অনন্য ইতিহাসের স্বাক্ষী জগন্নাথ হল
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:২৬
অনন্য ইতিহাসের স্বাক্ষী জগন্নাথ হল
মো. ছাব্বিরুল ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

বাঙালির ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসের চারণভূমি জগন্নাথ হল। এই হলের মাটি অজস্র ঘটনার স্বাক্ষী যা বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শহিদের রক্তস্নাত জগন্নাথ হল বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অপরিহার্য অধ্যায়।


জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়সহ আদিবাসী ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম যে তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল জগন্নাথ তার একটি। মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরীর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই হলের নামকরণ করা হয়। ছাত্রসংখ্যার বিচারে জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তম আবাসিক ছাত্রাবাস।



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং দেশ ভাগের সময় কয়েক বছর জগন্নাথ হলের সাথে যুক্ত ছাত্ররা ঢাকা হলে (বর্তমানে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল) বসবাস করেন। ওই সময় হল দুটি ‘ঢাকা-জগন্নাথ হল’- এই যুক্ত নামে একজন প্রভোস্টের প্রশাসনাধীনে পরিচালিত হত। ১৯৪৬ সাল থেকে সীমিত সংখ্যক ছাত্র জগন্নাথ হলে ফিরতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে জগন্নাথ হলের ছাত্রসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়ে যায়।



১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জগন্নাথ হলের নাম ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ হল অ্যাসেম্বলি হাউজে গণপরিষদের অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন সদস্য অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের সাথে যোগদান করেন। ফলে বেগবান হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষা শহিদদের স্মরণে ১৯৬৮ সালে মাঠের উত্তর-পশ্চিম দিকে উত্তর বাড়ির সামনে শহিদ মিনার স্থাপন করা হয়- যা ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানিরা ভেঙে ফেলে।



১৯৬৪ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতের জব্বলপুরে সাম্প্রাদয়িক দাঙ্গার জের ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। ১৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকা ও জেলাগুলোতে সংঘটিত একতরফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ১০ হাজার হিন্দু ধর্মালম্বীর প্রাণহানি ঘটে। হাজার হাজার হিন্দু অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনজন আইন পরিষদের সদস্যসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে জগন্নাথ হলেও ৮ শতাধিক হিন্দু ধর্মালম্বীর আশ্রয় গ্রহণ করেন। অমুসলিম হবার কারণে এ হলের ছাত্ররাও তখন নিরাপদ ছিলেন না। তা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের প্রগতিশীল ছাত্রদের সহায়তায় তারা দিনরাত অক্লান্তভাবে জগন্নাথ হলে আশ্রিতদের সেবা-শুশ্রূষা চালিয়ে যান।


বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই হলের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ জগন্নাথ হল পাকিস্তানি হানাদারদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। হানাদাররা হলের রুমে রুমে তল্লাশি চালিয়ে নির্বিচারে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী হত্যার পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে। ওই রাতে এবং পরের দিন ২৬ মার্চ ভোরে ৬৬ জনের অধিক মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তনিরা জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ির সামনের মাটিতে পুঁতে রাখে। সেই ভয়াল রাতে জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়। সেদিন যারা শহিদ হয়েছিলেন, সেই গণকবরের নামফলকে ৬৬ জনের নাম উল্লেখ আছে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রতনলাল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা: ১৯৭১ জগন্নাথ হল' বই থেকে জানা যায়- ওই রাতে সেখানে চারজন শিক্ষক, ৩৬ জন ছাত্র এবং ২১ জন কর্মচারী ও অতিথি শহিদ হয়েছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম খণ্ডে ৪১ জন ছাত্রের কথা উল্লেখ আছে- যারা জগন্নাথ হলে শহিদ হয়েছিলেন।



১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথ হলের চারজন শহিদ শিক্ষকের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব- যিনি হলের প্রভোস্ট ছিলেন। অন্যরা হলেন সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও অনুদ্বৈপ্যায়ন ভট্টাচার্য। যারা এই হলের দায়িত্বরত হাউজ টিউটর ছিলেন।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর শিক্ষক নূরুল উলা গোপনে জগন্নাথ হলে সংগঠিত গণহত্যার একটি ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। সেখানে দেখা যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হলের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সারিবদ্ধ করে গুলিবর্ষণ করছে।



উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘঠিত গণহত্যার সরাসরি ধারণকৃত এটিই একমাত্র ভিডিওচিত্র, যা কালের নির্মম সাক্ষী হয়ে আছে।



দেশ স্বাধীনের পর হলের ছাত্রদের শ্রদ্ধায়, হলের বর্তমান শহিদ মিনার ও হলের শহিদ শিক্ষক, ছাত্র এবং অন্যান্যদের স্মরণে নামফলক নির্মাণ করা হয়।


১৯৮১ সালে ইট, বালু, সিমেন্ট ও লোহার গ্রিল দিয়ে একটি গণসমাধি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ৬৬ জন শহিদের নামফলক এবং ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও গণসামাধি পুনর্নির্মাণ করা হয়।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে চ্যান্সেলর হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ওইদিন সমাবর্তনে যোগদান শেষে ক্যাম্পাসের যে কয়টি স্থান তাঁর পরিদর্শনের জন্য নির্ধারিত ছিল, সেসবের মধ্যে জগন্নাথ হল গণসমাধি ছিল অন্যতম। তাই জগন্নাথ হলকে প্রস্তুত করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন তাঁকে সপরিবার নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। জাতির পিতাকে বরণ করে নেয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেই সাথে জগন্নাথ হল।


বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জগন্নাথ হলের ছাত্রদের উপর নেমে আসে সামরিক স্বৈরাচারের অত্যাচার ও নির্যাতন। কিন্তু দমাতে পারেনি জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের। পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিটি সামরিক বেসামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন জগন্নাথ হলের ছাত্ররা।


১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় টেলিভিশন দেখার জন্য হলের অ্যাসেম্বলি হাউজের অডিটরিয়ামে ছাত্রসহ অন্যরা ভীড় করেন। অডিটরিয়ামের ছাদ বৃষ্টির জলে ভিজে ভারি হয়ে হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে। এতে হলের ছাত্র, কর্মচারী এবং অতিথিসহ মোট ৩৯ জন মতান্তরে ৪০ জনের প্রাণহানি ঘটে। প্রতিবছর ১৫ অক্টোবরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। ১৫ অক্টোবর নিহতদের স্মরণে বর্তমান ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন' নির্মাণ করা হয়েছে।


জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চায় জগন্নাথ হল:


পুঁথিগত বিদ্যার্জনের পাশাপাশি হলের ছাত্রদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নিয়মিত প্রতিনিধি নির্বাচন করে হলের ছাত্র সংসদের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শরীরচর্চা তথা খেলাধুলা প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। ১৯২২ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত জগন্নাথ ছাত্র সংসদ কর্তৃক নিয়মিতভাবে 'বাসন্তিকা' নামের বার্ষিক সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া নিয়মিত পুনর্মিলনী, খেলাধুলা এবং নাটকের আয়োজনসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যদিকে সে সময় হল প্রশাসনের উদ্যোগ এবং তত্ত্বাবধানে ছাত্ররা সমাজসেবা ও উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রণ করে। ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জগন্নাথ হল প্রতিষ্ঠার পর হীরকজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে 'বাসন্তিকা'র সর্বশেষ সংস্করণটি প্রকাশিত হয়।



বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমন:


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দশকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে- জগন্নাথ হলের দ্বিতীয় প্রভোস্ট জগদ্বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং ১৯৩৭-১৯৪২ মেয়াদকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরে উপাচার্য ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা আগমন। তিনি ওই বছর ৭ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অবস্থান করেন। বিশ্বকবিকে বিশেষ যত্নসহকারে জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের বাসভবনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া বিশেষ আয়োজনে দুইদিন বুড়িগঙ্গায় বোটে তাঁর বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ হলে বিপুল সমারোহে কবিগুরুকে সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়- হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে কবিগুরু তাতে যোগদান করতে পারেননি। তবে জগন্নাথ হলের 'বাসন্তিকা' সাময়িকীতে প্রকাশের জন্য ছাত্রদের অনুরোধে 'বাসন্তিকা' শিরোনামের বিখ্যাত গীতিকবিতা লিখে দিয়ে তিনি সংবর্ধনা সভায় অনুপস্থিতির মনোবেদনা অনেকটা পুষিয়ে দেন। স্বহস্তে লিখিত কবিগুরুর এই গীতিকবিতাটি জগন্নাথ হলসহ এ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকাশানায় অবিকল মুদ্রিত হয়ে আসছে। এটি জগন্নাথ হলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ঋদ্ধ করেছে।


পূজা পার্বণে জগন্নাথ হল:


জগন্নাথ হলে বছর ঘুরে নিয়মিত সনাতন, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো বৃহৎ পরিসরে উদযাপন করা হয়। ঢাকা ও বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জগন্নাথ হলে দর্শনার্থীদের ভীড় জমে এই পার্বণগুলোয়। বিশেষ করে স্বরস্বতী পূজোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজেদের আলাদা আলাদা পূজোমণ্ডপ ও স্বরস্বতী দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে। এসময় হলের ভেতর মেলা বসে। জগন্নাথ হলের উপাসনালয় জনসাধারণের জন্য সবসময় উন্মুক্ত রাখা হয়। জগন্নাথ হলে শীব, দুর্গা, কালী, শ্রীচৈতন্য, রাধা-কৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধের বিশালাকায় ভাস্কর্য দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। প্রতিনিয়ত সনাতন, খ্রীষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা হলে আসেন উপাসনার জন্য। অসাম্প্রদায়িকতার এক অনন্য উদাহরণ জগন্নাথ হল।


ভবন ও স্থাপনাসমূহ:


জগন্নাথ হলের আদি ভবন দু'টি (উত্তর বাড়ি ও দক্ষিণ বাড়ি) আদর্শ ছাত্রাবাস হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সেখানে ছাত্রদের পত্র-পত্রিকা পড়া এবং অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াদির ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া ছাত্রদের স্নান ও সাঁতার কাটার জন্য এই দু'টি ভবনের ঠিক মধ্যবর্তীস্থানে বাঁধানো ঘাটসহ একটি সুন্দর পুকুর খনন করা হয়- যা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। থাকা-খাওয়া এবং পড়ালেখার পাশাপাশি হলের ছাত্রদের খেলাধুলার জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত ব্যবস্থার সুপারিশ করে। এসবের মধ্যে ছিল- হল অভ্যন্তরে ক্রিকেট পিচ, ফুটবল ও হকির জন্য দু'টি মাঠ এবং পাঁচটি টেনিস কোর্ট স্থাপন করার প্রস্তাব। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে একটি বড় মাঠ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত), দু'টি টেনিস কোর্ট, একটি বাস্কেট বল কোর্ট এবং বড় মাঠের পশ্চিম প্রান্তে ব্যায়াম করার জন্য সামান্য কিছু স্থাপনার ব্যবস্থা করা হয়। মৌসুমভেদে বড় মাঠটি ফুটবল ও ক্রিকেট উভয় খেলার জন্য ব্যবহৃত হতো।


সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এই হলের ভৌত অবকাঠামোগত রূপ, ব্যবহার এবং এমনকি অস্তিত্ব একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তনের এই ধারায় মিশে আছে বর্তমান বাংলাদেশ, তৎকালীন পাকিস্তান এবং অভিবক্ত ভারতবর্ষের ইতিহাস, আন্দোলন, সংগ্রাম, তথা ঘটনাবহুল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।


১৯৮০ সাল অবধি কেন্দ্রীয় ভবন বলতে অ্যাসেম্বলি হাউজ এবং ছাত্রদের জন্য নির্মিত ভবন দু'টি উত্তর বাড়ি ও দক্ষিণ বাড়ি নামে অবিহিত ছিল। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জগন্নাথ হলের সাথে সংশ্লিষ্ট শহিদ শিক্ষকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ এরপর ভবনগুলোর নাম পরিবর্তন করে উত্তর বাড়ির নাম ‘গোবিন্দ চন্দ্ৰ দেব ভবন', দক্ষিণ বাড়ির নাম ‘জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ভবন' এবং অ্যাসেম্বলি হাউজের নাম ‘অনুদ্বৈপ্যায়ন ভট্টাচার্য ভবন' রাখা হয় ।


১৯৮০ সালে ক্যান্টিন ও ছাত্রদের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াকক্ষ ও সংবাদপত্র পাঠাগার ভবনে জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ কার্যালয় স্থাপন এবং পূর্ব বাড়ির নাম পরিবর্তন করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম শহীদ শিক্ষক ড. সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্যের নামে নামকরণ করা হয়।


নব্বই দশকের শুরুর দিকে মাঠের পশ্চিম দিকে বাস্কেট বল এবং লন টেনিস কোর্টের অংশবিশেষ নিয়ে উপাসনালয় নির্মাণ করা হয়। উপাসনালয়ের বাইরে একদিকে বিবেকানন্দ এবং অন্যদিকে গৌতম বুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।


ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা নিরসনে অ্যাসেম্বলি হাউজের স্কুলে ১৯৮৬ সালে পাঁচতলা বিশিষ্ট 'অক্টোবর স্মৃতি ভবন' নির্মাণ করা হয়। ভবনের দু'টি ব্লকের মধ্যবর্তীস্থানে ‘অক্টোবর স্মৃতি স্তম্ভ’ নির্মাণ এবং এতে প্রবেশের বা’পাশে পুরানো অ্যাসেমম্বলি হাউজের সিঁড়ি সংরক্ষিত করা হয়, যেখানে ২০১৪ সালে জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আর্থিক সহায়তায় 'স্মৃতি অক্টোবর' নামে একটি স্মারকস্তম্ভ এবং স্থায়ী ছাউনি নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া, এই ভবনে প্রাধ্যক্ষ কার্যালয়, সহযোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দফতরসহ অক্টোবর স্মৃতি মিলনায়তন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।



অন্যদিকে হলের প্রত্যেক ভবনেই পূর্বাপর হাউজ টিউটরদের জন্য দফতর বিদ্যমান রয়েছে এবং হাউজ টিউটরদের জন্য ‘শহীদ অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য আবাসিক শিক্ষক ভবন’ নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৭-২০১৩ সময়কালে হল পুকুরের পশ্চিম পাশে দশতলা ভবনের আটতলা পর্যন্ত ছাত্রদের জন্য একটি আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। ২০১৪ সালে পূর্ববাড়ি ভেঙে ফেলে নবনির্মিত ভবনের নামকরণ করা হয় ‘সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন'। এই ভবনে হাউজ টিউটর অফিস ও তাদের আবাসস্থল, ডাইনিং হল ও ক্যান্টিন, দর্শনার্থী কক্ষ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া এখানে শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ই-লাইব্রেরি, শহিদ অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য স্মৃতি গ্রন্থাগার, শহিদ মৃণাল কান্তি বোস স্মৃতি পাঠাগার এবং অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত কনফারেন্স রুম স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৯ সালে পুরানো পূর্ববাড়ির স্থানে দশতলাবিশিষ্ট 'রবীন্দ্র ভবন' নির্মাণের কাজ শুরু হয়।



উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর জগন্নাথ হলের ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে আবাসন সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। সেখানে ছাত্ররা গাদাগাদি করে থাকা শুরু করে। 'রবীন্দ্র ভবন' নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের বহুকালের এই দুর্দশার পরিসমাপ্তি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।



জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা বিবার্তাকে জানান, জগন্নাথ হল একটি অনন্য হল। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে যাত্রা শুরু হয় এই হলের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের ৩টি হলের মধ্যে অন্যতম এটি।


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে বিজয় চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত এই হলের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা সংগ্রাম করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই হলের শিক্ষার্থী, কর্মচারী ছাড়াও ৪ জন শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে- যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হলে ঘটেনি। বুয়েটের একজন শিক্ষক এই নারকীয় হত্যার একটি অংশ ভিডিওতে ধারণ করেছিলেন। আমাদের হলে শহিদদের একটি গণকবর দেখতে পাবেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো দিবসের স্মৃতিচারণ করে ড. মিহির লাল সাহা বলেন, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবরের যে দুর্ঘটনা ঘটলো- তখন আমি এই হলেরই শিক্ষার্থী ছিলাম। আমি সেদিন টিভি রুমে নাটক না দেখে রুমে চলে এসেছিলাম। সেদিন যদি আমি নাটক দেখতে যেতাম তাহলে জানি না কী হতো। ৩৫ জন শিক্ষার্থী তখন নিহত হয় আর স্টাফ মিলিয়ে মোট ৪০ জন। তাদের স্মৃতিতে ‘অক্টোবর স্মৃতি স্তম্ভ’ বানানো হয়েছে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে জগন্নাথ হলের সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই হলে আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে আমাদের হলের সাময়িকী ‘বাসন্তিকা’র জন্য তিনি তাঁর বিখ্যাত গীতিকবিতা 'বাসন্তিকা' লিখেছিলেন।


জগন্নাথ হলের অসাম্প্রদায়িকতা ও একাধিক ধর্মালম্বীদের পুজা-পার্বণ উদযাপন বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের হলে মূলত তিনটি ধর্মের অনুসারীরা থাকে- তাই আমাদের দেখবেন মন্দির নেই, একটি উপাসনালয় আছে। কারণ আমরা অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করি। প্রতিবছর দুর্গা পূজা, স্বরস্বতী পূজায় অনেক বড় আয়োজন হয়। তখন ঢাকার আশেপাশের এবং বাইরের অঞ্চল থেকেও মানুষ আসে আমাদের হলে। এই হলে দুর্গা পূজার প্রচলন হয় মূলত হলের কর্মচারীদের হাত ধরে। এই পূজোর আয়োজন আমরা হল কর্তৃপক্ষ করে থাকি। অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমাদের অ্যালামনাই এবং কিছু মহৎ হৃদয়বান সাহায্য করে থাকেন। এটাই হলের ঐতিহ্য।


জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া, খেলাধুলা, মেধা ও মননের বিকাশের সকল সুযোগ সুবিধা হল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে বলে জানান তিনি।


বিবার্তা/ছাব্বির/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com