শিরোনাম
নিউজ প্রেজেন্টারদের আইকন হতে চান বর্ণা
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:২৪
নিউজ প্রেজেন্টারদের আইকন হতে চান বর্ণা
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

রুমানা শার্মীন বর্ণা। জন্ম সুনামগঞ্জে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দুইবার স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত জাতীয় বিতার্কিক। ঢাবি থেকে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স পাস করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশনের এ গ্রেডের নিয়মিত সংবাদ উপস্থাপিকা।


বর্ণা সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে নিজ বাসভবনে মুখোমুখি হন বিবার্তার। জানালেন নিজের জীবনের গল্প। সেই গল্প পাঠকদের জানাচ্ছেন বিবার্তা২৪ডটনেটের প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।


রত্নগর্ভা মা রেহানা সামাদ (বিএ বিএড) ছিলেন শিক্ষিকা। বাবা এম এ খালেক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে এমএ পাস করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এডুকেশন কোরের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণ করেন।


ছোটবেলায় বর্ণার প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়ার। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সাইকোলজি নিয়ে পড়ালেখা শুরু করলেন। সাইকোলজিতে অনার্স এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে প্রথম বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।


সেই ছোটবেলায় বাসার সবাই একসাথে বসে বিটিভির রাত আটটার সংবাদ দেখতেন। এ সময় বর্ণাকে তার বাবা প্রায়ই বলতেন, জীবনে কখনও যদি নিউজ প্রেজেন্টার হতে পার, তাহলে চেষ্টা করবে রাত আটটার সংবাদ পড়ার।



বাংলাদেশ টেলিভিশন সম্প্রচারিত রাত আটটার সংবাদটি ছিল তখন জাতীয় সংবাদ। সবাই খবর দেখতেন শুধু বিটিভিতে। দেশে তখন অন্য কোনো চ্যানেল ছিল না।


বর্ণা বলেন, বাবার উৎসাহ পেয়ে ছোটবেলা থেকেই নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করতে থাকি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি যে আমি এখন বিটিভির একজন এ গ্রেডের নিয়মিত নিউজ প্রেজেন্টার বা সংবাদ উপস্থাপিকা। গত ১০ বছর ধরে বিটিভিতে রাত আটটার সংবাদ পড়ে আসছি। যখনই আমি সংবাদ প্রেজেন্ট করতে যাই তখনই বাবার কথাটা মনে পড়ে।


ছোটবেলায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে গানের শিক্ষক আসতেন গান শেখাতে। আবার হুজুর আসতেন কোরান শরীফ পড়া শেখাতে।


বাবা ও মা দুজনেই শিক্ষকতা পেশায় থাকার সুবাদে বাসায় সব সময়ই পড়ালেখার একটা অনুকূল পরিবেশ ছিল। বর্ণা বলেন, পরিবার পরিমণ্ডলের মধ্যে সাংস্কৃতিক আবহটা এমনভাবে জড়িয়ে ছিল যে ছোটবেলা থেকেই আমি সংস্কৃতিমনা হয়ে উঠতে থাকি। ছোটবেলায় আমার মধ্যে সংস্কৃতির বীজ বুনে দিয়েছে আমার পরিবার। পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা তিন বোনকেই নাচ, গান ও আবৃত্তিসহ সব ধরণের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি উৎসাহিত করা হয়।


এখন তিন বোন তিন পেশায় কাজ করছেন। বড় বোন ফাহীম খালেক নিপা ২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে বর্তমানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন। ছোট বোন ইমানা শাহরীন তানিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসক হিসেবে মেজর র‌্যাংকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।



একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে কষ্টে ছটফট করছে আর তাকে ওই অবস্থা থেকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলার মধ্যে যে কী আনন্দ, সেটা একজন চিকিৎসকই অনুভব করতে পারেন। ওই অভিজ্ঞতাও হয়েছে তার। ক্লিনিক্যাল সাকোলজিতে মাস্টার্স করা বর্ণা মানোচিকিৎসক হিসেবে কাজও করেছেন।


ছোটবেলা থেকেই গান, কবিতা আবৃত্তির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। ক্লাস টুতে পড়ার সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বিটিভিতে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অনুষ্ঠান করেন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই শুরু তার বিটিভিতে পথ চলা।


এরপর তিনি বিটিভিতে শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতে থাকেন। তখন তিনি ক্লাস সেভেনে। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত বিটিভির সুপ্রভাত, নতুনকুঁড়ি প্রভৃতি অনুষ্ঠানে উপস্থাপিকা হিসেবে কাজ করেন। এক পর্যায়ে সংবাদ উপস্থাপিকা হিসেবে কাজ করার জন্য অডিশন দেন। আর সহজেই পাস করে যান।


সংবাদ উপস্থাপনার চ্যালেঞ্জ বিষয়ে বর্ণা বলেন, এটা এমন একটা বিষয়, যেটা প্রতিটা দিনই একজন সংবাদ পাঠককের কাছে নতুন দিন। কোনো সংবাদ পাঠকই বলতে পারবেন না যে, আজকের দিনটাতে তিনি ভাল সংবাদ পড়বেন। তার কাছে প্রত্যেকটা দিনই একটা নতুন দিন, একটা নতুন চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিটি দিনই তিনি একজন নতুন নিউজ প্রেজেন্টার। প্রতিটি খবরই তার কাছে প্রতিদিন নতুন। কেননা দেখা গেল যখন আমি খবর পড়ছি, তার পাঁচ মিনিট আগেই একটা ঘটনা ঘটেছে। আর সেটা খবর তৈরি হয়ে আমার কাছে এসছে। ওই খবরটা ওখানে বসেই আমি জীবনের প্রথম দেখছি। খবরের নামগুলো, শব্দগুলো প্রথম দেখছি ও শুনছি। এটা এতোটাই চ্যালেঞ্জের ব্যাপার যে, তখন ওই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে সব ইমপ্রেশন, বানানগুলো ঠিক রেখে, প্রমিত উচ্চারণ বজায় রেখে সংবাদটাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া - এটা আমার কাছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জের।



নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা বিষয়ে বর্ণা বলেন, এটা একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। সবার জন্যই ওই সময়টা অনেক ভয়ের, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ কাজ করে। তবে ভয়কে জয় করাই হলো আসল কথা। আমারও ভেতরে অনেক ভয়, টেনশন কাজ করছিল যে, কী হবে আজকে। বিকেল পাঁচটার নিউজ ছিল। আগেই বলে দেয়াছিল এখানে যদি আপনি প্রেজেনটেবল না হন, তাহলে বাদ দেয়া হবে। এখনও ওই দিনের কথা মনে পড়লে হাসি পায়। কত অগোছালো ছিল সব কিছু। পরণে ছিল কমলা পাড়ের শাড়ি। মেকাপ ছিল কোনোরকমের। চুলগুলো তেমন পরিপাটি ছিল না। যথাসময়ে নিউজ পড়া শুরু করি। দু’লাইন নিউজ পড়ার পরেই নিজেকে ফিরে পাই। মনে হলো অন্য সাধারণ অনুষ্ঠানের মতোই কোনো উপস্থাপনা করছি। একদম সহজ সাবলীলভাবে নিউজ পড়ে বের হয়ে আসি। পরে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছিলেন না। আমি তো ভয় পেয়েছিলাম অনেক। হঠাৎ সবাই এক সাথে বলে উঠল, বর্ণা আপনি অনেক চমৎকার নিউজ পড়েছেন। আপনি অনেক দূরে যাবেন। ওই স্মৃতিটা আজো ভুলিতে পারি না।


সংবাদ উপস্থাপিকা হওয়ার জন্য জরুরি হচ্ছে, গোছানো হতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে উপস্থাপিকার কাছে যে খবরটা আছে সেটাকে শ্রোতা-দর্শকদের কাছে কতটা শুদ্ধ ও সুন্দর করে খবরটা পৌঁছে দিতে পারছে, সেটাই আসল বিষয়। তবে যেহেতু এটা দেখা ও শুনার বিষয়, তাই এখানে মেকাপ-গেটাপেরও বিষয় রয়েছে। নারী বা পুরুষ প্রেজেন্টার অন্য সাধারণ দিনে বা অনুষ্ঠানে যে রকম পোশাক বা গেটাপ নিতে পারে নিউজে তা নেয়া যায় না। পোশাক, চুল, মেকাপ, এক্সপ্রেশন, ইমপ্রেশন সবগুলোর সমন্বয় থাকতে হবে। এখানে দিনের সাথে, খবরের বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে সব কিছু পরতে ও করতে হয়। এমন কিছু পরা বা করা যাবে না যেটা দর্শকদের বিরক্তির কারণ হতে পারে।



বর্ণা বলেন, একজন নিউজ প্রেজেন্টারের জন্য যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো হলো, কণ্ঠ, স্মার্টনেস, স্পষ্ট, শুদ্ধ উচ্চরণ ও প্রমিত বাংলায় কথা বলা, শারীরিক ভাষা বা বাচনভঙ্গী, হাস্যোজ্জ্বল মুখ, উপস্থাপনা দক্ষতা ইত্যাদি।


অলাপ প্রসঙ্গে জানা গেল, বর্ণার প্রিয় উক্তি হলো, আমি অনেকের মধ্যে একজন হওয়ার জন্যই জন্মেছি।


জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ স্বর্ণপদক ১৯৯৬, ১৯৯৯ পেয়েছেন বর্ণা। এছাড়া তিনি ১৭তম জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।


পারিবারিক জীবনে স্বামী মেজর ফকরুল ইসলাম ও মেয়ে সুবহাকে নিয়ে সুখে আছেন বর্ণা। মেয়ে নার্সারিতে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করছে।


একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবে বর্ণার ইচ্ছে বাংলাদেশি সংস্কৃতি জগতে সম্পদ হতে পারে এমন একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করার। তবে নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিদিনই তৈর করছেন। আরো করতে চান। দেশের নিউজ প্রেজেন্টারদের আইকন হতে চান তিনি। বিটিভির প্রতি রয়েছে তার অশেষ কৃতজ্ঞতা।


বর্ণার বড় চাচা ও বড় খালামনি মুক্তিযোদ্ধা। শৈশব থেকেই তাদের মুখে জাতির পিতার বীরত্বগাঁথা গল্প শুনেই বড় হয়েছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ লালন করছেন মননে, ধারণ করছেন সমস্ত সত্তায়। সেই আদর্শকে সাথে নিয়ে বর্ণা এগিয়ে যেতে চান ভালো মানুষ হওয়ার প্রত্যাশায়।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com