ডিবি হেফাজতে মৃত্যু : ‘নির্যাতন করে মারা হয়েছে’, অভিযোগ নিহতের ছেলের
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫, ২৩:১৬
ডিবি হেফাজতে মৃত্যু : ‘নির্যাতন করে মারা হয়েছে’, অভিযোগ নিহতের ছেলের
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকায় যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় মোক্তার হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে গতকাল বৃহস্পতিবার আটক করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আজ শুক্রবার সকালে ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। নিহত ব্যক্তির ছেলের অভিযোগ, তার বাবাকে পল্লবী থানায় এবং ডিবি কার্যালয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে যদিও তা অস্বীকার করা হয়েছে।


শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয় মোক্তার হোসেনকে (৪০)। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।


ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, মোক্তার হোসেনের মরদেহ ঘিরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পুলিশের একাধিক টিম কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে রেখেছে। মর্গের ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে ঢাকা জেলার একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মোক্তারের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তার স্ত্রী ও সন্তান সুরতহাল প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।


ডিবি হেফাজতে মারা যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ শুক্রবার দুপুরে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গণমাধ্যমকে জানায়, মোক্তার হোসেনকে আটকের সময় তিনি পালানোর চেষ্টা করেন। এ কারণে স্থানীয় লোকজন ধরে তাকে মারধর করেন। পরে তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। রাতে অসুস্থ বোধ করলে মোক্তারকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় এবং চিকিৎসা দেওয়ার পর আবার ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। আজ সকাল ১০টায় নাশতার জন্য ডাকাডাকি করলে তার কোনো সাড়া না পেয়ে তাকে আবার ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।


মোক্তার হোসেনের মৃত্যুর পর ঢাকা মেডিকেলে আসা তার ছেলে মৃদুল সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, আটকের পর প্রথমে পল্লবী থানার কনফারেন্স রুমে নিয়ে নির্যাতন করা হয় মোক্তারকে। নির্যাতনের ফলে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এ সময় ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের বক্তব্য চাইলেও এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।


নিহত মোক্তারের ছেলে মৃদুল জানান, গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুপুর ২টা থেকে ৩টার মধ্যে পল্লবীতে তাদের বাসার সামনের চায়ের দোকান থেকে কয়েকজন লোক মোক্তারকে ধরে দ্রুত গাড়িতে তুলে ফেলেন। জানতে পেরে তিনি এবং তার মা সেখানে আসেন। তারা দেখতে পান মোক্তারকে একটি মাইক্রোবাসের ভেতরে মারধর করা হচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পর মৃদুলকেও আরেকটি গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়।


‘সেখান থেকে তাদের নেওয়া হয় পল্লবী থানার কনফারেন্স রুমে। সেখানে বাবা-ছেলে দুজনকেই মারধর করেন ডিবি পুলিশের সদস্যরা।’


মৃদুল বলেন, আমার বাবাকে তারা পিটিয়ে হাত-পা বেঁধে একটি লাঠির সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখেন এবং তার গোপনাঙ্গে রশি দিয়ে ইট ঝুলিয়ে দেন। বাবা ডিবি পুলিশকে জানান, তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। মসি নামে একজন একটি ব্যাগে তিনটি অস্ত্র দিয়েছিল, পরে সেগুলো আরেকজন নিয়ে গেছে। কিন্তু ডিবি পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করেনি, তারা তাকে ব্যাপক নির্যাতন করতে থাকে। আজ ভোরের দিকে আমাদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বাবা অনেক চিৎকার করে কান্না করছিলেন, সেটি আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি আমার নাম ধরে ডাকছিলেন। ডিবি পুলিশ আমাকে বলে, ‘তুই এখানে শুয়ে থাক, এখান থেকে উঠবি না।’


মৃদুল আরও বলেন, সকালে দেখা যায় আমার বাবা আর নড়াচড়া করছেন না। তখন ডিউটিতে থাকা ডিবি কর্মকর্তারা বিষয়টি জানান তাদের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের। এরপর তারা আমার বাবাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। আমি তখনো ডিবি হেফাজতে ছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর সাদা কাগজে দুটি সাইন নিয়ে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। এসে দেখি আমার বাবা আর বেঁচে নেই।


ঢাকা মেডিকেলে আসা মোক্তারের স্ত্রী মুক্তা শিকদার বলেন, আমার স্বামী পালানোর চেষ্টা করেননি। তাকে চায়ের দোকান থেকেই ধরে নিয়েছে ডিবি। আপনারা সেখানে থাকা অন্য লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।


তিনি অভিযোগ করেন, তার স্বামীকে রাজনৈতিক কারণে চক্রান্ত করে মারা হয়েছে। বলেন, কয়েক ঘণ্টা আগে ডিবি আমাকে বাসা থেকে নিয়ে আসে– বলে, ‘ছেলে ডিবি অফিসে আছে, চলেন’। ডিবি অফিসের কথা বলে আমাকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিয়ে এসেছে তারা।


তিনি বলেন, বাবার সামনে ছেলেকে নির্যাতন করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তারা এখন নাটক সাজাচ্ছে।


কী বলছে পুলিশ?


পল্লবী থানার কনফারেন্স রুমে নিয়ে মোক্তার হোসেনকে নির্যাতনের বিষয়ে জানার জন্য একাধিকবার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মফিজুর রহমানকে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।


হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলামের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।


অন্যদিকে ডিবির যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলামকে মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।


সবশেষ বক্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি-মিডিয়া মো. তালেবুর রহমানের সঙ্গে।


তিনি বলেন, ‘আমাদের যে বক্তব্য ছিল সেটি আমরা দিয়ে দিয়েছি’ (শুক্রবার দুপরে)। নিহত মোক্তারের ছেলেকে কেন ডিবি হেফাজতে রাখা হয়েছিল সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’


ডিএমপির বিজ্ঞপ্তিতে যা আছে


হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ শুক্রবার দুপুরে একটি বক্তব্য দিয়েছে। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে-


সোমবার (১৭ নভেম্বর) রাজধানীর পল্লবীতে কয়েকজন অস্ত্রধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে গোলাম কিবরিয়া নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। এ ঘটনায় পাঁচ জন এজাহারনামীয় ও ৭/৮ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।


সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের লক্ষ্যে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। এই প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ঘটনার সাথে জড়িত নজরুল, মাসুম ও জামান নামে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করে এবং ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি জনৈক মো. মোক্তার হোসেনের হেফাজতে আছে মর্মে জানায়। তাদের কাছে পাওয়া তথ্য মোতাবেক মোক্তারকে আটক করতে ডিবির একটি টিম বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সন্ধ্যা আনুমানিক ০৬.০০ ঘটিকার সময় রাজধানীর পল্লবী এলাকায় একটি গ্যারেজে অভিযান পরিচালনা করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় কৌশলে তাকে আটক করা হয়। এ সময় উত্তেজিত জনতা তাকে কিল-ঘুষি মারে। পরবর্তীতে মোক্তারের দেখানো মতে পল্লবী এলাকার একটি রিকশা গ্যারেজ থেকে আট রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার করে ডিবি।


আটককৃত মোক্তার হোসেনকে (৪০) পরবর্তীতে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। রাত আনুমানিক ০১.৩০ ঘটিকার দিকে সে অসুস্থ বোধ করলে তাৎক্ষণিক তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ তাকে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কিছু ওষুধপত্র দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র প্রদান করলে পুনরায় তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।


শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল আনুমানিক ১০.০০ ঘটিকার দিকে মোক্তার হোসেনকে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করা হলে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ তাকে মৃত ঘোষণা করেন।


ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) মো. সরওয়ার, বিপিএম-সেবা এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।


বিবার্তা/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com