দারুণ একজন ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। সঙ্গীতের প্রতিও অাগ্রহ ছিলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছিলেন অামাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন।
রাষ্ট্রপ্রধানের সন্তান হয়েও সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ছিলেন বাংলাদেশ সেনবাহিনীর ক্যাপ্টেন। যে দেশের জন্য লড়াই করেছিলেন যেই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন মাত্র ২১ বছর বয়সে। সেই সেনাবাহিনীর বর্বর সদসদের হাতেই খুন হন তিনি।
বলছি শেখ জামালের কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে। শেখ কামাল সম্পর্কে মোটামুুটি তথ্য পাওয়া গেলেও অনলাইনে শেখ জামাল সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পেলাম না। অাওয়ামী লীগও কি শেখ জামাল সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো বই প্রকাশ করেছে? জানা নেই। তারপরেও খোঁজাখুঁজি করে যা পেলাম তাই লিখছি।
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল অাজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।
১৯৭১ সালে অামাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে ৩২ নম্বর থেকে গ্রেফতার করা হয় শেখ জামালকে। ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডে বন্দীদশা থেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শেখ জামাল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লংকোর্সের প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার।
বিএনপি জামায়াতসহ বঙ্গবন্ধুবিরোধী অনেকেই কথায় কথায় বলেন, যুদ্ধের সময় তো বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যরা গ্রেফতার ছিলেন। কী করেছেন তারা? অথচ বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার জন্য যখন হুমকি দেয়া হচ্ছে, তিনি যখন মৃত্যভয়কে উপেক্ষা করছেন, ওদিকে তার দুই ছেলে তখন যুদ্ধ করছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন। পুরো পরিবার বন্দী। তবে পরিজন ভুলে অার দশটা স্বাধীনতাকামী তরুণের মতো বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর ভারতের বেলুনিয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে পাসিং অাউট করে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শেখ জামালের জন্য বিষয়টা ছিল অারো কঠিন। কারণ শেখ কামালের মতো তিনি শুরুতেই পালাতে পারেননি। পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে তাকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডির বাড়িতে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার ধমনীতে তাকে কে আটকে রাখবে?
স্বস্ত্রীক শেখ জামাল
একাত্তরের আগস্টের একদিন সকালে মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব আবিষ্কার করলেন, তার সন্তান জামালকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বামী এবং এক সন্তানকে আদৌ আর কখনো দেখতে পাবেন কিনা জানেন না, এর মধ্যেই শেখ জামালকে খুঁজে না পেয়ে চরম আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। উদ্বিগ্ন ফজিলাতুন্নেন্সা মুজিব তার সন্তানকে অপহরণের অভিযোগ তুললেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তার এই অভিযোগ আলোড়ন তুললো সারা বিশ্বে। অনেকগুলো বিদেশি পত্রিকা নিউজ করলো, পাকিস্তানিরা গুম করেছে বন্দী শেখ জামালকে।
শেখ জামাল তখন কোথায়? বুকের মধ্যে তখন তার মুক্তির গান। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পালিয়েই শেখ জামাল সরাসরি চলে গিয়েছিলেন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে। তারপর ট্রেনিং শেষ করবার পর তাকে মুজিব বাহিনীতে নেয়া হয়। এরপর শুরু করেন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ। কিন্তু শেখ জামালের এই খবরটা প্রবাসী সরকার গোপন রাখে যাতে পাকিস্তানি বাহিনী বন্দী মুজিব পরিবারের কাউকে হত্যার কথা ভাবতেও না পারে। বিশেষত বন্দী অবস্থায় পাক বাহিনীর হেফাজত থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছেলের গায়েব হয়ে যাওয়ার খবরে প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়েছিল পাকিস্তানিরা।
তবে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের যেসব আলোকচিত্র ছাপা হয়েছিল, তার একটিতে সীমান্তের ১০ মেইল ভেতরে সাবমেশিনগান হাতে শেখ জামালকে যুদ্ধ করতে দেখা যায়। অামার যতোটুকু মনে পড়ে প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মুসা বিষয়টি নিয়ে সংবাদ করেছিলেন।
যারা বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অাত্মত্যাগ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করেন তারা একবার ভাবুন তো বাবা গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানের জেলখানায়। মা বোনেরা পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী। দুই ছেলে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে। কেউ কারো খোঁজ জানেন না। একটা পরিবার দেশের জন্য অার কতোটা অাত্মত্যাগ করবে!
পরিবারের সদস্যদের সাথে
শেখ জামালও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ জামালের প্রথমে যুগোশ্লাভিয়া এবং পরে ব্রিটিশ রয়েল মিলিটারি অ্যাকাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বর্বর ঘাতকদের বুলেট সব থামিয়ে দেয়। মাত্র ২১ বছর বয়সে হারিয়ে যায় সম্ভাবনাময় এক তরুণ, রাষ্ট্রপতির সন্তান হয়েও যাদের জীবন কেটেছে সাধারণের, যারা দেশের জন্য অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন।
অামার মাঝে-মধ্যে মনে হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি সন্তান যদি বেঁচে থাকতেন কেমন হতেন অাজকে? সেই অাশা পূরণের কোনো সুযোগই যে রাখেনি ঘাতকেরা। তাই ২১ বছরের এক তরুণের জন্য অাজ শুধু জন্মদিনের শুভেচ্ছা। স্যালুট মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল।
লেখক : প্রোগ্রাম হেড, মাইগ্রেশন, ব্র্যাক
বিবার্তা/শরিফুল/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]