শিরোনাম
যুক্তরাজ্যের লুটনে এক দিন
প্রকাশ : ১০ জুন ২০১৮, ১৬:৪৭
যুক্তরাজ্যের লুটনে এক দিন
শামীমা দোলা
প্রিন্ট অ-অ+

ঘুম ভেঙ্গে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই মনটা ভরে গেল! ওয়াও, ঝকেঝকে সানি ডে! পরক্ষণেই মনে হলো, ইংল্যান্ডে থ্রি ডব্লিউর ভরসা নাই, উইম্যান, ওয়েদার আর ওয়ার্ক। ফলে এই ঝকঝকে আকাশটা এক মুহুর্তেই মুখ গোমড়া করে ফেলতে পারে! সে যাই হোক জানালা দিয়ে যতদুর বাইরেটা চোখে পড় ছে দারুন লাগছে।সবুজে ঢাকা ছোট্ট একটা পাহাড়, তাতে নানা রঙের ফুলে ছেয়ে আছে। বেশির ভাগেরই নাম জানি না।


ইংল্যান্ডে এখন মে মাস। বসন্ত কাল। এই সময়ে স্নো পড়ে না।বেশির ভাগ বাড়িতেই ছোট-বড় ইয়ার্ড আছে। সবাই ফুলের গাছ না হয় সবজি বাগান করে। দেখতে বেশ লাগে। জুনেই শুরু হবে সামার। সেসময়টা অনেক সুন্দর হয় এখানকার প্রকৃতি, মানুষ অনেক এনজয় করে।


আমি এসেছি এখানে পেশাগত কাজে। সব মিলে থাকব তিন সপ্তাহ। বন্ধু, আত্মীয়রা সামার পর্যন্ত থাকার অনুরোধ করছে। কিন্তু দেশে অফিস থেকে রোজ একবার করে ফেরার তাড়া দেয়া হচ্ছে ফেরার জন্য। যদিও আমি বিশ দিন থাকব এটা অফিসে বলেই এসেছি। সময়গুলো যেন দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। আর আছে সপ্তাহ খানেক। আজ রোববার। আজ যাব ইস্ট লন্ডনে বান্ধবীর বাসায়! দেখা করে দিনেই ফিরব আবার এখানে। অবশ্য ইংল্যান্ডে এসেই এই বান্ধবীর বাসায় উঠেছিলাম। এখন আছি লুটনে ভাইয়ের বাসায়।


আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু এল দেখা করতে আমার সাথে। পরিকল্পনা হল সে আমাকে ইস্ট লন্ডনে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে। আমি তার সাথেই রওনা হলাম। আমাকে ইস্ট লন্ডনে বান্ধবীর বাসায় নামিয়ে দিয়ে সে ফিরে এলো আর আমাকে লুটনে ফেরার ট্রেন টিকিট করে দিয়ে গেল। বলে গেল এটা ডিসকাউন্টে কাটা বিশেষ টিকিট।


আমি যখন লুটনে ফিরছি ট্রেনে চেপে আমার বন্ধুটি ফোন দিল আমাকে। জানতে চাইল কোথায় আছি, কী অবস্থা। এরপরে বলল, শোনো তোমার টিকিট ডিস্কাউন্টে কাটা। এটা আমার কার্ড দিয়ে করা, এই টিকিট করলে সাথে কার্ডটি রাখতে হয়। আমি তো কার্ড দিইনি তোমাকে। যেই কার্ডে ডিসকাউন্ট টিকিট কাটা হয় সেটি সাথে না থাকলে পেনাল্টি হয়। আমি তোমাকে টিকিট দিয়ে এসেছি, কার্ড দিইনি।


আমি জানতে চাইলাম, রেগুলার টিকিট না করে কেন ডিসকাউন্ট করেছ! সদুত্তর না দিয়ে সে বলল, তুমি রেগুলার গেটে না গিয়ে পাশে ছোট গেট দিয়ে যাবে। টিকিট চেকার টিকিট দেখতে চাইলে দেব, দিচ্ছি করে বেরিয়ে যাবে! (আসলে রেগুলার গেট দিয়ে টিকিট পাঞ্চ করে গেলেই হতো, সেখানে টিকিট চেকার টিকিট চেক করে না, বিশেষ গেটেই চেকার থাকে) আমি বললাম, আমি রেগুলার গেট দিয়েই যাব, চেকার জানতে চাইলে আমি ঘটনা খুলে বলব যে আমি নিজে টিকিট করিনি। তারপরেও পেনাল্টি চাইলে দেব। কিন্তু আমার বন্ধু মরিয়া হয়ে বোঝাল বিশেষ গেট দিয়েই যাওয়া উচিত।


আমি স্টেশনে নেমে ছোট গেট খুঁজতে লাগলাম। আমার ভাব-ভঙ্গি দেখে চেকার এগিয়ে এল সহযোগিতা করতে। টিকিট দেখতে চাইলে আমি টিকিট বাড়িয়ে দিলাম এবং যা হবার তাইই হল। চেকার কার্ড দেখতে চাইল, আমি দেখাতে পারলাম না। তখন চেকার আমাকে ২২ পাউন্ড পেনাল্টি করল। আমার কাছে আছে ১৭ পাউন্ড, আমি সেটি দিয়ে বললাম, আমার কাছে এর বেশি নেই। তুমি চাইলে ডলার নিতে পার। আমার অপ্রস্তুত, ইনোসেন্ট চেহারা দেখে চেকার জানতে চাইল, টিকিট কে করে দিয়েছে। আমি জবাব দিলাম আমার বন্ধু। সে একটু হেসে বলল, সে তোমার বন্ধু না। তোমাকে ডিসকাউন্টে টিকিট কেটে দিয়েছে; কিন্তু কার্ড দিয়ে যায়নি। তার কাছ থেকে দূরে থাকবে। আমার প্যানাল্টির সব পাউন্ড ফেরত দিয়ে বলল, এখানে কার বাসায় উঠেছো? আমি বললাম কাজিনের বাসায়। তিনি বললেন, একা যেতে পারবে না, আসো ট্যাক্সি করে দিই। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম আমি একা চলতে চাই, আর ট্যাক্সি না, হেটেই যাব গুগল ম্যাপ সাথে নিয়ে। আমি নিজে নিজে ডিসকভার করতে চাই, চিনতে চাই সব। ব্রিটিশ টিকিট চেকার হেসে আবারো বললেন, আর ইউ শিওর? তুমি একাই যেতে পারবে ইয়ং লেডি! আমাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় নিলেন ব্রিটিশ ভদ্রলোক!


বাসায় ফিরে দেখি আমার ভাবি পথ চেয়ে রাস্তায় মোটামুটি পায়চারী করছেন। আমার মোবাইল ফোনটি কি কারনে যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে দেখে ভাবি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। ভাইয়াকে ফোন দিয়ে জানালেন আমি ফিরেছি। কাজ থেকে ভাইয়া এর মাঝে নাকি কমপক্ষে পঞ্চাশ বার কল করেছেন। তার ধারনা লুটনে ফেরার পথে একটি বড় রেল জাংশন টাইপ আছে। ওখানে ট্রেন বদলাতে হয়। ওই স্টেশন থেকে সারা ইউরোপে ট্রেন যায়। ভাইয়া আর ভাবী ভয় পাচ্ছিলেন, আমি ভুল করে আবার ইউরোপের ট্রেনে উঠে পড়িনি তো! আমি বাসায় ফিরে একদম সোজা দোতলায় আমার রুমে চলে গেলাম। দরজায় খিল আটকে চুপচাপ বসে থাকলাম অনেক সময়।


এর মাঝেই আমার বন্ধুবর ফোন করলেন। যদিও এসব বন্ধুর সাথে আমি ক্যাম্পাসে কখনো মিশি নাই। আমি ঘটনার বিস্তারিত জানাতেই সে আমাকে আবারো বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল, বলল, তুমি কাল স্টেশনে গিয়ে পেনাল্টির ২২ পাউন্ডদিয়ে আসবে। না হলে তোমার কাজিনের বাসায় চিঠি আসবে। সেই টাকা তাদের দিতে হবে। আমি বললাম, আমার একদম এমন মনে হচ্ছে না। আমার কাজিনের বাসার ঠিকানা তারা রাখেনি। ইভেন তারা আমাকে এমন কিছু বলেওনি। সে আমাকে বার বার বোঝাতে চাইল, তুমি এখানকার ব্যাপার বোঝ না! আমি নিচে নেমে ভাবিকে ঘটনা খুলে বলতেই ভাবী রেগে গেলেন আমার বন্ধুর উপর। উনি বললেন যদি কোনো চিঠি আসে আমরাই পেনাল্টি দিব। সমস্যা নাই। আপনার বন্ধুটা আসলেই ফাজিল। গ্রাম্য মোড়লের মত। রেগুলার গেটে টিকেট পাঞ্চ করলে কিচ্ছু হত না। ডিসকাউন্ট টিকেট আর রেগুলার টিকেটের জন্যে আলাদা কোন পাঞ্চিং ব্যবস্থা তো নাই। বরং বিশেষ গেটেই পাঞ্চিং ব্যবস্থা নাই, সেখানে চেকার টিকেট চেক করে। আপনাকে ধরা খাওয়াতেই সে ইচ্ছা করে এই বুদ্ধি দিয়েছে।


আমার স্বদেশি বাঙ্গালী বন্ধুটি কেন এমন করেছিল তা আজো আমার কাছে বিস্ময়। কিন্তু লুটনের ব্রিটেশ টিকেট চেকারের ব্যবহার, সহযোগিতা আর সৌহার্দ্য আমি কোনো দিন ভুলব না। এসব কারণেই একটি দেশ, একটি জাতি এগিয়ে যায়।


লেখক : সাংবাদিক


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com