ট্রেনের নাম মাতভেই মাদরভ। ঊনবিংশ শতাব্দীর এক চিকিৎসকের নামে এই নাম। সেই সময় এই চিকিৎসক রাশিয়ায় ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখেন। তাই তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ট্রেনের এই নামকরণ।
কিন্তু ট্রেন কেন, তার নামে তো হতে পারত কোনো মেডিক্যাল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়, কিংবা হাসপাতাল!
ঠিক তাই। এই ট্রেনটি ট্রেন হলেও আসলে একটি হাসপাতালই। ভ্রাম্যমাণ এই হাসপাতালে আছে চিকিৎসার বেশ কিছু সুযোগ। আছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একাধিক রুম এবং ১২ থেকে ১৫ জন ডাক্তার।
এই ট্রেনটি চলে বৈকাল-আমুর মেনলাইন (বিএএম) ধরে। রেললাইনটি বৈকাল হ্রদ থেকে আমুর দরিয়া পর্যন্ত চলে গেছে বলে এই নাম। পথও একেবারে কম নয়; ২,৬৭২ মাইল। এই দীর্ঘ পথের দু’ধারে আছে কয়েক ডজন গ্রাম। প্রতিটি গ্রামে এক দিনের জন্য থামে মেডিক্যাল ট্রেন মাতভেই মাদরভ। চিকিৎসা দেয়। তারপর আবার ছুটে চলা।
এরকম একটি গ্রাম খানি। বাসিন্দা ৭৪২জন। পাশে তুষারাচ্ছন্ন স্তানভয় পর্বতমালা। গ্রামবাসী জানে ট্রেনটি কবে আসবে। তাই আগে থেকেই রেললাইনের দু’পাশে ভিড় জমিয়েছে অসুস্থ ও আহত অনেক গ্রামবাসী। যেমন, একজন মাতাল অবস্থায় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে দু’পায়ের গোড়ালিই ভেঙে ফেলেছে। আরেকজন এসেছেন তার মেয়েকে নিয়ে। তিনি ওই গ্রামের একমাত্র স্কুলটির শিক্ষক। তার মেয়ের অ্যাপেনডিসাইটিস।
খানি নামের গ্রামটির কথা আরো কিছু বলি। গ্রামটিতে সারি সারি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। প্রতিটিই পাঁচতলা। তাতে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। তবে বেশিরভাগ অ্যাপার্টমেন্টই খালি। গ্রামে চিকিৎসার ব্যবস্থা বলতে আছে ছোট একটি ক্লিনিক। তাতে নেই কোনো সার্জন, নেই স্পেশালিস্ট। থাকার মধ্যে আছে সেই সোভিয়েত আমলের কিছু চিকিৎসাসরঞ্জাম এবং একজন ডেন্টিস্ট। তবে ডেন্টিস্ট হলেও তাকে সর্বরোগের চিকিৎসাই করতে হয়। এ অবস্থায় রোগে-শোকে গ্রামবাসীর একমাত্র ভরসা মাতভেই মাদরভ ট্রেন।
সেই গ্রামে আছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তাও। তার নাম নিকোলে কোলেসনিক। বয়স ২৯। ততার আগে ছয় বছর এই এর আগে গ্রামে কোনো পুলিশ ছিল না। এই গ্রামে কোলেসনিকের যে খুব ভালো লাগছে, তা মোটেও নয়। যদিও জীবনযাত্রা এখানে সাধাসিধে। লোকজনও ভালো। বন্ধুত্বপরায়ণ। পথ চলতে দেখা হলেই কোলেসনিককে বিনয়ের সাথে অভিবাদন জানায়। সবই ঠিক আছে, কিন্তু তবুও ভালো লাগে না কোলেসনিকের।
লাগবে কেন? এখানে আসার এক মাসের মাথায় তার একমাত্র বুটজোড়া ছিঁড়ে গেছে। নতুন আরেক জোড়া যে কিনবে, তারও কোনো উপায় নেই। দোকান কোথায়? দোকান আছে সেই রাজধানীতে। ট্রেনে যেতে ও আসতে ২০ ঘণ্টার ধাক্কা।
শুধু কি তাই! আরো আছে। কোলেসনিক এখানে কী করবে? এই গাঁয়ে কোনো হাজতখানা নেই। কোনো বড় অপরাধীকে গ্রেফতার করে রাখবে কোথায় কোলেসনিক! এখানে কোনো গাড়ি চলে না। যদি চলত, তবে তো কেউ মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালালে তাকে ধরা যেত। এখানে কোনো মর্গ নেই। ডেথ সার্টিফিকেট দেয়ার মতো ডাক্তার নেই। কেউ মরল তো ফেলে রাখে রেললাইনের ধারে ইটের তৈরি পুরনো ওয়্যারহাউজে। খবর পেয়ে ট্রেনে করে ডাক্তার আসবে, দেখবে। তারপর ডেথ সার্টিফিকেট দিলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।
আরো আছে। কোলেসনিকের গার্লফ্রেন্ড তিন দিন আগে তাকে ফেলে চলে গেছে। সাথে নিয়ে গেছে তাদের সাত বছর বয়সী মেয়েটিকেও। বলেছে, ‘আমি জীবনে আর কখনো এখানে আসব না। গ্রামের নামে খানি বটে, তবে ঝামেলা একটুখানি নয়, অনেকখানি।
এই গ্রামকে ছুঁয়ে যাওয়া বিএএম ট্রেন লাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয় গত শতাব্দীর মধ্য সত্তর দশকে, শেষ হয় আশির দশকের গোড়ার দিকে। এটাই ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ বৃহত্তম নির্মাণ প্রকল্প। প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানবজাতির বিজয় পতাকাস্বরূপ এই রেললাইনটি সোভিয়েত প্রকৌশলবিদ্যা ও জনগণের ইচ্ছার স্মারক হয়ে আছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ বিএএম রেলপথ নির্মাণের একটা বিরাট অংশ দিয়েছিলেন শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টির যুবশাখা কমসোমলকে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৪ সাল এই দীর্ঘ সময়ে এর নির্মাণপর্বে অংশ নেয় পাঁচ লাখ লোক। নির্মাণকাজের শ্রম ও ক্লান্তির পাশাপাশি নির্মাণকর্মীদের জন্য ছিল বনভূমিতে কাঠের ব্যারাকে রাতযাপনের রোমাঞ্চ। আর ছিল তৎকালীন গড় বেতনের তিন গুণ বেশি বেতন। অনেককে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, যদি তারা টানা তিন বছর প্রকল্পে কাজ করে, তবে মেয়াদ শেষে পাবে একটি নতুন প্রাইভেট কারের ভাউচার। প্রাইভেট কার, কমিউনিস্ট দেশে এ যেন রূপকথার রাজকন্যা পাওয়া!
তারপর সত্যি সত্যিই পৃথিবীর ওই অংশে রূপকথার মতো কিছু ঘটনা ঘটে গেল। বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়ে ১৯৯১ সালে এক দিন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সাথে সাথে বিএএম রেলপথ নির্মাণের অর্থের উৎস ও উৎসাহও উধাও হয়ে গেল। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওই এলাকাকে গ্রাস করল পানাসক্তি, দারিদ্র্য। এলাকাটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। অনেক লোক এলাকা ছাড়ল। যারা রইল, তারাও বিরূপ পরিবেশে কেমন যেন বুড়িয়ে গেল।
যাবে না-ই বা কেন, শীতে এই এলাকার তাপমাত্রা নেমে আসে হিমাঙ্কের নিচে। গ্রামে গাড়ি চলার মতো কোনো রাস্তা নেই। পথ বলতে আছে শুধু রেলপথ। রেলপথের দু’ধারের গ্রামগুলো যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তা এখানে স্বাস্থ্যসেবা বলতে যে কিছু থাকবে না, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে!
এই বিচ্ছিন্ন স্থলদ্বীপগুলোতে তবুও সীমিত স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রত্যেক মাসে আসে মাতভেই মাদরভ ট্রেন। ট্রেনের ডাক্তাররা কিছু সার্জারি করেন। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন আর চিকিৎসা করেন। এই মেডিক্যাল ট্রেনটাই দেশের বাকি অংশের সাথে এলাকাবাসীর যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এই ট্রেন ওই এলাকাবাসীকে যেন বলে, তোমরা যে আছ তা রাশিয়া জানে। তোমাদের কথা রাশিয়া ভুলে যায়নি এবং কোনো-না-কোনো একভাবে, জীবনে ও মরণে, তোমাদের পাশেই আছে।
বারকাকিত শহরের কথা
বিএএম রেলপথ নির্মাণকর্মীদের থাকার জন্য ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময় গড়ে তোলা হয় বারকাকিত শহরটি। শহরই বা তেমন কী, গোটাকয় রাস্তা আর তার দু’পাশে কিছু অ্যাপার্টমেন্ট। অ্যাপার্টমেন্টগুলোর রঙ ক্ষয়ে গেছে। অবস্থাও নড়বড়ে। মনে হয়, জোরে ক’টা ধাক্কা দিলেই বুঝি হুড়মুড় করে গুঁড়িয়ে যাবে।
এই শহরেরই বাসিন্দা মিখাইল জদানোভিচ। এক সময় সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। বয়স এখন ৬১। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন মেডিক্যাল ট্রেনের অপেক্ষায়। বললেন, সে সময় কয়েক হাজার তরুণ নির্মাণকর্মী গাদাগাদি করে বানানো এই বাড়িগুলোতে থাকতেন। শহরে ছিল একটি রাস্তা। আসলে ওটিও রাস্তা বলতে যা বোঝায়, সেরকম কিছু নয়। তবুও সবাই ওটিকেই ‘রাস্তা’ বলত।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জদানোভিচ বলেন, জীবন ছিল খুব কঠিন, কিন্তু আবার সহজ সরল ও মজাদার। তাপমাত্রা চলে যেত হিমাঙ্কের নিচে, কাজ চালিয়ে যাওয়াটা হতো বেজায় কষ্টের। কিন্তু দিনভর কাজ শেষে সন্ধ্যায় জমত পার্টি। কনিয়াক ও সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আমরা সব কষ্ট ভুলে যেতাম। স্কুলে শিশুদের টিফিন দেয়া হতো ক্যাভিয়ার মাখানো পাউরুটি। শহরে যে দু-চারটি দোকান ছিল তাতে এমন সব পণ্য পাওয়া যেত, যা সোভিয়েতের অন্য কোথাও মিলত না। যেমন, জাপানি কাপড় কিংবা হাঙ্গেরিয়ান জ্যাম। শ্রমিকদের খুশি রাখতে সোভিয়েত সরকার এসবের ব্যবস্থা রাখত।
অথচ গত ২০ বছরে এই শহরে নতুন কোনো শপিং সেন্টার বা অ্যাপার্টমেন্ট টাওয়ার কিংবা মুভি থিয়েটার হয়নি। মুক্তবাজার অর্থনীতির যেসব সুবিধার কথা বলা হয়েছিল তার কিছুই মেলেনি, বরং মাঝখান থেকে সোভিয়েত পদ্ধতির অনেক সুবিধা (যেমন, কৃষ্ণসাগরের তীরে কম খরচে ছুটি কাটানো) উধাও হয়ে গেছে। জদানোভিচ তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমাদের এখন আর কোনো দাম নেই।
বারকাকিত শহরে আসার এক বছরের মাথায় এক বেকারিতে এক নারীর দেখা পান জদানোভিচ। প্রথমে পরিচয়, পরে প্রণয় এবং পরিণয়। জদানোভিচ এখন স্থানীয় রেল ডিপোতে রিপেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন। তিন বছর আগে একটি ট্রেনকারকে ঠেলে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় তার কাঁধের হাড়গুলো স্থানচ্যুত হয়ে যায়। স্টেট রেলওয়ে এজেন্সির কর্তাব্যক্তিরা তাকে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলেন এবং অনুরোধ করেন যেন তিনি বিষয়টি ওপরে না জানান। তারপর থেকে প্রায় অচল ও ব্যথাভরা কাঁধ নিয়েই জীবনযাপন করছেন। তবে তার অবস্থা এমন নয় যে, তিনি দীর্ঘ রেলভ্রমণের অনুপযুক্ত। এ অবস্থায় এক দিন তিনি মেডিক্যাল ট্রেনের জেনারেল সার্জনের কাছে যান। সার্জন রেলের কর্তাদের কাছে চিঠি লিখে দেন যে, জদানোভিচ এখনো ভারী কাজে সক্ষম নন। কিন্তু কর্তারা ওসবে কান দিতে রাজি নন।
পরদিন ট্রেন থামল পাহাড়ি গ্রাম জোলোতিনকায়। এই গ্রামে পাহাড়ের ওপর বানানো অ্যাপার্টমেন্টগুলোর অর্ধেকই খালি। ২০১২ সালে এখানকার ট্রেনের টিকিটঘরটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তার পর থেকে গ্রামটি একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন এখানকার কোনো বাসিন্দা বিএএম রুটের ট্রেনে ভ্রমণ করতে চাইলে তাকে ৪৫ মাইল দূরে গিয়ে টিকিট কিনে আনতে হবে। ফলে একান্ত বাধ্য না হলে এখানকার কেউ সহজে কোথাও যেতে চায় না। মেডিক্যাল ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ একজন তো বলেই ফেললেন, সোভিয়েত ইউনিয়নটা যদি আর বছর-দুই কষ্টেসৃষ্টে টিকে থাকতে পারত, তাহলে এই রাস্তাটা হয়ে যেত।
মেডিক্যাল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিল এক কিশোরী। তার নাম আনিয়া। লম্বা চুল। পরনে গোলাপি রঙের জ্যাকেট। আনিয়ার ছোট শহর ভালো লাগে না। তার পছন্দ বড় শহর। অবশ্য সে এ পর্যন্ত বড় শহর বলতে দেখেছে চীন সীমান্তবর্তী ব্লোগোভেশচেনস্ক। ওই মফস্বল শহরটির লোকসংখ্যা দুই লাখের মতো। আনিয়া বলে, ‘আমি মাকে বলেছি, স্কুলের পড়া শেষ হওয়ামাত্রই আমি কিন্তু মস্কো চলে যাবো।’ আনিয়া কল্পনা করে, মস্কো হচ্ছে এমন একটি বড় নগর, যেখানে বড় বড় খোলা চত্বর আছে। ছবি তোলার মতো অনেক জায়গা আছে। চূড়ায় ঘড়ি লাগানো অনেক টাওয়ার আছে। অবশ্য আনিয়ার সবচেয়ে পছন্দ লন্ডন। সে লন্ডনে স্থায়ী হতে চায়। সেখানেও বড় ঘড়ি লাগানো একটি টাওয়ার আছে, তাই।
মেডিক্যাল ট্রেনে কিভাবে যেন এক সপ্তাহ কেটে গেল। এর মধ্যে ট্রেনের পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম : রেললাইনের দু’পাশে সবুজ পাইন বনের সমারোহ। ট্রেনের ঘুমপাড়ানিয়া কপ কপ কপ শব্দ। প্রতিদিন তিনবেলা খাবার দিয়ে যায় ভিতিয়া নামের যুবক কুক। প্রতিদিন ঘুম ভাঙে ক্ষুধা নিয়ে। আর তখনই উদয় হয় জ্যামসহযোগে ভাজা ব্লিনিয়া হাতে ভিতিয়া। ডাক্তাররা খেতে খেতে রোগীদের নিয়ে নানা গল্প করে।
চলতে চলতে কোনো-না-কোনো গ্রামে ট্রেন থামে। ডাক্তাররা রোগী দেখেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। বহু রোগীর মুখে আমি এই ট্রেনের ডাক্তারদের সততা ও দক্ষতার প্রশংসা শুনেছি। তবে মাঝে মধ্যে ভিন্ন চিত্রের কথাও কানে এসেছে। যেমন, রোগীরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু লাইন এগোচ্ছে খুব ধীরে। এর কারণ দুটো হতে পারে। প্রথমত, ডাক্তাররা আমলাতান্ত্রিক কায়দায় যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সারেন। দ্বিতীয়ত, তারা চান রোগী দেখার নির্ধারিত সময়টা পার করতে। তাহলে বাকি যারা থাকবে, তাদের ডাক্তারকে ফি দিতে হবে।
ডাক্তারের পরামর্শ, চিকিৎসা সবকিছুই ট্রেনেই হয়। তবে কোনো কোনো সময় ডাক্তারকে কোনো বাড়িতেও রোগী দেখতে যেতে হয়। এক দিন ডা মিরোশনিচেনকোকে লোপছা গ্রামে সে রকম একটা কলে যেতে হলো। গ্রামে রাস্তা বলতে একটা - খানাখন্দে ভরা, কাদামাখা। সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চললেন ডাক্তার। পৌঁছে গেলেন কনক্রিটের তৈরি একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে, পুরো রেলপথের দু’ধারে যে রকম আছে, হুবহু সেরকম। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে চার তলার ফ্যাটে রোগী। দরজা খুলে দিলেন গৃহকর্ত্রী ভেরা পোপোভা (৬৭)। তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন পেছন দিকের বেডরুমে। সেখানে বিছানায় শুয়ে আছে রোগী - গৃহকর্ত্রীর ছেলে অ্যালবার্ট (৪৫)।
২০০৭ সালের গোড়ার দিকে একটি পরিত্যক্ত অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের কড়িকাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ পা ফস্কে ছয় ফুট নিচে পড়ে যায় অ্যালবার্ট। সেখান থেকে আর উঠে আসার শক্তি পায় না সে। অবশেষে তার বন্ধুরা দেখতে পেয়ে তাকে তুলে আনে এবং হাসপাতালে ভর্তির জন্য একটি ট্রেনে তুলে নেয়। পাঁচ ঘণ্টা ট্রেন জার্নির পর হাসপাতালে পৌঁছায় সে। ততক্ষণে সে প্যারালাইজড হয়ে গেছে। ডাক্তাররা তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় আর সরকার তাকে সার্টিফিকেট দেয় যে, সে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। অ্যালবার্ট ভাবে, এটা তো চিকিৎসা হলো না, কারাগারে ভরা হলো।
এখন বেচারার দিন কাটে টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটে চ্যাট করে। মা তাকে গোসল করিয়ে দেন। পিঠ ও পা মালিশ করে দেন। সে টয়লেটে যেতে পারে না। ডায়াপার ব্যবহার করতে হয়। মা সেগুলো বদলে দেন।
এ অবস্থায় এক দিন তার এক বন্ধু খবর দেয় সাইবেরিয়ার ক্রাসনোইয়ারস্ক শহরে এর ভালো চিকিৎসা আছে। গেল সেখানে। ডাক্তাররা কিছু ব্যায়াম শিখিয়ে দিলেন, যাতে শরীরে শক্তি ফিরে পাওয়া যায়। সেগুলো করে অ্যালবার্ট এক দিন সত্যিই হাঁটতে সক্ষম হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, শেষ দিকে এক দিন হাঁটতে গিয়ে হাঁটু ভেঙে গেল তার। সেই থেকে বিছানায় শুয়ে আছে বেচারা। অবশ্য আরো একজন ডাক্তার আছেন। তিনি থাকেন তিন্দা শহরে। ট্রেনে গেলে পাঁচ ঘণ্টার জার্নি। তার ওপর আছে তাকে ওই পর্যন্ত আনা-নেয়ার জন্য বন্ধুদের সাহায্য চাওয়া। তা ছাড়া পাঁচ ঘণ্টার ট্রেন জার্নিও কম ঝামেলার নয়। এসব করতে আর ভালো লাগে না অ্যালবার্টের। সে আর কোনো ঝামেলায় যেতে রাজি নয়। তাই তার মা মেডিক্যাল ট্রেনের ডাক্তারকে ডেকেছেন, যদি তিনি একবার এসে একটু দেখে যান!
ডাক্তারের কাছে মা ও ছেলে জানতে চান, হাঁটুটি আর ভালো হবে কি না এবং যেসব ব্যায়াম করে সুস্থ হওয়া যাবে, তা বাড়িতে করা যাবে কি না। ডাক্তার মিরোশনিচেনকো তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তাকে ভালো করে দেখলেন, তার একটি পা ওপরে-নিচে ওঠালেন ও নামালেন। তারপর বললেন, তুমি দাঁড়াতে পারবে। এটার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াও তো দেখি। হ্যাঁ, ঠিক আছে। এবার আস্তে আস্তে সামনে এগোও।
ঘটনা দেখে অ্যালবার্টের মা হতবাক। তারপর খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলেন। এরপর দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন ডাক্তারকে আর বলতে থাকলেন, ‘হ্যাঁ ঈশ্বর! তোমাকে ধন্যবাদ, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
ফেরার সময় ডাক্তারের কাঁধে জোর করে ঝুলিয়ে দিলেন একটি কাগজের ব্যাগ। ওতে দু’টি ভাঁপা মাছ আছে।
লারবা নামের গ্রাম
বিএএম রেলপথের দু’ধারে এসব গ্রাম তৈরি করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কর্মীদল। তারা এসেছিল উরাল পর্বতমালার পাদদেশ থেকে, জর্জিয়া থেকে, সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং অন্য আরো অনেক স্থান থেকে। লারবা নামে গ্রামটি এভাবে গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত তুর্কমেনিস্তান থেকে আসা কর্মীদের শ্রমে। সেই কর্মীদের একজন এখনো গ্রামটিতে আছেন। তার নাম আবদিকেরিম মুখামেদ মাজরোভিচ (আবদুল করিম মোহাম্মদ মাজহার?)। বয়স এখন ৪৯। সরু গোঁফে রুপালী রঙ ধরেছে। গ্রামের গোরস্থানটি দেখিয়ে বললেন,
তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের বড় অসুখ বলতে একটাই’... বলেই তিনি মাতলামির রুশ ভঙ্গিটি দেখালেন। বললেন, ‘আসতকে দেখুন, পান করেই চলেছে। তুয়েভ তো স্পিরিটের আগুনে পুড়েই মরল। সার্গেই মাতাল অবস্থায় একবার ট্রেনের ধাক্কা খেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গেল। তবুও তার নেশা কাটে না। লিলিয়া পান করেই চলেছে। নেতুকভ তো মাতাল হয়ে নদীতে ডুবেই মরল।’
আবদুল করিম তার বৌয়ের কথাও বললেন। তারও একই সমস্যা - পানাসক্তি। বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালেন। বললেন, চলুন নদীর ওপারে যাওয়া যাক। সোভিয়েত জেনারেলদের ফেলে যাওয়া দাচা (গ্রামীণ রীতিতে নির্মিত কুটির) দেখবেন।
ফেলে আসা দিনের স্মৃতি
মাদরভ ট্রেনের শেষ গন্তব্য কুভিকতা। সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা, প্রকৃতি বৃষ্টিমুখর। ট্রেনটি ছাড়ার পর তিন সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। টানা ভ্রমণে ডাক্তাররাও ক্লান্ত।
এমন দিনে কী করা যায় - ভাবতে ভাবতে ট্রেনের নিউরোলজিস্ট আলেক্সান্দার কোমারভের কক্ষের সামনে পা থেমে যায়। ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তখনও তিনি ডাক্তার হননি, কোমারভকে কমসোমল ব্রিগেডের সাথে এই গ্রামে পাঠানো হয়েছিল। তারা বিএএম রেলপথ নির্মাণে কাজ করেছিলেন। এরপর ৩০ বছর কেটে গেছে, এই গ্রামে তার আর আসা হয়নি।
কত বছর আগের কথা! কোমারভের বয়স তখন ২২ বছর। সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক ট্রেনিং শেষে সবে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকেছেন। এক দিন তাদের বলা হলো, ‘তোমরা কি মাতৃভূমির ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করতে চাও না? যদি চাও, তো যাও বিএএম রেলপথ নির্মাণে কিছুদিন শ্রম দিয়ে এসো।’
কোমারভের মনে হলো, কেন নয়? গোটা দেশ এই কাজে জড়িয়ে গেছে। আমি কেন বাদ থাকব?
কমসোমল ব্রিগেডের সাথে এভাবে এক দিন চলে এলেন এই গ্রামে। নদীর তীরে অস্থায়ী তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা। যেদিকে চোখ যায়, পাহাড় আর পাহাড়। নিঃসীম নির্জনতা। কোথাও একটা লোক পর্যন্ত দেখা যায় না। মনে হয় যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। কঠিন কিন্তু রোমান্টিক জীবন : ভোর ৬টায় ঘুম থেকে ওঠা। দাঁত ব্রাশ করতে করতে নদীতে গিয়ে মুখ-হাত ধোয়া। ফিরে এসে তরুণ কর্মীদলের সাথে বসে সকালের নাশতা সারা। দিনভর কাজ, ফাঁকে ফাঁকে কৌতুক বলে দলশুদ্ধ হেসে ওঠা। গ্রীষ্মের সূর্যের তাপে চামড়া ট্যান করা (বাদামি করা)। রাতে তাঁবুতে আগুন জ্বালিয়ে গিটারে সুর তোলা। এভাবেই কেটে যায় কিছু দিন।
কিন্তু তাঁবুটি ঠিক কোথায় ছিল? অনেক হেঁটেও কোমারভ তার হদিস খুঁজে পান না। দেখেন, ইট তৈরির একটা কারখানা পরিত্যক্ত পড়ে আছে। কোমারভের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, ‘আমাদের সবার এত শ্রম, সব ব্যর্থ হয়ে গেছে।’
তার গলা শোনায় হাহাকারের মতো, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম, আমরা লড়াই করেছিলাম একটা কিছু অর্জনের জন্য। কিন্তু আজ কী হলো, হলো এই যে, আমাদের কাজটি কারো কোনো কাজে লাগছে না।’
কাদায় ভরা, ভাঙাচোরা পথটি আমাদের নিয়ে গেল নদীর তীরে। বিষণ্ণ, অন্যমনা কোমারভ কিছু নুড়িপাথর তুলে নিলো হাতে। তার মনে কী ঝড় বইছে কে বলবে? সে কি স্মৃতি খুঁড়ে জাগাতে চাইছে তার তরুণ বেলার সেসব দিনকে, যখন সে এখানে থাকত, কাজ করত, হাসত, গান করত! বিড় বিড় করে বলল, জায়গাটা এটাই হবে। নাকি নয়, কে জানে!
আমরা কয়েক মিনিট নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ছোট নদীটি বয়ে চলেছে ধীরে, যেমন বইত কোমারভের তরুণবেলায়, কমসোমল ব্রিগেডের বিপুল কর্মযজ্ঞের সময়ও। সেই কর্মযজ্ঞ, সেই তারুণ্যের কলস্বর থেমে গেছে। কিন্তু নদীটি তো আর থামতে পারে না। সে বয়েই চলে।
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]