প্রত্যেকটি জিনিসের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিষয়টা হলো- সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রাটা আসলে কত সেটি জানা এবং বোঝা জরুরি।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কথা বলে শুরু করার পেছনে একটি কারণ রয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব প্রসারের জন্য আমাদের জীবন-যাপন বিশ্বমানের হয়ে উঠছে। বিশ্বটাকে অনেক ছোট মনে হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল এর নেতিবাচক ব্যবহারের মাধ্যমে কু-স্বার্থ চরিতার্থ করা।
বর্তমান সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার যেমন শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে ঠিক তেমনি ভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করে সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে জাতির মেরুদণ্ড ভাঙার সুক্ষ্ম পায়তারা চলছে।
আপনি যদি শান্ত মস্তিষ্কে ভেবে দেখেন তাহলে দেখবেন যে বিগত কয়েক বছর পিএসসি (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী), জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে এবং অনেকাংশে তা বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি প্রশ্ন জালিয়াতির সাথে জড়িত অনেককেই হাতেনাতে আটক করা হয়েছে ডিজিটাল জালিয়াতির ডিজিটাল সরঞ্জাম সহ। আমাদের দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সেই তথ্য প্রযুক্তির উপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ। কারণ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উপর যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকে তাহলে জালিয়াত চক্র যতো কৌশলীই হোক না কেন তারা রক্ষা পাবে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে যে কোন অপরাধ দমন করতে পারে বলে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আপনারা তার প্রমাণ ইতোমধ্যেই পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতির অভিযোগে দুইজন মূল হোতা গ্রেফতার হয়েছে এবং জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়েছে এমন সাতজন গ্রেফতার হয়েছে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আমি মানলাম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে একমাত্র এই প্রশ্ন ফাঁসের জন্য। এবং সেজন্য শিক্ষামন্ত্রী থেকে সকল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নিন্দিত হচ্ছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সাথে সাথে দেশের সাধারণ মানুষেরও কিছু ভূমিকা রয়েছে। নিজেকে প্রশ্ন করুন যে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করার আগে আপনি নিজে কি প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধে কোন ভূমিকা রাখতে পারছেন কিনা।
আমি অবাক হই সেই সব পরিবারের কথা ভেবে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ফাঁসকৃত প্রশ্ন তার সন্তানের হাতে তুলে দেয়। একটা সময় বাবা-মা পরীক্ষার আগে বাচ্চাদের নতুন কলম, স্কেল, জ্যামিতি বক্স, এক্সাম বোর্ড ইত্যাদি কিনে দিত। আর এখন তারা প্রশ্ন কিনে দিয়ে সন্তানদের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে বুক ভরে গর্ব করে। আমার আফসোস হয় সেই সব অভিভাবকদের কথা ভেবে যারা জেনে শুনেই সন্তানদের ধ্বংসের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে এবং ভঙ্গুর করছে জাতির মেরুদণ্ড।
প্রশ্ন ফাঁসের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। গ্রামের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গরিব কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীটি উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ফাঁসকৃত প্রশ্নের কাছে। যারা প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত তারা নিশ্চয়ই ভিন্ন গ্রহ থেকে আসেনি। তারা আপনার আমার পাশে থেকেই এই ঘৃণ্য কাজ করে চলেছে। আপনি যদি সচেতন নাগরিক হয়ে থাকেন তাহলে আপনার দায়িত্ব এই চক্রকে ধরিয়ে দিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করা।
আর শিক্ষা প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ শুধু অপরাধীদের সনাক্ত করার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না। যে গাছটি কাটলে তার মূল থেকে আবার গাছ জন্মানোর সুযোগ থাকে সেই গাছটি যদি ক্ষতিকারক হয়ে থাকে তাহলে শুধু গাছটি কেটে ফেললেই সমাধান আসবে না। স্থায়ী সমস্যার সমাধান করতে হয়ে সেই গাছটিকে মূলসহ উপড়ে ফেলতে হবে। আমি মনেকরি প্রশ্ন ফাঁসের সাথে কোনো একক ব্যক্তি জড়িত নয়। এই চক্রের চেইন অনেক বড় এবং সেই চেইনের মূলে যাওয়া সম্ভব যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চায়। অপরাধীদের সনাক্ত করে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে যদি সমস্যার মূল হোতাকে বিচারের আওতায় আনা না যায় তাহলে প্রশ্ন ফাঁস সমস্যার কোন স্থায়ী সমাধান হবে না বলে আমি মনে করি।
যে প্রজন্ম এগিয়ে যায় শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে সেই প্রজন্মকে যদি শিক্ষা গ্রহণের প্রারম্ভে শিক্ষার নামে কু-শিক্ষার অন্ধকার নিমজ্জিত করা হয় তাহলে বড় বড় সার্টিফিকেটধারী এই প্রজন্ম জাতি গঠনের সামনে সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমি মনেকরি প্রশ্ন যারা ফাঁস করছে এবং যারা ফাঁসকৃত প্রশ্ন কিনে তার সন্তানদের দিচ্ছে তারা সবাই সমান অপরাধী। অপরাধীদের অপরাধ দমন করা যেতে পারে সাময়িক সময়ের জন্য সাময়িক শাস্তি দিয়ে। কিন্তু কিছু অপরাধকে নির্মূল করতে হলে তার নাড়ি-নক্ষত্র জানতে হবে এবং বের করতে হবে এর মূলে কে বা কারা রয়েছে। অনেক সময় মানুষ কি বলবে সেই ভয়ে অনেক অপরাধ দেখেও প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়টিকে যদি এড়িয়ে যাওয়া হয় তাহলে এক সময় ফাঁসকৃত প্রশ্নে শিক্ষিত প্রজন্মই প্রশ্ন ফাঁসের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের ভার সইতে পারবে না যার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো জাতি।
অনেক দিন ধরে জ্বলতে জ্বলতে সৃষ্ট বিশাল দাবানল সমান অপরাধ দমনে আপনার আমার একক প্রচেষ্টা বিশাল দাবানলের সামনে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের একটি কণা মাত্র। আমরা সবাই যদি একত্রে এই অপরাধের সামনে এক সাথে দাঁড়াতে পারি তাহলে যে কোন অপরাধ আমাদের সামনে সামান্য বিষয় ছাড়া কিছুই না।
আমরা শূন্য থেকে শুরু করে আজ একটি গর্বিত জাতি। তাই আমি আশাবাদী আমাদের সমাজ থেকে সব অপরাধ হয়তো একদিনে নির্মূল হবে না কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের মতো জাতি ধ্বংসকারী অপরাধগুলো স্বমূলে নিচিহ্ন হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক: আসিফ তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/কামরুল
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]