সংস্কারে নতুন প্রাণ পাচ্ছে ঐতিহাসিক ঢাকা গেইট
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৪২
সংস্কারে নতুন প্রাণ পাচ্ছে ঐতিহাসিক ঢাকা গেইট
মো. ছাব্বিরুল ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের কার্জন হল থেকে দোয়েল চত্বরের পাশ দিয়ে বাংলা একাডেমির দিকে যেতে এমন লোক হয়তো কমই পাওয়া যাবে- যে রোড ডিভাইডারের মাঝখানে একটি পুরনো বিশালাকৃতির হলুদ রঙের স্তম্ভ দেখেনি। এই স্তম্ভটি আসলে কী, এর নাম আর ইতিহাসের খোঁজ ক'জন রাখে সেটা বলা মুশকিল।


ইতিহাস


এই স্তম্ভটি ১৬৬০ খ্রি. থেকে ১৬৬৩ খ্রি. এর মধ্যে নির্মিত মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন মীর জুমলা গেইটের অংশ। এর বাকি দুটি অংশের একটি রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে এবং অপরটি রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে তিন নেতার সমাধিসৌধের পাশে। এই স্তম্ভটি একটি গেইট। এই গেইটটি ঢাকা গেইট, রমনা গেইট এবং ময়মনসিংহ গেইট নামেও পরিচিত।


মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলার সুবেদার ছিলেন মীর জুমলা (১৫৯১-১৬৬৩ খ্রি.)। তিনি ঢাকাকে স্থলপথে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ও এর সীমানা চিহ্নিত করতে এই তোরণ নির্মাণ করেন। আর গেইটসংলগ্ন এলাকায় ‘বাগ-ই-বাদশাহি’ নামক একটি বাগান তৈরি করেন। উদ্যানটি ইসলাম খাঁর আমলে ছিল রমনা অঞ্চলে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও পুরনো হাইকোর্ট)। বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে ঢাকার প্রবেশমুখ হিসেবে ব্যবহার হতো এই তোরণ।


ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলার সুবেদার ও সাম্রাজের সেনাপতি ইসলাম খাঁর (প্রকৃত নাম শেখ আলাউদ্দিন চিশতি, ১৫৭০-১৬১৩ খ্রি.) যুগে এটি পুননির্মাণ করে নামকরণ করা হয় ঢাকা গেইট।



হাইকোর্ট ভবনের পূর্বকোণে একই ধরনের দুটি স্তম্ভবিশিষ্ট প্রবেশপথ ছিল। মূলত সেই সময় এ স্তম্ভের মধ্য দিয়ে ছিল হাতির চলাচলের পথ। ব্রিটিশ আমলে জায়গাটি ঘোড়াদৌড়ের জন্য ব্যবহৃত হতো- নাম ছিল ‘রেসকোর্স ময়দান’। বর্তমানে এই ময়দান ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’ হিসেবে পরিচিত।


তোরণের স্তম্ভগুলো পরীক্ষা করেন এ. এইচ. দানী। তার মতে, এগুলো মুঘল আমলে তৈরি হয়নি। কারণ স্তম্ভ দুটির গড়ন ইউরোপীয় ধাঁচে মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য রেসকোর্সের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি রাস্তা তৈরি করেন তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস। এ রাস্তার প্রবেশমুখে ডস এ দুটি স্তম্ভ তৈরি করেন। যা এখনও অটুট রয়েছে। বর্তমান নজরুল এভিনিউর রাস্তাটিও ডস তৈরি করেন। 'বাগে বাদশাহী' নামে মোগল উদ্যানটি ইসলাম খাঁর আমলে ছিল রমনা অঞ্চলে (যেটি বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও পুরনো হাইকোর্ট ভবন)। হাইকোর্ট ভবনের পূর্ব কোণে একই ধরনের দুটি স্তম্ভবিশিষ্ট প্রবেশপথ ছিল। মূলত সে সময় এ স্তম্ভের মধ্য দিয়ে চলাচল ছিল হাতির।


গঠন


প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধ এ ধরনের স্তম্ভ খুবই বিরল। যার ওপরে রয়েছে কারুকাজ করা চারকোনা বিশিষ্ট একটি শেড। পশ্চিম পাশের বড় স্তম্ভের পাশেই রয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটি স্তম্ভ। যার মাঝে টানা অবস্থায় রয়েছে একটি দেয়াল। উঁচু থেকে নিচুতে নামা এ দেয়ালটি প্রায় ২০ ইঞ্চি চওড়া। কিন্তু পূর্ব পাশের বড় স্তম্ভের সঙ্গে দেয়াল বা প্রাচীর থাকলেও নেই ছোট স্তম্ভ।


নামকরণ


মুঘল আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে ব্যবহার করা হতো এ তোরণ। সেই সময় এর নাম ছিল 'মীর জুমলার গেইট'। পরে কখনও 'ময়মনসিংহ গেইট', কখনও 'ঢাকা গেইট' এবং অনেক পরে নামকরণ করা হয় 'রমনা গেইট'। এ গেইট রমনায় প্রবেশ করার জন্য ব্যবহার করা হতো বলে পরে সাধারণ মানুষের কাছে এটি রমনা গেইট নামেই পরিচিতি পায়। তবে বাংলাদেশ সরকারের গেজেট অনুসারে এ তোরণ এবং আশপাশের জায়গার নাম দেওয়া হয়েছে 'মীর জুমলার গেইট'


ব্রিটিশ সময়কার ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডয়'স মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে সংযুক্ত করার জন্য ময়দানের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি সড়ক তৈরি করেন। এই সড়কের প্রবেশপথে তৈরি করা হয় দুটি স্তম্ভ। অপর এক তথ্যে বলা হয়েছে, ইসলাম খাঁর আমলে রমনা অঞ্চলে ছিল বাগে বাদশাহী নামে মুঘল উদ্যান। বাগে বাদশাহীর প্রবেশপথে ছিল দুটি স্তম্ভ। পরে তা পুননির্মাণ করে নামকরণ করা হয় ময়মনসিংহ গেইট।


সংস্কার


বহু বছরের অযত্ন অবহেলায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে এর নান্দনিকতা। মুছে যেতে থাকে শেষ চিহ্নটুকুও।



এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে আবারও নতুন করে পুরনো নান্দনিকতা ফিরিয়ে দিতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের অধ্যাপক স্থপতি ড. আবু সাঈদের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ দল এর সংস্কারের জন্য নতুন একটি নকশা তৈরি করেছে। এই নকশার আদলে এই স্থাপনার সংস্কার কাজ করা হবে।


স্থপতি ড. আবু সাঈদ বিবার্তাকে জানান, যদিও ‘ঢাকা গেইট’কে মীর জুমলার গেট বলা হয়ে থাকে কিন্তু এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ আমলে ম্যাজিস্ট্রেট ডয়লির সময় এই গেইট তৈরি করা হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রমাণ মেলে। এই গেইটের এখন তিনটি অংশ দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু শুরুতে এমনটি ছিল না। শুরুতে রাস্তাটি এক লেনের হওয়ায় গেটের দুটি অংশ ছিল। পাকিস্তান আমলে ৬০-এর দশকে রাস্তাটি যখন দুই লেন করা হয় তখন এর একটি অংশ ভেঙে ফেলা হয়। তিন নেতার মাজারের অংশটি নতুন করে তৈরি করা হয়। দুই রাস্তার মাঝের পিলারটি সেই ভাঙা অংশেরই একটি অংশ।


তিনি আরও বলেন, আদি যে চুন-সুরকির প্লাস্টার দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল সেই একই উপকরণ দিয়েই আমরা এটি সংস্কার করব। আদি ডয়লির অংশটা থাকবে ৬০ দশকের অংশটাও থাকবে। ওসমানী উদ্যান থেকে মীর জুমলার কামানটাও নতুন করে এনে স্থাপন করা হবে।


বিবার্তা/ছাব্বির/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com