পাহাড় কেটে দখল-দূষণ, ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ে কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:২৮
পাহাড় কেটে দখল-দূষণ, ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ে কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল
তাহফীমুল আনাম
প্রিন্ট অ-অ+

পাহাড়কাটা, বনাঞ্চল উজাড়, নদী- খাল ভরাট, ইসি এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস, দখল ও দূষণে ভয়ংকর পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন কক্সবাজারসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। নানাবিধ পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রকৃতি নিচ্ছে কঠোর প্রতিশোধ। বেড়েছে, ঝড়-ঝঞ্জা, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিধস, ভূমিকম্প, বন্যপ্রাণীর লোকালয়ে বিচরণ বিশেষ করে হাতির আক্রমণে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। ভাঙছে উপকূল।


সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে কলাতলী হোটেল–মোটেল এলাকার পাশ দিয়ে চলেগেছে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে কিছুদূর এগোলে চোখে পড়বে উঁচু পাহাড়ের ঢাল। ওই পথ ধরে যতদূর এগোনো যাবে, শুধু পাহাড়ের ধ্বংসস্তূপ আর হরেক রকম নির্মীয়মান স্থাপনা। শুধু কক্সবাজার সদর নয়, জেলার রামু, মহেশখালী থেকে শুরু করে কুতুবদিয়া বা সোনাদিয়া দ্বীপজুড়ে বনভূমি বা ম্যানগ্রোভ নিধনযজ্ঞ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।


সরকারি সংস্থা বন বিভাগের হিসাবে কক্সবাজারের ২ লাখ ৬০ হাজার একর বনভূমির মধ্যে প্রায় ৫৬ হাজার একর বেদখল হয়ে আছে। সেখানে ৭০ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও ৬৯৬ টি প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে সেখানকার জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ বন দখল করে আছে। প্রায় প্রতিদিন এসব বনভূমির গাছ আর পাহাড় কেটে সেখানে নিত্যনতুন স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বনভূমি উদ্ধার নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা রয়েছে। বন বিভাগ থেকে এসব বনভূমি উদ্ধারের জন্য বার বার চিঠিও দিচ্ছে। কিন্তু বন দখলমুক্ত না হয়ে বরং আরও বেশি দখলের শিকার হচ্ছে।



কক্সবাজারে কারা কীভাবে বন ধ্বংস করছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) যৌথভাবে কক্সবাজারের বনভূমি ধ্বংস হওয়া নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলায় বন ধ্বংসে এগিয়ে রয়েছে খোদ সরকারি সংস্থাগুলো। নিয়মিতভাবে নিত্যনতুন সরকারি সংস্থা সেখানকার বনভূমি ইজারা নেওয়ার জন্য আবেদন করে চলেছে। অনেক সংস্থা অনুমোদন নেওয়ার আগেই সেখানে স্থাপনা গড়ে তুলছে।



কক্সবাজার সদর উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে পাহাড় কাটার মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে সরকারী দীঘি।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিবার্তাকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে আর সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যালয় স্থাপনের নামে কক্সবাজারকে বনভূমি শূন্য করা হচ্ছে। কীভাবে একটি দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা ধ্বংস হতে পারে, তার বড় উদাহরণ হতে পারে কক্সবাজার। অথচ সেখানকার বনভূমির উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাই হতে পারত উন্নয়নের মূল বিষয়।



বাপা,বেলা ও ইয়েসের ওই গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য যে পরিমাণে বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি বনভূমি খোদ সরকারি সংস্থাগুলো বরাদ্দ নিয়েছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পর রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে একের পর এক পাহাড়ি বন উজাড় করছিল। গত দুই বছর সেখানে বিকল্প হিসেবে এলপিজি গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশের বনগুলো আবারও সবুজ হয়ে উঠছে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর নামে বরাদ্দ পাওয়া জমিগুলোর বন কেটে তৈরি করা হচ্ছে নানা অবকাঠামো।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বড় ঢল বাংলাদেশে আসার পর তাদের টেকনাফ ও উখিয়ার ৬ হাজার ১৬৪ একর বনভূমিতে আশ্রয়শিবির স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়।কিন্তু রোহিঙ্গারা ধ্বংস করেছে প্রায় ১২ একর বনভূমি। বন বিভাগের কাছ থেকে ওই সংরক্ষিত বনভূমির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া জমির পরিমাণ হচ্ছে ১৬ হাজার ৩৭২ একর। যার বড় অংশ সরকারি সংস্থা। এসব জায়গায় সরকারি সংস্থাগুলো কার্যালয়সহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছে।



এ বিষয়ে কক্সবাজারের উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন সরকার বিবার্তাকে বলেন, আমরা কক্সবাজারের বনের অবৈধ দখলদারদের তালিকা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার জন্য আবেদন করেছি। আর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন দখলকারীদের উচ্ছেদের কাজ শুরু করেছি।


জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বিবার্তাকে বলেন, সরকারি যেসব সংস্থার নামে কক্সবাজারের বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা যথাযথ সরকারি নিয়ম মেনে করা হয়েছে। আর জবর দখল করা বনভূমিকে অনেকে মালিকানা দাবি করে মামলা করেছেন। তবে একদম কোনো আইনি জটিলতা নেই, কিন্তু কেউ দখল করে আছে এমন বনভূমির তালিকা বন বিভাগ থেকে দেওয়া হলে অবশ্যই তা উচ্ছেদে সহযোগিতা করা হবে।


গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজারে এককভাবে সবচেয়ে বেশি বনভূমি বরাদ্দ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। সংস্থাটি সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফের ৮ হাজার ৮৮৫ একর জমি ইজারা নিয়েছে। সেখানে তারা শিল্প ও পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর বাইরেও মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় কয়েক হাজার একর বনভূমি বরাদ্দ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে ২০২ দশমিক ২৪ একর ও ডুলাহাজারা খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হসপিটালকে ১৪ দশমিক ২৪ একর বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সরকারের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নামেও বিপুল পরিমাণে বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজার হচ্ছে দেশের একমাত্র এলাকা যেখানে পাহাড়ি ও সমতল ভূমি থেকে শুরু করে দ্বীপে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ বনভূমি রয়েছে। মিষ্টি পানির নদী দিয়ে শুরু হয়ে তা সমুদ্রের নোনাপানির সঙ্গে মিশেছে। সে কারণে ওই অঞ্চলকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা বলা হয়।



প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমীন বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে কক্সবাজার অঞ্চলের উপকূলকে রক্ষায় ওই বনভূমি রক্ষাকবজের ভূমিকা পালন করছে। আর এশীয় বন্য হাতির অন্যতম বিচরণস্থলসহ দেশের বিলুপ্তপ্রায় অনেক বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল এই জেলার বনভূমি। ফলে এখানকার বনভূমিগুলো জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করে জীববৈচিত্র্যের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত।


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বিবার্তাকে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে কক্সবাজারের প্রাণ প্রণালী,বাকঁখালী,মাতামুহুরি, নাফনদী,কোহেলিয়া ও মহেশখালী চ্যানেল নাব্যতা হারিয়েছে। বিশেষ করে, বাকঁখালী নদীর মোহনা ভরাট করে বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে,পৌর সভার ময়লারডিপো বানানোহয়েছে বাকঁখালী নদীকে,ভরাট করে বাকখালী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে শতশত স্থাপনা,ইসি এলাকায় শতশত সরকারী বেসরকারি বহুতল ভবন, সমুদ্র সৈকতের বালি উত্তোলন করে ভরাট করা হচ্ছে নীচু এলাকা ও তিন ফসলী জমি।শুধু কি তাই? কোহেলিয়া নদী ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে সড়ক।মহেশখালী চ্যনেলও নাফনদীর কিনারা ঘেষে গড়ে উঠা ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে তৈরি করা হচ্ছে হাজার হাজার একর চিংড়ি ঘের। মহেশখালীর,ঘটিভাঙ্গা,বড়দিয়া,সোনাদিয়া,কালারমারছড়া, হোয়ানক, ধলঘাট মাতারবাড়ির প্রায় ৭ হাজার একর ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট ধ্বংস করেছে ভূমিদস্যুরা। এমনকি মহেশখালী পাহাড়ের সাড়ে ১৮ হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৮০ শতাংশ বেদখল হয়েগেছে।কক্সবাজার সদরের ঐতিহ্যবাহী পিএমখালীখালসহ জেলার ৪৬ টি খাল বন্ধ করে দিয়েছে ভূমিদস্যুচক্র।রামু,কক্সবাজারশহর,সদর,চকরিয়া,পেকুয়া উখিয়া ও টেকনাফের ১৪৯ পাহাড় কাটা হয়েছে নির্বিচারে।শুধু মাত্র উখিয়াতে ৬৫ টি পাহাড়। সেখানে খালের বালি ইজারা নিয়ে কাটা হচ্ছে পাহাড়।বনবিভাগ ও প্রশাসনের বাঁধা কোন কাজে আসছে না।


কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, পাহাড় কাটাসহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড জড়িত থাকার অভিযোগে গত এক বছরে ২৩ টি মামলায় ৬৫৭ জনকে আসামী করা হয়েছে। একাধিক মামলার চার্জসীট ওদেয়া হয়েছে।


বেন এর প্রতিষ্টা সভাপতি ও পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র' সহসভাপতি ড, নজরুল ইসলাম, কক্সবাজারে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড দেখে রীতিমতো হতবাক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ ভাবে পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতিকরে যারা ভূমি গ্রাস করছে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। তাদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। কক্সবাজারের প্রাণ কেন্দ্র কলাতলীতে ৫১ একর পাহাড় কেটে সরকারী কর্মকর্তা কর্চারীরা উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। প্রশাসন ক্যাডারদের জন্য হিমছড়ির নিকটবর্তী শুকনোছড়িতে ৭০০ একর বনভূমি বরাদ্দ নিয়ে পাহাড় কাটার পায়তারা চলছে। যা অত্যান্ত দুঃখজনক।


অতিরিক্ত স্থাপনা , কেয়াবন নিধন, প্রবাল পাথর উত্তোলন কচ্ছপ এবং লাল কাকঁড়া বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট করে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে পড়েছে। এ ভাবে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত ও রাত্রি যাপনের জন্য বিলাসবহুল স্থাপনা বন্ধ করা না গেলে অচিরেই সেন্টমার্টিন পরিত্যক্ত দূষিত নগরীতে পরিনত হবে।পার্শ্ববর্তী বান্দবান জেলার সর্বত্র অনুরুপ কার্যক্রম চলছে।শুধু কক্সবাজার নয় সমগ্র দেশে চলছে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম। পরিবেশ বিজ্ঞানী ড,আনছারুল করিম বলেছেন কোন ধরনের পরিবেশের ক্ষতি না করে টেকসই উন্নয়ন করা যায়।


বিবার্তা/তাফহীমুল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com