
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তঘেঁষা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দেশের ‘আমের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত। মাটি, আবহাওয়া, জাত এবং ঐতিহ্য মিলিয়ে এ জেলার আম বিশ্বমানের স্বীকৃতি পেয়েছে বহু আগেই। তবুও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমশিল্প আজ সংকটে। এ সংকট কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের নয় এটি নীতির অস্পষ্টতা ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতা থেকে সৃষ্ট এক প্রশাসনিক অচলাবস্থার ফল।
ঘোষণা আসে, বাস্তবায়ন হয় না ক্ষতিগ্রস্ত চাষি ও আড়ৎদার উভয়েই চলতি মৌসুমে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথম যে সিদ্ধান্তটি এসেছিল, সেটি ছিল কেজি দরে আম ক্রয়-বিক্রয় বাধ্যতামূলক। এই সিদ্ধান্ত চাষিদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি তৈরি করলেও, বিপাকে পড়ে স্থানীয় আড়ৎদাররা। তাদের দাবি, হঠাৎ কেজি ভিত্তিক বিক্রিতে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, অনেক ক্ষেত্রে আমের মান যাচাইয়ের সুযোগ কমে যায়, ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে। প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় দফায় প্রশাসন নতুন সিদ্ধান্ত দেয় প্রতি কেজিতে আড়ৎদার ১.৫০ টাকা কমিশন পাবে। এতে উভয় পক্ষ কিছুটা আশাবাদী হলেও বাস্তবতা হলো এই দুটি সিদ্ধান্তের কোনোটিই মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়নি।
হাটবাজারে প্রশাসনের উপস্থিতি নেই, নেই তদারকি, নেই জরুরি হস্তক্ষেপ। ফলে চাষি যেমন বিক্রি করছেন পুরনো পদ্ধতিতে লোকসানে, আড়ৎদারও পাচ্ছেন না কমিশন। দু’পক্ষই প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নহীনতায় হতাশ। চাষির ঘামে পানি, লাভের মালিক অন্য কেউ প্রথাগত ৪৫ কেজির মণ হিসেব করে আম বিক্রির যুগ পেরিয়ে এসেও এখনও অনেক স্থানে ৫২-৫৪ কেজিতে লেনদেন চলছে চাষির অজান্তেই ‘ওজন কাটা’ হচ্ছে। এই অনিয়ম ঠেকাতে প্রশাসনের কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেই। ফলে একদিকে চাষির শ্রম যায় জলে, অন্যদিকে আড়ৎদারও জড়াচ্ছেন এক অনিশ্চিত জটিলতার মাঝে।
নীতির ঘাটতি নয় ঘাটতি বাস্তবতার মূল্যায়নে নীতিনির্ধারক মহল থেকে মৌসুম শুরুর আগেই যত্নসহকারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু মাঠে সেগুলোর কোনো কার্যকর বাস্তবায়ন হয় না। এ যেন কেবল ঘোষণার দেশ, প্রয়োগের নয়। প্রতিটি হাটে সরকারি প্রতিনিধি, নিয়ন্ত্রিত ওজন ব্যবস্থাপনা, নির্ধারিত কমিশনের তদারকি, এসব কেবল কাগজে থেকে যাচ্ছে। চাষি ও আড়ৎদার একসঙ্গে বলছেন: সিদ্ধান্ত হলে কী হবে, যখন সেটা মাঠে কেউ মানে না? প্রশাসন শুধু বলে, কিন্তু দেখে না। এই নীতিহীন বাস্তবতা শুধু আম শিল্প নয়, পুরো জেলার অর্থনীতিকেই ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
স্থানীয় সমস্যা নয়, জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিণতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা যেখানে যুক্ত আছেন কৃষক, আড়ৎদার, পরিবহনশ্রমিক, রপ্তানিকারক, প্যাকেজিং কর্মী থেকে পর্যটন উদ্যোক্তারা পর্যন্ত। রপ্তানির পরিসর দিন দিন বাড়লেও ভেতরের এই নীতি-দুর্বলতা এক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা হারানোর আশঙ্কাও তৈরি করতে পারে। আমের মান, নির্ভরযোগ্যতা ও সাপ্লাই চেইন সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন মাঠের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। কী করতে হবে এখনই? উভয়ের স্বার্থেই চাই বাস্তবমুখী বাস্তবায়ন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমশিল্প আজ ক্রান্তিকালে। আম চাষি ও আড়ৎদার দুই পক্ষই সরকারি সিদ্ধান্তের ধোঁয়াশা ও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের ঘাটতিতে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রথমে কেজি দরে বিক্রির নির্দেশনায় আড়ৎদাররা বিপাকে পড়েন। পরে ঠিক হয় প্রতি কেজিতে ১.৫০ টাকা করে কমিশন পাবেন আড়ৎদাররা। কিন্তু বাস্তবে এসব সিদ্ধান্ত বাজারে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ন্যায্য দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা, আবার ব্যবসা ঝুঁকিতে পড়ছে আড়ৎদারদেরও।
সত্যটা একটাই: এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে চাষি ও আড়ৎদার উভয়ের যৌক্তিক স্বার্থ রক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মাঠে তার কঠোর বাস্তবায়ন। তবেই শোষণমুক্ত হবে বাজার, চাষি পাবে দাম, আড়ৎদার পাবে সম্মান—উপকৃত হবে সমগ্র অর্থনীতি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হারালে হারাবে পুরো দেশ আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিচয়, চাষির আশা, আড়ৎদারের আয়, রপ্তানিকারকের ভবিষ্যৎ। একটি ফলের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিহিত একটি জেলার আর্থ-সামাজিক ভিত্তি। প্রশাসনের উচিত এখনই মাটির বাস্তবতা বোঝা, মাঠ পর্যায়ের মানুষদের কথা শোনা এবং প্রতিশ্রুতি নয় বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। নইলে একদিন বলতে হবে সেই দায় কোনো কৃষক, কোনো আড়ৎদার নয় নীতি নির্ধারক ও বাস্তবায়নকারীদের কাঁধে বর্তাবে।
বিবার্তা/লিটন/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]