আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের একক রাজত্ব সড়ক বিভাগে
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:১৬
আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের একক রাজত্ব সড়ক বিভাগে
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বড় প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেয়া, টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকার পরও সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বড় বড় প্রকল্পের কাজ করে যাচ্ছে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন।


জালিয়াতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও অদৃশ্য কারণে থমকে আছে সেই কার্যক্রম। এর বাইরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীরা আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন টেন্ডার পেতে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ ব্যবহার করছে, এমন তথ্যের বিষয়ে অন্তত এক বছর আগে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করা হলেও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন এখন পর্যন্ত স্বাক্ষর জাল করে শতাধিক কাজের ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট তৈরি করেছে। আর এসব ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়ে সওজের বড় বড় প্রকল্প হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগে শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকা সত্ত্বেও বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নিচ্ছে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর এই সিন্ডিকেটে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ঢাকা জোনের এক প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত আছেন।


বিবার্তার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেছে। কুড়িগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় সড়ক বিভাগের বড় বড় প্রকল্প হাতিয়ে নিতেও ভুয়া কাজের অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এতে ব্যবহার করা হয়েছে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় করা কাজের ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ।


শুধু সনদ জালিয়াতি নয়; টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকার পরও কিছু সওজ কর্মকর্তার যোগসাজশে কোনো ধরণের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বড় প্রকল্প পেতে কাজ না করেই কম্পলিশন সার্টিফিকেট (সমাপনী সনদ) জমা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিম্নমানের কাজ করার অভিযোগও রয়েছে।


সওজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সড়ক বিভাগে কাজ পায় আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। শুরুর বছরে এককভাবে ৯২ লাখ টাকার কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। টেন্ডার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী, শুরুর প্রথম পাঁচ বছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাকার অংকে পূর্বের বছরের দেড় গুণ বড় কাজ পেতে পারে। সেই হিসেবে পরের অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের কাজ পেতে পারে। সেই জায়গায় প্রতিষ্ঠানটি দ্বিতীয় অর্থবছরেই এককভাবে প্রায় ২১ কোটি টাকা মূল্যের কাজ করেছে।


হিসাবনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ৫ম বছরে সর্বোচ্চ প্রায় পৌঁনে ৫ কোটি টাকা মূল্যের কাজ করতে পারে। তবে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি সড়ক বিভাগের অন্তত ৪৭১ কোটি টাকার কাজে অংশ নিয়েছে। নিয়মভঙ্গের পাশাপাশি জালিয়াতি করে করা অভিজ্ঞতা সনদ ব্যবহার করে কাজ পেলেও অদৃশ্য কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।


জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীরা ২০২২ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ দরপত্রে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে পিপিআর-২০০৮ এর বিধি ও দরপত্রের শর্তানুযায়ী কালো তালিকাভুক্তসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।


সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের এক কোটি ৮৩ লাখ টাকার তিনটি কাজ বাগিয়ে নিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ ব্যবহারের অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে লিখিত অভিযোগ করে লক্ষ্মীপুরের মেসার্স নাহার এন্টারপ্রাইজ। গত বছরের ২০ নভেম্বর করা প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগে বলা হয়, টেন্ডার পেতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন কোটি টাকার কাজের টার্নওভার/কার্য সম্পাদনের যে সকল অভিজ্ঞতা দিয়েছে, তা ভুয়া সনদ। এছাড়াও শত শত অভিযোগ রয়েছে বলে আবেদনে জানানো হয়।


আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিলের পুরনো অভিযোগও রয়েছে। ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিল করার কারণে ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি পৃথক দিনে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীগণ আলাদা দুটি চিঠি ইস্যু করেন।


সাতক্ষীরা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়টি কুড়িগ্রাম সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানান। এতে তিনি আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের করা ৩৯টি ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে দেন। এছাড়া পৃথক চিঠিতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের ১০টি ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে কক্সবাজার সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকেও বিষয়টি জানান।


আর বাগেরহাট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরিদ উদ্দিন ভূইয়া ৫৬টি ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে সড়ক বিভাগে পাঠানো সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন এসব সার্টিফিকেট সড়ক বিভাগ থেকে ইস্যু করা হয়নি।


এছাড়া এসব চিঠির অনুলিপি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৗশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ দেশের বিভিন্ন জোন ও সার্কেলে পাঠানো হয়েছে। এসব ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট ও চিঠি বিবার্তার কাছে সংরক্ষিত আছে।


দু’টো চিঠিতেই আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট (সমাপনী সনদ) দাখিল করে ফ্রডুলেন্স প্র্যাকটিস (প্রতারণামূলক অনুশীলন)- এর সমান শাস্তিযোগ্য অপরাধ করার বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে পিপিআর-০৮ এর বিধি অনুসারে এবং দরপত্রের শর্তানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কর্মকর্তরা সুপারিশ করেন।


জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া (তৎকালীন সাতক্ষীরা) সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, বিষয়টা তদন্তে আছে। আমার যে চিঠি পেয়েছেন ওইটাই ডকুমেন্ট। এর বাইরে কিছু বলতে পারবো না।


সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলার ঠিকাদাররাও মন্ত্রণালয় বরাবরে অভিযোগ দিয়েছেন। ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নওগাঁর ঠিকাদার নুরুল ইসলাম সিদ্দিকি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে আবেদন জানান, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গত তিন বছরে ভুয়া ও অসত্য তথ্য দিয়ে কাজ পাচ্ছে।


সেই আবেদনে তিনি লিখেন- আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের ভুয়া সনদের প্রমাণ হিসাবে বরগুনা সড়ক বিভাগের ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির দফতর স্মারক নং-১৬৪৯ মোতাবেক ভুয়া ৫৬টি সনদের প্রমাণ ছাড়াও ঢাকা, নড়াইল, সাতক্ষীরাসহ অনেক ডিভিশনে শত শত ভুয়া কার্যসনদ দিয়ে টেন্ডার দাখিল করায় যাচাইয়ান্তে তা ভুয়া প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও অবৈধ অর্থশক্তির কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ কখনও কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। এছাড়াও তার টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকা সত্ত্বেও অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তাকে কার্যাদেশ প্রদান করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।


চিঠিতে তিনি শত শত ভুয়া সনদ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তার এই দুনীতি ও সরকারি অর্থ অপচয়ের জন্য দায়ী সকলকে আইনের আওতায় আনার অনুরোধ জানান।


২০২২ সালের ২ অক্টোবর বরিশালের কাশেম আলী হাওলাদার সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদনে জানান, অসংখ্য ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বরিশাল জোনসহ অন্যান্য সড়ক বিভাগে দরপত্র দাখিলকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন গত কয়েক বছরে দরপত্র পাওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতির দুর্নীতির তদন্ত ও জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা প্রদানের আবেদন জানান।


আবেদনে তিনি লিখেন- আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বর্তমান চলমান কাজের পরিমাণ অনলাইনে হিসাব করলে তার টেন্ডার ক্যাপাসিটি থাকে না এবং একটি কাজও না পাওয়ার কথা। সড়ক জনপথের বিভিন্ন ডিভিশনের অনুকুলে ভুয়া সার্টিফেকেট তৈরি করে ইতোপূর্বে সকল কাজ পেয়েছে। বর্তমানেও ভুয়া সার্টিফিকেট ব্যবহার করে দরপত্র দাখিল করছে; যাচাই করলেই যার প্রমাণ পাওয়া যাবে।


এসব আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. দেলোয়ার হোসেন ১০ কার্য দিবসের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশনা দেন। সেই চিঠির বিষয় ছিলো- আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন গত ৩ বছরে ভুয়া ও অসত্য তথ্য দিয়ে কাজ পাওয়ায় আর্থিক দুর্নীতি তদন্ত ও জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান।


এর সাত দিন পর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট সার্কেল) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ দেশের ১১টি সওজ জোন, তিনটি উইং, সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশনা দেন। তবে সেই চিঠিতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের পুরো নাম না লিখে লেখা হয়েছে- ‘মনুসর কনস্ট্রাকশন’।


সর্বশেষ ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. মাহবুবের রহমান সড়ক বিভাগের ৯টি জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে সড়ক জোনের আওতায় আহ্বানকৃত দরপত্রে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন কর্তৃক দরপত্র দাখিল করা হয়ে থাকলে সেগুলো কিভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে/মূল্যায়নকালে কম্পলিশন সার্টিফিকেট যাচাই করা হয়েছে কি-না ইত্যাদি বিষয়ে মতামত তিন কার্যদিবসের মধ্যে সরাসরি প্রেরণের নির্দেশনা দেন।


চিঠিতে তিনি জানান, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে এ বিভাগের সচিব বরাবর একাধিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। উক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দরপত্র দাখিলের সময় যেসব কম্পলিশন সার্টিফিকেট সন্নিবেশ করা হয়েছে অভিযোগকারীগণ সার্টিফিকেটগুলোকে ভুয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং প্রমাণ হিসেবে কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছে। বিষয়টি তার কার্যালয় সম্যক অবহিত এবং সড়ক বিভাগসমূহ কর্তৃক এসব কম্পলিশন সার্টিফিকেট যাচাই অন্তে ‘ভুয়া/ইস্যু করা হয়নি’ মর্মে মতামত দেয়া হয়েছে।


বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ) মো. মাহবুবের রহমান বিবার্তাকে বলেন, সেগুলো আসতেছে। আমরা প্রসেস করছি। সবগুলো চলে আসবে, যথাসময়ে জমা হবে।


এদিকে ২০১৭ সালের পর থেকে আবেদ মনসুরের প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত কাজ করেছে ৪৪১টি। এসব কাজের টেকনিক্যাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (টিডিএমএস) ও টেন্ডার অ্যান্ড কনট্রাক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (টিসিইএস) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের চলমান কাজের ভ্যালু বাদ দিলে প্রতিষ্ঠানটির কোনো টেন্ডার ক্যাপাসিটি থাকে না।


পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিউ) এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি গত পাঁচ বছরে প্রায় ৪৭১ কোটি টাকা মূল্যের কাজ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের যৌথ কাজ রয়েছে।


সিপিটিউ এর তথ্য অনুযায়ী, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০ কোটি ২৪ লাখ টাকা মূল্যের একক ও যৌথ কাজ করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের কাজ চলমান রয়েছে।


প্রতিষ্ঠানটি প্রথম কাজ পায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর পাওয়া কাজটি ছিল ঢাকা-আরিচা ন্যাশনাল হাইওয়ে রোড এন-৫ এর ২২ কিলোমিটার পেইন্টিং রোড মিডিয়ান পেইন্ট এবং থিনার সরবরাহ করা। যার টেন্ডার নং- ১৪২৫০৬। এ কাজের মূল্য ছিল ২২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।


আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা সড়ক বিভাগের অধীনে জাতীয় মহাসড়ক (এন-৫) এবং বসিলা ব্রিজ অ্যাপ্রোচ রোড গাবতলী ব্রিজ, সাভার বাজার এলাকা এবং ঢাকা-আরিচা নবীনগরে ফিটিংসহ স্ট্রিট লাইট স্থাপনের প্রথম কাজ পায় আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। এ কাজের মূল্য ছিল ৪ কোটি টাকা। যার টেন্ডার নং- ২৬১৬৩১।


জানা যায়, টেন্ডার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পূর্বের বছরে সমাপ্তকৃত কাজের মূল্যের দেড় গুণ বড় কাজ করার সীমা রয়েছে। নিয়মানুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডিসেম্বর একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ৯২ লাখ টাকা মূল্যের কাজ করা আবেদ মনসুর কন্সট্রাকশন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের কাজ পাওয়ার কথা। তবে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৩ গুণ কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২১ কোটি টাকা মূল্যের কাজ পায়। আগের অর্থবছরে ৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা মূল্যের যৌথ কাজ করলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেয়ে যান ২৫ কোটি টাকা মূল্যের যৌথ কাজ। এরপর থেকে এভাবে প্রতিবছরই টেন্ডার ক্যাপাসিটির তোয়াক্কা না করেই কাজ পেয়ে যাচ্ছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন।


বর্তমান ক্রয়নীতি এবং পিপিআর আইনের সাথেও পর্যালোচিত এসব তথ্য ভয়ংকরভাবে সাংঘর্ষিক। এদিকে সর্বশেষ ২০২১ সালে করা কাজের সাথে আগের বছরের তুলনা করলে সেখানেও টেন্ডার ক্যাপাসিটি নেগেটিভ ভ্যালু প্রায় ৭২ লাখ টাকা।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ক্রয় নীতি ও পিপিআর আইন ২০০৮ ’কে কোনো ধরণের তোয়াক্কা না করে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনকে নিয়মভঙ্গ করে কাজ দেয়া হচ্ছে। সড়ক বিভাগ ঢাকা জোনের এক কর্মকর্তার যোগসাজশে একক কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। অনিয়মকে নিয়মিত কর্মকাণ্ডে পরিণত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিয়মনীতি মেনে কাজ পাওয়া ঠিকাদাররা। তারা বলছেন, নিয়ম না মেনে এভাবে ঠিকাদারদের কাজ দিতে থাকলে ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে এই মন্ত্রণালয়।


সড়ক ও জনপথ বিভাগের কিছু অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্থ উঁচু পদের প্রকৌশলীর সহযোগিতায় ভুয়া ডিপিএম কাজ সম্পাদন সনদের মাধ্যমে ঢাকা, বরিশাল, খাগড়াছড়ি, নওগাঁ, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মানিকগঞ্জসহ আরো কয়েকটি সড়ক বিভাগে কাজ সম্পাদন না করে জালিয়াতি করে সম্পূর্ণ বিল তুলে নিচ্ছে ঠিকাদারচক্র। এতে করে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সরকার।


এছাড়া ডিপিএম সার্টিফিকেট দিয়ে কাজের সংখ্যা বাড়িয়ে টেন্ডারে কার্যাদেশপ্রাপ্ত হওয়ায় সড়ক বিভাগে ভুয়া সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে কাজ বাগিয়ে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, জালিয়াতি করা এসব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই এক শ্রেণির প্রকৌশলী কাগজপত্র যাচাই না করেই কার্যাদেশ প্রদান করছেন।


অভিযোগের বিষয়ে জানতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী আবেদ মনসুরের মুঠোফোনে বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) থেকে রবিবার (৮ জানুয়ারি) বেলা ১২টা পর্যন্ত একাধিক নম্বর থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মুঠোফোনে কল, এসএমএস এর পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট সার্কেল) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বিবার্তাকে বলেন, প্রতিবেদন ফিল্ড থেকে আসবে। আমাদের অনেকগুলো ডিভিশন। সবগুলো এসে পৌঁছেনি। মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের পুনরায় তাগাদা দেয়া হয়েছে। আমরা প্রতিবেদন পেলেই পাঠিয়ে দিব।


জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক বিবার্তাকে বলেন, আমি একেবারে নতুন জয়েন করেছি তাই তাৎক্ষনিকভাবে জবাব দিতে পারছি না। ফাইল দেখে বলতে হবে তদন্তে কি হয়েছে।


টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকার পরও প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে কাজ পাচ্ছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারা টেন্ডার একসেপ্ট করেছে, টেন্ডার না দেখে তো বলতে পারব না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।


সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (কানেক্টিভিটি শাখা) মো. দেলোয়ার হোসেন বিবার্তাকে বলেন, আমরা ওনাদেরকে (সওজ) মতামত দেয়ার জন্য বলেছি। সময়ের মধ্যে দিতে পারেনি। পরে আমরা আবার রিমাইন্ডার দিয়েছি। ওরা প্রতিবেদন মাঠ পর্যায় থেকে কালেক্ট করে। শুনেছি এখনো কালেক্ট করতে পারেনি।


সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে এসেছে কি-না জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, মাঠ পর্যায় থেকে আমাদের কাছে পাঠাবে না। তারা তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে। আমরা নিজেরা করলে অথবা চিফ ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে আসলে এসব পাই। আমাদের কাছে এসে পৌঁছেনি।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসএফ


সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com