
জামান খান যখন আইটি বিজনেস শুরু করেন তখন তার বাবা তাকে বাসা থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন। যে পার্টনারের সাথে বিজনেস শুরু করতে চেয়েছিলেন, তিনি শুরুর দিনেই জানিয়ে দেন, তার সাথে বিজনেস করা তার পক্ষে সম্ভব না।
আবার শুরু করার কিছু দিন পরে তারই এক স্টাফ অনেকগুলো ক্লায়েন্ট নিয়ে চলে যায়। চুরি হয়ে যায় তার সবগুলো ল্যাপটপ। এতো দিনের জমানো সমস্ত ডেটা হারিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন, কিন্তু ভেঙে পড়েননি।
সম্প্রতি বিবার্তা২৪ডটনেটের প্রতিবেদকের সাথে দীর্ঘ আলাপে বেরিয়ে আসে জামান খানের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প। সেই গল্প পাঠকদের জানাচ্ছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।
শৈশবে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন জামান খান। সে ইচ্ছা পূরণও হয়েছে তার। তিনি এখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গড়েছেন আইটি কম্পানি। নিজের নামেই প্রতিষ্ঠানটির নাম দিয়েছেন ‘জামান আইটি’। এটি বর্তমানে দেশের সফল সফটওয়্যার কম্পানিগুলোর অন্যতম।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সফটওয়্যার বিজনেস শুরু করেন জামান খান। তখন সফটওয়্যার বানানোর পাশাপাশি ওয়েবসাইটও তৈরি করতেন। কম্পানির নাম ছিল ‘সফটওয়েব সল্যুশনস লিমিটেড’। তখন তার কোনো ক্রেডিট কার্ড ছিল না। তাই নামটা কারওয়ান বাজারের একটা আইটি কম্পানির কাছ থেকে কিনেছিলেন। ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ক্লায়েন্ট ছিল ৫৬।
২১ নভেম্বর ওই কম্পানি তার ডোমেইনটা রি-ডাইরেক্ট করে রাখে তাদের ডোমেইনে। ফলে জামানের সার্ভার বন্ধ হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন ক্লায়েন্টের ফোন আসতে থাকে তার কাছে। জামানের তখন পাগল হবার দশা। বিজনেসের শুরুতেই এত বড় ধাক্কা? তার এতদিনের কষ্ট কি এক দিনেই ধ্বংস হয়ে গেলো? কম্পানিকে ফোন দিয়ে সার্ভার বন্ধের কারণ জানতে চাইলে তারা জানাল, তাদের কোনো ক্লায়েন্ট নাকি তাদেরকে ছেড়ে জামানের কাছ থেকে সার্ভিস নিচ্ছে। জামান নাকি এক এক করে তাদের ক্লায়েন্ট সব নিয়ে নিচ্ছে। তাই তারা আর জামানকে কোনো সার্ভিস দেবে না।
তাদের অনেক অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি জামানের। এরপর অনলাইনে ডোমেইন খোঁজা শুরু করেন তিনি। কিন্তু আগের নামের সাথে কোনো ডোমেনই ফ্রি পাচ্ছিলেন না। তাই ভাবলেন আপাতত একটা নাম দিয়ে শুরু করা যাক। কারণ তার সাথে সার্ভার কিনে সবগুলো ওয়েবসাইট ব্যাকআপ আপলোড করতে হবে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন আর কিনে ফেলেন নিজের নামে ডোমেইন ‘জামান-আইটি ডটকম’। এভাবেই শুরু হয় জামান আইটির পথ চলা।
জামান জানান, ২০০৮-১৬ একটা ছো্ট্ট ইতিহাস। অনেক ব্যর্থতার সাথে বেশ কিছু সফলতায় ভরা ছিল গত আটটি বছর। প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা ছিল জামান আইটিকে নতুন করে গড়ার। তা করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছেন অনেকবার। কম্পানি বন্ধ হবার উপক্রমও হয়েছে। কিন্তু শত প্রতিকূলতার মাঝেও কখনো হাল ছাড়েননি অদম্য এই মানুষটি। তার জেদ, এর শেষ কোথায়, দেখবো।
হাল না ছাড়ার এবং হার না মানার অভ্যাসটা জামানের অনেক পুরোনো। অনেকবার হেরেছেন কিন্তু থেমে যাননি, আবার শুরু করেছেন। যাদেরকে হাতেকলমে কাজ শিখিয়েছেন, পরে তাদের কাছ থেকে তাকে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। তাতে কষ্ট পাননি, মনে মনে হেসেছেন।
তার কাজকে ফেসবুক বন্ধুরা কীভাবে মূল্যায়ন করতেন জানতে চাইলে জামান খান বলেন, এই বিজনেস শুরুর দিকে বিভিন্ন মানুষ ফেসবুকে আমাকে আক্রমণ করে নানারকম মন্তব্য করতো। আমি দেখে দেখে শুধু হাসতাম। হাসতাম এই কারণে যে, মানুষের কত সময়, নিজের কাজ বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে লিখে সময় নষ্ট করে। তার লেখার কারণে আমার হয়ত কিছু লিখতে হবে। কিন্তু আমারই বা এতো সময় কোথায়? ক্লায়েন্টকে সার্ভিস দেব, নাকি এসব আজেবাজে লেখার প্রতি উত্তর দেব। তাই এসব মন্তব্যকারীকে সোজা ব্লক করে দিতাম।
প্রতিষ্ঠান চালানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা বিষয়ে বলেন, দীর্ঘ আট বছরে কিছু মীরজাফর শ্রেণীর মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। অনেক অনুরোধ করে, হাতে-পায়ে ধরে, বিভিন্ন মহল থেকে রিকোয়েস্ট করিয়ে আমার কম্পানিতে জব নিয়েছে। অফিসে বসে পার্সোনাল কাজ করে মাস শেষে আমার কাছ থেকে বেতন নিয়েছে। আবার আজ তারাই আমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব। তবে আমি অনেক খুশি। অন্তত কিছু মানুষ আমাকে নিয়ে আলোচনা তো করে! সেটাই বা কম কিসে। আবার কাজ করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে কত কিছু যে শিখেছি সেটা লিখতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে। কিন্তু যাদের কারণে আজও টিকে আছি তারা হলেন আমাদের ক্লায়েন্ট। তারা আমার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্মী। বিগত দিনগুলোতে ২০ হাজার ক্লায়েন্টকে ছোট-বড় বিভিন্ন সার্ভিস দিয়েছি। কখনো এদের কাছ থেকে কষ্ট পাইনি।
আপনার প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের কার্যক্রম করা হয়? জানতে চাইলে জামান খান বলেন, আমরা মূলত সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ করি। পাশাপাশি বিভিন্ন কর্পোরেট কম্পানির ওয়েবসাইট করে থাকি। আমাদের সর্বমোট ২৭টি রেডি সফটওয়্যার রয়েছে, যা আমরা ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুসারে দিয়ে থাকি। আমাদের প্রায় ১০০০+ সফটওয়্যারের ক্লায়েন্ট এবং ৫০০০+ ওয়েবসাইটের ক্লায়েন্ট আছে। যদিও লাভের পরিমাণ অনেক কম তবুও আমাদের এসএমএসের ক্লায়েন্ট আছে ১০০০০+ এবং ইমেইল মার্কেটিংয়ের ক্লায়েন্ট আছে ২০০০+। আমরা কম্পানির শুরু থেকেই ওয়েবসাইট, সফটওয়্যার, ইমেইল মার্কেটিং ও এসএমএস মার্কেটিংয়ের সার্ভিস দিচ্ছি। আমরা এখন মোবাইল অ্যাপস বানানো শুরু করছি।
দেশে স্টার্টআপে সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো বিষয়ে জামান খান বলেন, আমাদের দেশের তরুণরা যে কী করতে পারে তা ১৯৭১ সালে একবার প্রমাণিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তরুণরা আজও থেমে নেই। তারা দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে একের পর এক স্টার্টআপ কম্পানি আত্মপ্রকাশ করছে। আমিও এখন নিজেদের স্টার্টআপ কম্পানি হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এই দেশে স্টার্টআপের সম্ভাবনা অনেক। শুধু লেগে থাকতে হবে।
দীর্ঘদিন আইটি সেক্টরে কাজ করছেন। আপনার অভিজ্ঞতায় এ সেক্টরের সমস্যাগুলো কি? তার বিশ্লেষণধর্মী জবাব, আইটি সেক্টরে কিছু সমস্যা আছে, যেমন মূল্য নির্ধারণ। একই রকম সার্ভিসের জন্য একেক কম্পানি একেক রকম মূল্য নির্ধারণ করে। ফলে ক্লায়েন্টরা দ্বিধায় ভোগে যে তারা কার সার্ভিস নিবে। ছোট কম্পানিগুলো ক্লায়েন্ট পাবার জন্য খুব কম দামে সার্ভিস অফার করে। তারা অভিজ্ঞতার অভাবে সার্ভিস সেলের সাথে যে অফিসিয়াল খরচ যোগ করতে হয় সেটা না করেই মূল্য নির্ধারণ করে। ফলে পরবর্তীতে সে ক্লায়েন্টকে আর ভালো সার্ভিস দিতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে কম্পানি বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে অনেক ক্লায়েন্ট বিপদে পড়ে যান এবং একই সার্ভিস তাকে আবার আরেক জায়গা থেকে নিতে হয়। এক দিকে ক্লায়েন্টের টাকা বেশি খরচ হয়। অন্য দিকে সে এই সেক্টরের কম্পানিগুলোকে আর বিশ্বাস করতে পারে না।
নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানালেন জামান খান। তিনি বাংলাদেশের সফটওয়্যারগুলোকে আন্তর্জাতিক মার্কেটে ছড়িয়ে দিতে চান। চান, সারা বিশ্ব শুধু ক্রিকেট আর গার্মেন্টস নয়, আইটি সেক্টরের মাধ্যমেও বাংলাদশকে চিনুক ও জানুক। বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর কাছে একটি উদাহরণ হয়ে থাকুক - এমনটাই প্রত্যাশা করেন এই উদ্যোক্তা।
বিবার্তার মাধ্যমে তিনি শুভানুধ্যায়ী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আজ আট বছর পর এই ২০ হাজার কম্পানিকে জামান আইটির পক্ষ থেকে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা। কারণ, আপনারা ছিলেন বলেই আমরা এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার টিম মেম্বারদের প্রতি, যারা আমাকে ভালবেসে প্রতি মুহূর্তে সাপোর্ট দিয়েছন। কৃতজ্ঞতা সেই মানুষগুলোর প্রতি, যারা আমাকে আঘাত করে মানুষ চিনতে সাহায্য করেছেন।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]