সালাম মুর্শেদীকে ‘জাল নথি’ বানিয়ে জমি দেয় রাজউক!
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৫০
সালাম মুর্শেদীকে ‘জাল নথি’ বানিয়ে জমি দেয় রাজউক!
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানীর গুলশানে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন খুলনা-৪ আসনে সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে)'র সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী। চলতি বছরের শুরুতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গঠিত তিন সদস্যের কমিটি অবৈধ দখলকৃত প্লটটি অবিলম্বে সরকারের দখলে আনয়ন করা ও একইসাথে তৎকালীন এ জাল জালিয়াতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ করে।


গত বছরের ৩০ অক্টোবর সরকারি সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়ে বাড়ি বানানোর অভিযোগে খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এ বিষয়ে অনুসন্ধান প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিলের কথা থাকলেও, বারবার সময় নিয়েছে দুদক। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দুদকের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে হাইকোর্টে। সেখানে বলা হয়, গুলশান আবাসিক এলাকার বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেখিয়ে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নামে জাল চিঠি তৈরি করে প্লটটি সালাম মুর্শেদীকে বরাদ্দ দিয়েছে রাজউক। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।


গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চিঠি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির ইস্যুকৃত স্মারকের (স্মারক নং-৯/১পি-গুল-১০০/৭৬/২৮) নথি মন্ত্রণালয়ে রক্ষিত নথি এন্ট্রি রেজিস্টারে পাওয়া যায়নি। ১৯৯৬ সালের ইস্যু রেজিস্টার পাওয়া গেলেও ওই স্মারকযুক্ত কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি বলে অবহিত করেছে মন্ত্রণালয়ের অধি-শাখা। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদীকে গুলশানের সম্পত্তি বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে তাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।


গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএন (ডি) ব্লকের ১০৪নং রোডের ২৯নং হোল্ডিংস্থিত ২৭নং প্লট/বাড়ি পরিত্যক্ত ‘খ’ তালিকা হতে অবমুক্তির জন্য ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এ মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুস সালাম মুর্শেদীর আবেদন করেন। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল পরিত্যক্ত বাড়ির তালিকা থেকে বাড়িটি অবমুক্ত না হওয়ার পরও আব্দুস সালাম মুর্শেদী কীভাবে বাড়িটি দখল করে আছেন- রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর চেয়ারম্যানের কাছে সেই ব্যাখ্যা চায় পূর্ত মন্ত্রণালয়। সে চিঠি আমলে না নেয়ায় ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি ও গত বছরের ৪ জুলাই আবার রাজউক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।


এরপর গত বছরের ২২ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের চিঠির প্রেক্ষিতে ৮ সেপ্টেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখা-৯ এর যুগ্মসচিব মো. মাহমুদুর রহমান হাবিবকে আহ্বায়ক করা হয়। এছাড়া কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) মুহম্মদ কামরুজ্জামান এবং সদস্য হিসেবে ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং শাখা-১১ এর উপসচিব জহুরা খাতুন। দুর্নীতি দমন কমিশনের পত্রের প্রেক্ষিতে এ কমিটি গঠন করা হয়।


গত ১৩ সেপ্টেম্বর কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর কমিটি বর্ণিত প্লটের মূল নথি প্রেরণের জন্য রাজউক চেয়ারম্যান অনুরোধ করে। বর্ণিত প্লটের ১৯৬৩ সালে সম্পাদিত ৪৫০নং লিজ দলিলের সার্টিফাইড কপি, ১৯৭৫ সালে সম্পাদিত ২২৬৪১নং বিক্রয় দলিলের সার্টিফাইড কপি; এবং গুলশান মডেল টাউনের ব্লক ওয়াইজ অনুমোদিত নকশার প্রতিলিপি প্রেরণের জন্য রাজউক চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা হয়। বর্ণিত এসব প্রয়োজনীয় নথি/কাগজপত্রাদি রাজউকসহ অন্যান্য দফতর/সংস্থা হতে যথাসময়ে সরবরাহ করতে না পারায় তদন্ত কার্যক্রম যথাসময়ে শেষ হয়নি বলে প্রতিবেদনে জানা যায়। সর্বশেষ তদন্ত কমিটি প্লটটি সরেজমিন পরিদর্শন করে গত ২০ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করেছে।


আরো পড়ুন: গুলশানে অবৈধভাবে বাড়ি নির্মাণ সালাম মুর্শেদীর, তদন্তে প্রমাণ


কমিটি বলছে, গুলশান আবাসিক এলাকার ১০৪নং রাস্তার সিইএন (ডি) ব্লকের ২৭নং বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা হতে অবমুক্ত ব্যতিরেকে যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে তার বৈধতার বিষয়ে সুস্পষ্ট দালিলিক প্রমাণাদি অনুপস্থিত। সৃজিত কাগজপত্রের আলোকে তর্কিত বাড়িটির হস্তান্তর প্রক্রিয়া বিধিসম্মত হয়নি। এমতাবস্থায়, অবৈধ দখলভুক্ত প্লটটি অবিলম্বে সরকারের দখলে আনয়ন করা যেতে পারে। একই সাথে তৎকালীন এ জাল জালিয়াতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।


এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সদস্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং শাখা-১১ এর উপসচিব জহুরা খাতুন বিবার্তাকে বলেন, আমরা প্রতিবেদন জমা দিয়ে দিয়েছি। এই বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না।


১২ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার দুদকের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে দেয়া প্রতিবেদনের বিষয়ে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, এখানে কিছু দুর্নীতি হয়েছে, সেটা পরিষ্কার। তবে এ দুর্নীতিতে কার কতটুকু দায়বদ্ধতা, কার কতটুকু সংশ্লিষ্টতা তা অনুসন্ধান না করে বলা যাবে না। হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে আমরা অনুসন্ধান করছি। যে তথ্য উপাত্ত অনুসন্ধানে পাওয়া যাচ্ছে তা আমরা হাইকোর্টকে অবহিত করছি।


২০২২ সালের ১ নভেম্বর এ সংক্রান্ত রিটের শুনানিতে ১০ দিনের মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান এবং আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে হলফনামা আকারে নথি দাখিল করতে বলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রুলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ‘খ’ তালিকাভুক্ত বাড়িটি বেআইনিভাবে দখল করার অভিযোগে আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান, দুদক চেয়ারম্যান, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে রুলের জবাব দিতে বলেন হাইকোর্ট। এরপর দুদক অভিযোগটি আমলে নেয়।


অনুসন্ধানে নেমে দুদক গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে দফায় দফায় চিঠি দিয়ে নথিপত্র তলব করতে থাকে। বেশ বেগ পেতে হয় মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র পেতে। ৬-৭ বার নোটিশ ও তাগিদ দেয়ার পর জবাব পাওয়া যায়। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে রাজউকের একাধিক সদস্য ও পরিচালকসহ ডজনখানেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।


গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বিবার্তাকে বলেন, আমি ১৯৯৭ সালে রাজউকের কাছ থেকে চতুর্থ লিজ গ্রহীতা হিসেবে সব ধরনের ফরমালিটিজ মেনে নিয়েছি। মেরিটেশন দেখা এবং এটা যে পরিত্যক্ত সম্পত্তি না সেটা দেখা রাজউকের কাজ। পরিত্যক্ত সম্পত্তি হলে রাজউক ট্রান্সফারই করতে পারবে না।


তিনি বলেন, রাজউকের প্রসিডিউর মেনে পেয়েছি। বাড়ি বানানোর পারমিশন, প্ল্যান সব রাজউক থেকে নিতে হয়। যা করণীয় সব করেছি। পরিত্যক্ত হলে তখন গণপূর্ত চিঠি দিলো না কেন? আমি অন্য জায়গায় বাড়ি বানাতে পারতাম। এখানে বানাতে হলে তো রাজউকের অনুমতি লাগে। যদি পরিত্যক্ত হতো তাহলে তো বাড়ি করতে পারতাম না।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com