক্ষেত্রে কিছু অস্পষ্টত। আমি আনন্দিত যে চলতি বছরের বাজেটে ওই সব অস্পষ্টতা কিছু দূর করা সম্ভব হয়েছে। এখন আমার কাছে কেউ ভ্যাট বা ট্যাক্স সংক্রান্ত কোনো সমস্যার বিষয়ে বলে না। তবে একটা নতুন সমস্যা আমি পেয়েছি সেটা হলো দুই-একজন আয়কর কমিশনার ব্যক্তিগত আউটসোর্সিংয়ের ইনকামকে ট্যাক্স হলিডের আওতায় নিচ্ছে না। আমার মনে হয়েছে এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো বড় সমস্যা আমি দেখি না। এসব কিছুকে একটা স্ট্রিমলাইন করাটা একটা বড় বিষয়। ধন্যবাদ আইসিটি মন্ত্রণালয়কে, তারা আমাদের যথাসাধ্য সহায়তা করেছে।


আমাদের অনেকগুলো ইস্যুর মধ্যে ছিল কপিরাইট আইন ও আইসিটি নীতিমালা সংশোধন, ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন কর। সুখের বিষয় হচ্ছে এই সময়ে সকল কাজে সরকারকে সক্রিয় করতে পেরেছি। ডিজিটাল কমার্স নীতিমালার খসড়া তৈরি হয়েছে। আইসিটি নীতিমালা, কপিরাইট আইন ও প্যাটেন্ট আইন সংশোধন হচ্ছে এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য আইন ও নীতিমালা সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো ছিল সেগুলো স্ট্রিমলাইন করাও সম্ভব হয়েছে।


আমাদের গঠনতন্ত্রেও কিছু জটিলতা ছিল অর্থাৎ বানান ভুল থেকে ‍শুরু করে সাংঘর্ষিক কিছু বিষয় ছিল সেগুলো ইতোমধ্যেই আমরা সমাধানে এসেছি। শিগগিরই অমরা এগুলো সমাধান করতে পারবো। আমাদের যেসব সদস্য দীর্ঘদিন ধরে বেসিসের চাঁদা পরিশোধ করেননি, আমরা তাদের স্ট্রিমলাইনে নিয়ে এসেছি। বিপুল পরিমাণ নতুন সদস্য যুক্ত হয়েছে।


এবার আমরা ২৪ বিষয়ে ২৪টা স্ট্যান্ডিং কমিটি করেছি। এর মাধ্যমে সদস্যরা বিভিন্ন কাজে সক্রিয় হয়েছে, তারা তাদের মতামত দিয়েছেন সেই মতামতানুসারে কার্যক্রম চালিয়েছি। সদস্যকল্যাণ বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। বেসিস কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এবং ঋণ সুবিধার বিষয়গুলো আমরা সদস্যদের জন্য যুক্ত করতে পেরেছি।



বিবার্তা : এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল যা আপনি পূরণ করতে পারেননি?


মোস্তাফা জব্বার : বড় একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে সেট হলো ইইএফ ফান্ড এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। আমি যখন পরিচালনায় আসি তখন ফান্ডটি বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, আইসিটি এবং অর্থমন্ত্রণালয় ত্রিপক্ষীয় জটিলতার জন্য ইইএফ ফান্ডের বন্ধ জটটা এখনো ছাড়ানো যায়নি। আমি যদি পারতাম তাহলে এটাকে চালু করে যেতাম। তবে আশা করছি যে সহসাই এটি চালু হবে।


বিবার্তা : বেসিস নির্বাচন নিয়ে একটা জটিলতা আছে। সর্বশেষ অবস্থাটা কি বলবেন?


মোস্তাফা জব্বার : জটিলতা হলো, বেসিস ২০১৫ সালে তার দুই বছরের মেয়াদকে তিন বছরে পরিবর্তন করেছিল। বিষয়টি ডিটিও তখন মানলেও এখন গ্রহণ করছে না। বলছে, বেসিস নির্বাচনের জন্য আগে সংঘবিধি সংশোধন করতে হবে। তারপরই নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। সংঘবিধি সংশোধনের পরে ডিটিও যেভাবে নির্দেশ দেবে সেভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।



বিবার্তা : বর্তমানে ৫৭ ধারা একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এ সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?


মোস্তাফা জব্বার : ৫৭ ধারা থাকছে না। ৫৭ ধারা এখন রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় যে, আইনমন্ত্রী মহোদয় অনেক আগেই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন ৫৭ ধারা বাদ দিতে হবে। বাদ দেয়ার প্রক্রিয়াও চলছে।


৫৭ ধারা যে আইনের অন্তর্ভুক্ত, সেটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে এবং সেই আইনে ৫৭ ধারা সংক্রান্ত যে অপরাধগুলো আছে সে অপরাধগুলো বা অন্য আপরাধগুলো যা যা আছে সবগুলোই ঐ আইনের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি একটা সুনির্দিষ্ট আইনে মোকাবেলা করা হচ্ছে।


৫৭ ধারাটা সম্পর্কে এক ধরণের বিভ্রান্তি কাজ করে। ৫৭ ধরার ৪টা সমস্যা রয়েছে। একটা সমস্যা ৫৭ ধারায় যে অপরাধগুলোর কথা বলা হয়েছে সে অপরাধগুলো সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি। যদি অপরাধগুলো সুস্পষ্ট করা হতো তাহলে অপরাধগুলোর সংজ্ঞা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি করার সুযোগ থাকতো না। এই আইনে যে বিবরণ রয়েছে সেখানে আইনের কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে গেছে। ৫৭ ধারাকে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। তদুপরি ৫৭ ধারায় শাস্তি সর্বনিম্ন ৭ বছর করা হয়েছে। এসব কারণে এটার অপপ্রয়োগ বেশি করা হচ্ছে। সুতরাং ৫৭ ধারা বিষয়টা স্পষ্ট করার জন্য এই চারটা সমস্যার সমাধান করা দরকার। সমাধানটা হলো- আইনের যেসব প্রচলিত নিয়ম আছে সেটা হচ্ছে জামিনযোগ্য থাকবে, কোর্ট আমলে নিতে পারবে, পুলিশ মামলা করামাত্রই আসামীকে ধরে নিয়ে যেতে পারবে না এবং ধারাগুলো আরো সুস্পষ্ট থাকবে। এই কাজগুলো করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমি শুধু তৃতীয় খসড়ায় যেটা দেখেছি ৫৭ ধারার রিপ্লেসমেন্ট হচ্ছে ১৯ ধারা। ১৯ ধারার সর্বনিম্ন শাস্তি ধরা হয়েছে ৭ বছরের বদলে দুই মাস। সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের বদলে দুই বছর। এটি আমলযোগ্য নয় এবং জামিনযোগ্য। ফলে এর অপপ্রয়োগের আশঙ্কাও আর থাকবে না। আরেকটা যেটা করা হয়েছে সেটা হলো এটাকে সিআরপিসির ৪৯৯, ৫০০ ও ৫০১ ধারার সাথে যুক্ত করা হচ্ছে, এটা ইতোমধ্যেই অনেক বছর ধরে প্রচলিত আছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে ৫৭ ধারা নিয়ে সবার মধ্যে যে উদ্বেগটা কাজ করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হলে সেটা আর থাকবে না।



বিবার্তা : বিবার্তা২৪ডটনেটের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?


মোস্তাফা জব্বার : আমার পরামর্শটা প্রচলিত ধারার বাইরে। মিডিয়া বদলে গেছে। মিডিয়ার প্রচলিত ধারা আর কাজ করে না। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের প্রচলিত মিডিয়া দায়িত্ব পালনে অক্ষম। এখন অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, সম্প্রতি বরগুনার টিএনওর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছিল সেখানে আমাদের প্রচলতি মিডিয়া কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। সোশ্যাল মিডিয়া পুরো বিষয়টিকে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে।


মিডিয়া সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো, আমাদের মিডিয়া অতিরিক্ত রাজনীতিনির্ভর, হয়তো আমাদের সামাজিক অবস্থার জন্য এটা হয়েছে। আমি মিডিয়াতে কেবল রাজনীতি চাই না, চাই তথ্য। তথ্যের জায়গাটি রাজনীতিতে ভরে গেছে। রাজনীতি নিয়ে তর্ক করার জন্য চায়ের টেবিলই যথেষ্ট। কিন্তু তথ্যের জায়গাটা অনেক বড়। এই তথ্যের জায়গাটা যদি পূরণ করা না যায় তবে মিডিয়া সক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। তাই আমি যেটা প্রত্যাশা করবো বিবার্তা২৪ডটনেট বা এ ধরণের যে কোনো গণমাধ্যম তার তথ্য প্রদানের ভূমিকা যেন ঠিকমতো পালন করে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ চায় সঠিক তথ্য।


দ্বিতীয় যে বিষয়টা বলবো সেটা হলো, শুধু তথ্য থাকলেই হয় না, তথ্য পরিবেশনের ওপর নির্ভর করে আমার পাঠক, দর্শককে তা আকৃষ্ট করতে পারে কি না। এটার জন্য মাধ্যম থেকে মাধ্যম আলাদা হতে হবে। বুঝতে হবে আমার পাঠক কে? আমি কি তথ্য পরিবেশন করছি আর তাদের চাহিদাই বা কী। আমি তা পূরণ করতে পারছি কিনা। এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেয়া জরুরি।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com