প্রথমে সেন্টমার্টিন, এবার সোনাদিয়াতেও দখল-দূষণ ও অবৈধ স্থাপনার প্রতিযোগিতা
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:০৭
প্রথমে সেন্টমার্টিন, এবার সোনাদিয়াতেও দখল-দূষণ ও অবৈধ স্থাপনার প্রতিযোগিতা
তাফহীমুল আনাম
প্রিন্ট অ-অ+

সেন্টমার্টিনের পর এবার সোনাদিয়া দ্বীপে ও দখল দূষণ ও স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ দীর্ঘ দেড়মাসেও কার্যকর করেননি জেলা প্রশাসন। 


প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সোনাদিয়া দ্বীপের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার নির্দেশ আসে চলতি বছরের জানুয়ারিতে৷ উক্ত নির্দেশনা দেওয়ার দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। আর এই ফাঁকে গত এক সপ্তাহে গড়ে উঠেছে আরও বেশ কয়েকটি অবৈধ কটেজ ও স্থাপনা। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি জীববৈচিত্র‍্য পড়ছে হুমকির মুখে। 


অন্যদিকে, মাদক বেচাকেনাসহ মানবপাচারের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে এই সোনাদিয়া দ্বীপ। 


স্থানীয়রা মনে করছেন, দ্রুত অবৈধ স্থাপনাগুলো অপসারণের ব্যবস্থা না নিলে, অবৈধ কটেজ ও স্থাপনায় সোনাদিয়া দখল আর দূষণের দ্বীপে পরিণত হবে।যেমনতর ঘটনা ঘটেছে সেন্টমার্টিনে।দখল, দূষণ আর ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে সেন্টমার্টিন। পরিবেশবিদদের আশংকা আগামী কয়েক বছর সেন্টমার্টিন বসবাসের অযোগ্য দ্বীপে পরিণত হবে। সোনাদিয়া দ্বীপ ও কী তাহলে একই পরিণতি ভোগ করতে যাচ্ছে!


জানা গেছে, কক্সবাজার শহরে উত্তর-পশ্চিমে এবং মহেশখালী উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যের অনন্য নিদর্শন সোনাদিয়া দ্বীপ। দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে। ৯ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে নারিকেল, ঝাউ, নিসিন্দা আর কেয়া গাছ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে চিংড়ি, লবস্টার, শামুক, ঝিনুক, ডলফিন, লাল কাঁকড়া, কচ্ছপের বসবাস। অপরদিকে শীতকালে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পরিযায়ী পাখি ও কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে এই দ্বীপে। 


সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, সোনাদিয়া দ্বীপে অবৈধ ভাবে ইতিমধ্যে ১০ /১৫ টি কটেজ তৈরি করা হয়েছে। এসব কটেজ মালিকরা লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষদের সোনাদিয়া দ্বীপে রাত্রী যাপনের জন্য আহ্বান করছেন। অনেক পর্যটক সোনাদিয়ার অপরূপ সৌন্দর্য্যে অভিভূত হয়ে অবৈধভাবে অনিরাপদ রাত্রিযাপন করছে। ইতোমধ্যে দ্বীপে মাদক সেবন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবাধে মেলামেশা ও রাত্রিযাপন, দ্বীপে ঝাউগাছ কেটে আগুন জ্বালানো, উচ্চস্বরে গানবাজনা করা, লাল কাঁকড়ার বিচরণ স্থানে ফুটবল ও ভলিবল খেলা, কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানে তাবু স্থাপন সহ মাদক বেচাকেনাসহ ইত্যাদি অপকর্মের নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছে। 


বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) এক পত্র সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ জানুয়ারি সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্কের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা অবৈধ কটেজ অপসারণসহ দ্বীপে পর্যটকদের অবৈধভাবে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধকরণের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) উপসচিব মোহাম্মদ নাজমুল হাসান স্বাক্ষরিত ওই পত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সোনাদিয়া দ্বীপে অসাধু ব্যবসায়ীরা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে একাধিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে। সেখানে আগত পর্যটকরা মাদক সেবনসহ অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এছাড়াও ১৯৯৯ সালে সোনাদিয়া দ্বীপকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়। এ আইনে সোনাদিয়া দ্বীপে যে কাজগুলো নিষিদ্ধ করা হয়।


সেগুলো হলো- প্রাকৃতিক বন কর্তন বা আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা। সকল প্রকার শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা। ঝিনুক, কোরাল, কচ্ছপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী ধরা বা সংগ্রহ বে আইনী। প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী সকল প্রকার কার্যকলাপ বন্ধ করা। ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারে এমন কাজ না করা। মাটি, পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন না করা। মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে-কোনো প্রকার কার্যাবলী নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নদী-জলাশয়-লেক-জলাভূমিতে বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালীসৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্জ্য নির্গমন এবং কঠিন বর্জ্য অপসারণ। যান্ত্রিক বা ম্যানুয়াল বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে পাথরসহ অন্য যেকোনো খনিজ সম্পদ আহরণ না করা। তাই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের নির্দেশ দেন বেজা। 


তবে নির্দেশনার দেড়মাস পেরিয়ে গেলেও মহেশখালী উপজেলা প্রশাসন কিংবা কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। 


এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বিবার্তাকে বলেন, সোনাদিয়ার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও রাত্রিযাপন নিষিদ্ধের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পত্র হাতে পেয়েছেন। তবে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর আগে প্রস্তুতি দরকার। খুব শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। 


অন্যদিকে পরিবেশ সংগঠনের নেতৃবৃন্দদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক পাখি সংরক্ষক সংস্থা বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনাল এই সোনাদিয়া দ্বীপকে পাখির বিচরণক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারা আরও জানিয়েছেন, বিপন্ন প্রজাতির চামচঠোঁট পাখির বিচরণ শুধুমাত্র বাংলাদেশের সোনাদিয়া দ্বীপেই দেখা মিলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই দুঃসময়ে পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।


মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইয়াছিন জানান সোনাদিয়ার পরিবেশ রক্ষা করতে হলে কোন অবস্থাতেই পর্যটকেদর রাত্রি যাপন করতে দেয়া যাবে না।প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হয় এমন কাজ করা যাবে না।ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা ঝাউবন কেটে কেউ স্থাপনা নির্মাণ করলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।পরিবেশের ক্ষতি না করে সরকার সেখানে ইকোট্যুরিজম করতে যাচ্ছে।


এদিকে কক্সবাজার পরিবেশ আন্দোলন বাপার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, সোনাদিয়া এমন একটা দ্বীপ যা কক্সবাজার শহর সমুদ্র সৈকত ও মহেশখালী দ্বীপ কে নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে।তাই দ্বীপের অস্তিত্ব ধ্বংস হয় এমন কাজ বা উন্নয়ন থেকে বিরত থাকা দরকার। আর যারা সোনাদিয়ার বন উজাড় করে কটেজের নামে স্থাপনা করছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন


বিবার্তা/তাফহীমুল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com