শিরোনাম
তোমরা যারা স্বঘোষিত রাজাকার
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০১৮, ১৬:২৬
তোমরা যারা স্বঘোষিত রাজাকার
আসিফ তালুকদার
প্রিন্ট অ-অ+

শিক্ষা যদি আচরণের পরিবর্তন করতে না পারে তাহলে সেই শিক্ষা কার্যকর শিক্ষা নয়, সেই শিক্ষা পুস্তক থেকে মস্তিষ্কে কিছু তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ ছাড়া কিছুই নয়।


আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানো, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সাথে বেঈমানী করে পাকিস্থানী বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে চলা রাজাকারদের গল্প পড়ে বইয়ের পাতা মলিন করে ফেলি এবং প্রয়োজনে তা গড়গড় করে বলে দিতে পারি।


আমরা ভুলে যাই, ইতিহাস শুধু পড়ে মুখস্ত করার বিষয় নয়, ইতিহাস পড়ে তার থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, যাতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তা যেন নতুন কোনো কালো ইতিহাসের জন্ম দিতে না পারে।


মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রম হারানো মা-বোন, রাজাকারদের সকল নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বীভৎস চিত্র, ত্রিশ লাখ শহীদ এই যে বিষয়গুলো যদি আপনার হৃদয়ে একটু হলেও দাগ কেটে যায়, তাহলে আপনি আর যা-ই করুন না কেন, জীবনে কখনো স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সাথে সমঝোতা করতে পারবেন না।


প্রজন্মের চেতনা আধুনিকতার শৃঙ্খলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, আর তাই আমরা শোক দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবসের পার্থক্য বুঝি না। আর প্রতিটি দিবসই যেন আনন্দ উল্লাসের সাথে উদযাপনের মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে এই প্রজন্মের কাছে। দুর্বল চেতনা লালনকারী এই প্রজন্মকে খুব কৌশলে ব্যবহারের ফাঁদ পেতেছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। ইতিহাস থেকে এই প্রজন্ম যা শিখেছে তা অন্তরে ধারণ করতে পারেনি। আর যার ফলে তারা বারবার স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ফাঁদে ধরা দেয় অবচেতন মনে। আর স্বাধীনতা বিরোধী চক্র সুযোগ বুঝে এমন ভাবে তাদের ব্রেইন ওয়াশ করে, যা প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা থেকে আলোকবর্ষ দূরে নিয়ে যায় তাদের অজান্তেই।


কোটা সংষ্কার চাই - আন্দোলন হতে পারে তার সব থেকে ভালো উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার ছবি হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো। আবার সময় মতন ছবিগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো আমরা রাজাকার, আমি রাজাকার ইত্যাদি সব প্লাকার্ড। যে রাজাকারদের জন্য আপনার আমার বাবা, ভাই, আত্মীয়, অনাত্মীয়ের বুকটা বুলেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে, যে রাজাকারদের জন্য আপনার আমার মা-বোনদের উপর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়েছে, যে রাজাকারের ফাঁসির খবর শুনে আনন্দ মিছিল করেছেন সেই রাজাকার শব্দটিকে সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে আপনার মস্তিষ্কে স্থাপন করতে আপনার মগজ ধোলাই করে হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো আমি রাজাকার, আমরা রাজাকার লেখা প্লাকার্ড। আর আপনি রাজাকার শব্দটার বীভৎসতা বিবেচনা না করেই নিজেকে স্বঘোষিত রাজাকারে পরিণত করলেন।


আবেগ প্রশমিত করে বিবেক জাগ্রত করে ভেবে দেখুন, যে রক্তমাখা পবিত্র ভূমিতে আমি রাজাকার প্লাকার্ড নিয়ে আপনি যে স্থানটিতে দাঁড়িয়েছেন, সেখানেও হয়তো একাত্তরে কোনো শহীদের রক্ত এখনো লেগে আছে, হয়তো এখানেই কোনো নিরস্ত্র বাঙালির বুকে কালো বুট পরা হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। হয়তো একটু প্রাণে বাঁচার আশায় হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীন ভাবে ছোটাছুটি করছে।


আপনি যখন আমি রাজাকার, আমরা রাজাকার প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছেন তখন যদি ময়লা মাখা ছেঁড়া সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত কোনো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মলিন মুখ,কান্না জড়ানো কণ্ঠ এবং অশ্রুসিক্ত চোখে আপনার কাঁধে হাত রেখে বলে, তুমি এটা কি লিখেছো ? তুমি এটা কেন লিখেছো ? আপনি কি এর উত্তর দিতে পারবেন ?


যুগে যুগে দাবি আদায়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে এই বাংলার মাটিতে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনই হলো একমাত্র আন্দোলন, যা কিনা প্রজন্মকে তার স্বতন্ত্রতা ভুলিয়ে দিয়ে বিপথগামী করেছে। শিক্ষার্থীদের কৌশলে ফাঁদে ফেলে তাদের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা রয়েছে সেই চেতনা দূর্বল করে রাজনৈতিক ফায়দা কায়েম করতে চেয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। কোটা সংস্কার আন্দোলন তার গতিপথ হারিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ফাঁদে পড়ে। চাকরিপ্রত্যাশী প্রজন্ম চায় কোটা প্রদ্ধতির যৌক্তিক সংষ্কার, আর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের লক্ষবস্তু কোটা পদ্ধতির সংষ্কার নয়, শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংষ্কার।


আন্দোলনটি এখন আর কোটা সংষ্কারের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। এই আন্দোলনটি এখন পরিণত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে। কোটা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে তরুণ প্রজন্মকে দূরে ঠেলে দেয়ার বাংলার বুকে একটি ভয়াবহ কালো অধ্যায়, যার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল আমাদের আগামীতে বাঙালি জাতির ইতিহাসের বুকে নতুন কালো অধ্যায় যোগ করতে পারে।


স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ে যখন আর ফায়দা লুটতে পারছে না তখন তারা কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে। এরা এখন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং অন্যান্য সংগঠন এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কৌশলের সাথে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এদের কাজও হলো যে কোনো মূল্যে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট করে সারা দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে বিপাকে ফেলা।


প্রশ্ন হলো, এখানে লাভ এবং ক্ষতিটা কার বা কাদের হচ্ছে ? স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বাংলো ভেঙে চুরমার করলো এবং জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল, মাঝরাতে গুজব ছড়িয়ে মেয়েদের হল থেকে রাস্তায় নামালো, তরুণ-তরুণীদের হাতে আমি রাজাকার লিখিত প্লাকার্ড ধরিয়ে দিল। অর্থাৎ এই প্রজন্মের আবেগ নিয়ে খেলে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাদের এজেন্ডা কিন্তু বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে।


আর তাতে শিক্ষার্থীদের লাভ কি হলো ? তাদেরকে উষ্কানি দিয়ে ক্লাস বিমুখ করা হলো, বাম ছাত্র সংগঠনগুলোও স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সাথে তাল মিলিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়া শুরু করলো। তার মানে শেখ হাসিনার সরকার সেশন জট মুক্ত শিক্ষাঙ্গন দিবেন, সামর্থ্যের মাঝে শিক্ষাবান্ধব যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিবেন, নিয়মিত চাকরির সার্কুলার দিবেন আর এতো সব সুযোগ পেয়েও শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতাবিরোধী, সরকারবিরোধী চক্রের ফাঁদে ধরা দিয়ে তাদের হাতের গুটি হিসেবে কাজ করবে।


যে শিক্ষা মস্তিষ্ক শাণিত করতে পারে না, ভালো মন্দের পার্থক্য করতে পারে না, যুক্তির আলোতে অযৌক্তিকতাকে ঢেকে দিতে পারে না, সৃজনশীলতা সৃষ্টি করতে পারে না, রাজাকার শব্দের অর্থ বোঝাতে পারে না, যে শিক্ষা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করা থেকে বিরত রাখতে পারে না, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হৃদয়পটে সীমাহীন আবেগ সৃষ্টি করতে পারে না, গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করে ভিসি বাংলো ভাংচুর করার প্রতিবাদ করাতে পারে না, বিচার-বিবেচনা বোধ সৃষ্টি করতে পারে না - সে শিক্ষা দিয়ে কী হবে ?


এই শিক্ষা দিয়ে অর্থ উপার্জনের ব্যাবস্থা হতে পারে কিন্তু বিবেকবোধ জাগ্রত হবে না। আর যুগে যুগে এর সুযোগ নিয়ে যাবে ওঁৎ পেতে বসে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এই প্রজন্ম ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি অন্তরে ধারণ করে সংরক্ষণ করতে না পারে তাহলে এমন একটা সময় আসবে যখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিঃশেষ করে দিয়ে আপনাকে আপনার অজান্তে স্বঘোষিত রাজাকার বানিয়ে দূর থেকে পৈশাচিক আনন্দের হাসি হাসবে। তখন মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য যদি আবার কোনো রাজাকের ফাঁসি দেয়া হয়, তখন আপনি কি আনন্দ মিছিলে সামিল হবেন নাকি রাজাকারের মুক্তির দাবির মিছিলে সামিল হবেন ?


এরা খুব কৌশলে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের হাসির পাত্র বানিয়ে ফেললে, এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে প্রজন্মকে আলোকবর্ষ দূরে নিয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন তো ? কারণ, আপনিই তো এদের হাতের গুটি হিসেবে কাজ করেছেন।


লেখক : সাধারণ সম্পাদক, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com