শিরোনাম
১৭ই এপ্রিল, বাঙ্গালির শতবর্ষের পরাধীনতা থেকে মুক্তি
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:৩৬
১৭ই এপ্রিল, বাঙ্গালির শতবর্ষের পরাধীনতা থেকে মুক্তি
কে. এম. আহসান হায়দার
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সুজা উল-মুলক (দেশ নায়ক),হাশিম উদ-দৌলা (রাষ্ট্রের তরবারি),জাফর আলী খান বাহাদুর,মাহাবাত জঙ্গ (যুদ্ধের নায়ক)- এই টাইটেলগুলো যার নামের সাথে যুক্ত তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার পরিচিত এবং বাংলার ইতিহাসে ঘৃণিত নাম মীর জাফর আলী খান। ইংরেজ প্রভাবিত বাংলার একজন নবাব। তাঁর শাসনামল ভারতে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার শুরু এবং সমগ্র উপমহাদেশে ব্রিটিশ সম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।


নবাব সিরাজউদ্দৌলা নদীয়ার পলাশীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। মীর জাফর ছিলেন উক্ত যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। তার অধীনের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার জন্য নবাবকে পরাজয় বরণ করতে হয়। তার বেঈমানির মাশুল গুনতে হয়েছিল পুরো বাংলাকে। বরণ করতে হয়েছিল ইংরেজদের কাছে পরাধীনতা। শোষণ, বঞ্চনা এমনকি এখন পর্যন্ত এর প্রভাব বিদ্যমান।


ইরানি নাজাফি বংশোদ্ভূত সৈয়দ আহমেদ নাজাফি (মীর মিরাক) এর দ্বিতীয় সন্তান মীর জাফর ১৬৯১ সালে ইরানে জন্মগ্রহণ করে। বাংলার এই বেঈমান দুই মেয়াদে (১৭৫৭–১৭৬০) এবং (১৭৬৩–১৭৬৫) বাংলাকে শাসন করেছে। ৭৪ বছরের জীবনে মোট চারবার ১৭২৭ সালে শাহ খানুম সাহিবা, ১৭৪৬ সালে মুন্নি বেগম, মুত'আহ স্ত্রী রাহাত-উন-নিসা বেগম, বাব্বু বেগম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।তার বারো জন সন্তানাদি হলেন সাদিক আলী খান (মীর মিরন), নাজিমউদ্দিন আলী খান, নাজাবুত আলী খান (মীর ফুলওয়ারি), আশরাফ আলী খান, মুবারক আলী খান, হাদী আলী খান, ফাতিমা বেগম, মিসরি বেগম, রোশান-উন-নিসা বেগম (নিশানি বেগম), হুসাইনি বেগম, ও আরো দুই কন্যা যাদের নাম জানতে পারিনি।


মীর জাফর পারস্য থেকে নিঃস্ব অবস্থায় ভাগ্যান্বেষণে বাংলায় আসেন এবং বিহারের নায়েব নাযিম আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন।


কীভাবে এই নিঃস্ব নাজাফি বাংলার নবাব হয়ে উঠলেন?


১৭৪০ সালের ৯ এপ্রিল বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদের গিরিয়ায় বাংলার নবাব সরফরাজ খান এবং বাংলার অধীনস্থ বিহারের নায়েব নাযিম আলীবর্দী খানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে সরফরাজ খান পরাজিত ও নিহত হন এবং আলীবর্দী খান বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হন। গিরিয়ার যুদ্ধে হাজী আহমদ, নওয়াজিশ মুহম্মদ খান, মীর জাফর আলীবর্দী খানের হয়ে নবাব সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং খ্যাতি লাভ করেন। আলীবর্দী নবাব হওয়ার পর মীর জাফরকে তার কৃতিত্বের জন্য মনসবদার পদ প্রদান করেন এবং তার বেতন হয় মাসে ১০০ টাকা।


নবাব আলীবর্দী তাঁর বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানুমকে মীর জাফরের সঙ্গে বিবাহ দেন। পরবর্তীতে মীর জাফর নবাবের পুরাতন সৈন্যদলের প্রধান 'বখশী' বা প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন।


১৭৪১ সাল থেকে মারাঠারা বাংলায় আক্রমণ করে লুটতরাজ চালাতে থাকে এবং পরবর্তী দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী মারাঠাদের আক্রমণ চলতে থাকে। ফলে নবাব আলীবর্দীকে বিরামহীনভাবে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়। মীর জাফর মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সেনানায়ক হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৭৪১ সালের ডিসেম্বরে মীর জাফর মারাঠা বাহিনীকে পরাজিত করে উড়িষ্যার বড়বাটি দুর্গ দখল করেন এবং সেখানে সপরিবারে মারাঠাদের হাতে বন্দি উড়িষ্যার নায়েব নাযিম (এবং আলীবর্দীর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা) সৈয়দ আহমদ খানকে মুক্ত করেন। মারাঠাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী অভিযানগুলোতেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৭৪৬ সালের ডিসেম্বরে মেদিনীপুরে একটি বৃহৎ যুদ্ধে মীর জাফর মারাঠা বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন এবং এজন্য নবাব আলীবর্দী তাকে উড়িষ্যার নায়েব নাযিম পদ প্রদান করেন। মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্রমাগত সাফল্য অর্জন করে মীর জাফর ক্রমশ উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালোভী হয়ে পড়েন।


মেদিনীপুরে মীর জাফরের সাফল্য লাভের সংবাদে মীর হাবিব ও জানুজী ভোঁসলের নেতৃত্বে একটি সুবৃহৎ মারাঠা বাহিনী উড়িষ্যা থেকে মেদিনীপুরের দিকে অগ্রসর হয়। এতে ভয় পেয়ে মীর জাফর পালিয়ে যান এবং বর্ধমানে আশ্রয় নেন। তখন আলীবর্দী মীর জাফরকে সহায়তা করার জন্য সৈন্যসহ আতাউল্লাহ খানকে প্রেরণ করেন। কিন্তু মীর জাফর ও আতাউল্লাহ মারাঠাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর না হয়ে আলীবর্দীকে হত্যা করার ও তাঁর রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ফলে আলীবর্দী নিজেই সসৈন্যে অগ্রসর হন। মীর জাফর তার পলায়নের জন্য অনুতপ্ত না হয়ে নবাবের প্রতি উদ্ধত আচরণ করলে নবাব তাকে পদচ্যুত করেন। অবশ্য পরবর্তীতে তাকে আবার পূর্বপদে বহাল করা হয়। কিন্তু মীর জাফর এসময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৭৫০ সালে মীর জাফরের দুর্নীতির নানা তথ্য প্রকাশিত হলে নবাব তাকে ভর্ৎসনা করেন এবং মীর জাফরের ওপর নজর রাখার জন্য মীর জাফরের ভাই মির্জা ইসমাইলের পরিবর্তে খাজা আব্দুল হাদীকে সহকারী প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন।


যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মীর জাফর যেরূপ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, শেষের দিকে সে কৃতিত্ব ধরে রাখতে পারেননি। ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্দী গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে মীর জাফর ও রায় দুর্লভকে মারাঠাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা নিশ্চেষ্টভাবে সময়ক্ষেপ করতে থাকেন এবং অবশেষে বৃদ্ধ নবাবকেই মারাঠাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে হয়।


দীর্ঘ দশ বছর সংঘর্ষের ফলে উভয়পক্ষই ক্রমশ ক্লান্ত ও অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। ১৭৫১ সালের মে মাসে মারাঠা নেতা রঘুজী ভোঁসলে ও মীর হাবিব মীর জাফরের মাধ্যমে নবাব আলীবর্দীকে সন্ধির প্রস্তাব দেন। আলীবর্দী সন্ধির প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের অবসান ঘটে। এই চুক্তির ফলে উড়িষ্যা কার্যত মারাঠাদের হস্তগত হয়, সন্ধি অনুযায়ী, মীর হাবিব নবাবের অধীনে উড়িষ্যার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং আলীবর্দী মারাঠাদের বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা হারে চৌথ প্রদান করতে রাজি হন। তারপরেও অভ্যন্তরীণ সমস্যা সৃষ্টিকারী মীর জাফর নবাবের প্রধান সেনাপতির পদে বহাল থাকেন।


নবাব আলীবর্দী খান তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার নবাব করায় ক্ষুব্ধ হন মীর জাফর। তাই তিনি প্রধান সেনাপতি হয়েও কখনোই সিরাজউদ্দৌলাকে নবাব হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। সব সময় তিনি চেয়েছেন বাংলার নবাবের পতন। বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভ এর সাথে তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং পলাশীর যুদ্ধে মূলত তার কারণেই ব্রিটিশদের হাতে সিরাজদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। এই বিশ্বাসঘাতী ষড়যন্ত্রে ইয়ার লতিফ, জগত শেঠ, রায় দুর্লভ, উঁমিচাদ প্রমুখ সামিল ছিল। এই যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীরজাফরকে নবাবের মসনদে অধিষ্ঠিত করে।


১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজ বেনিয়াদের সঙ্গে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যদের লড়াই হয়। এই যুদ্ধে নবাবের পক্ষে স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীরজাফর আলী খান। তার সঙ্গে ছিলেন গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান বকশী মীরমদন আর সেনাপতি দেওয়ান মোহনলাল। তারা দুজনেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে লড়াই করে পরাজিত হন। আর যুদ্ধের ময়দানে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খান ও তার দোসররা ধূর্ত ইংরেজ বেনিয়া লর্ড ক্লাইভের হাতে বাংলার শাসন ক্ষমতা তুলে দেয়। পরাজিত হন বাংলা, বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। মুষ্টিমেয় ইংরেজ শাসক বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় বাংলায় তাদের শাসন ক্ষমতা পোক্ত করে এবং সোয়া দুইশ বছর এদেশ শাসন করে। সেই থেকেই মীরজাফরের নাম বিশ্বাসঘাতকতার রূপক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মুর্শিদাবাদে তার বাড়িটি নিমকহারাম দেউড়ি নামে পরিচিত।


মীর জাফর আলীবর্দী খানের উত্তর সূরী নবাব সিরাজ উদ্দৌলার প্রতি কপট আনুগত্য দেখাতেন। পলাশীর যুদ্ধে তিনি নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেন। ইংরেজদের সাথে মীর জাফরের পূর্বেই এই মর্মে একটি চুক্তি ছিল যে, যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হলে মীর জাফর হবেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব। বিনিময়ে মীর জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পাঁচ লক্ষ পাউন্ড ও কলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয়দের আড়াই লক্ষ পাউন্ড প্রদান করবেন। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত, সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হলে মীর জাফর বাংলার নবাব হন। কিন্তু ব্রিটিশদের দাবিকৃত বিপুল অর্থের যোগান দিতে তিনি সমর্থ হননি। ১৭৫৮ সালে রবার্ট ক্লাইভ তার প্রতিনিধি খোজা ওয়াজিদের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, মীর জাফর চিনশুরায় ওলন্দাজদের সাথে একটি চুক্তি করেছেন। হুগলি নদীতে ওলন্দাজ জাহাজের আনাগোনা দেখতে পাওয়া যায়। এসব কিছু চুঁচুড়া যুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ কর্মকর্তা হেনরী ভেন্সিটার্ট মীর জাফরের কাজে সহায়তা করার জন্য তাঁর জামাতা মীর কাশিমকে বাংলার সহকারী সুবাদার নিয়োগ করার জন্য প্রস্তাব করেন। ১৭৬০ সালে কোম্পানি মীর জাফরকে মীর কাশিমের নিকট ক্ষমতা অর্পণ করতে বাধ্য করে। মীর কাশিম ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তি, একজন স্বাধীনচেতা নবাব এবং তিনি বাংলাকে স্বাধীনভাবে শাসন করার ইচ্ছা পোষণ করতেন। ফলশ্রুতিতে ইংরেজদের সাথে তাঁর দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং ১৭৬৩ সালে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুনরায় মীর জাফরকে নবাব করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত মীর কাশিম এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। বরং তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি বাংলার শাসন ক্ষমতায় ইংরেজদের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে চাননি। তিনি অযোধ্যার নবাব, এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে একটি সামরিক মৈত্রি চুক্তি করেন। ২২ অক্টোবর ১৭৬৪ সালে দুই পক্ষের মধ্যে বক্সারের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে মীর কাশিম এর সম্মিলিত বাহিনী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর মীর জাফরকে পুনরায় নবাব হিসাবে ঘোষনা করা হয়। ১৭৬৫ সালের ১৭ জানুয়ারি মীর জাফরের মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর নওয়াবীর অবসান ঘটে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদজেলার জাফরগঞ্জ কবরস্থানে এই ঘৃণিত ব্যক্তির সমাধি আছে।


১৭৬৫ সালের পর নাজিমউদ্দিন আলী খান বাংলার ক্ষমতায় আসেন। তিনি ছিলেন মীর জাফরের দ্বিতীয় পুত্র। নাজিম-উদ-দৌলা তার পিতা মীর জাফরের মৃত্যুর পর রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। রাজ্যাভিষেকের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। তিনি ফেব্রুয়ারি ৫, ১৭৬৫ সালে সিংহাসনে আরোহন করেন। ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়লাভের ফলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম-এর কাছ থেকে দেওয়ানী (রাজ্য শাসণের জন্য পদ) লাভ করে। ১৭৬৫ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নবাব কর্তৃক ব্রিটিশদের কাছে দেওয়ানী অর্পণ করা হয়। নাজিমুদ্দিন, মুর্শিদাবাদের দূর্গে রবার্ট ক্লাইভের সম্মানে দেওয়া একটি পার্টিতে জ্বরে আক্রান্ত হন এবং ১৭৬৬ সালের ৮ই মে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে জাফরগঞ্জের সমাধিক্ষেত্র সমাহিত করা হয় এবং উত্তরাধিকারসূত্রে তার ছোট ভাই নাজাবুত আলী খান নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। নাজাবুত আলী খান, সাইফ উদ-দৌলা নামেই বেশি পরিচিত। তিনি ছিলেন মুন্নী বেগম ও মীর জাফরের তৃতীয় পুত্র। সিংহাসনে আরোহনের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর এবং তিনি তার মাতা মুন্নী বেগমের তত্ত্বাবধানে রাজ্য পরিচালনা করতেন। তিনি তার মায়ের তত্ত্বাবধানেই সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং ১০ই মার্চ ১৭৭০ সালে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৭৭০ সালের ১১ই মার্চ বড় ভাই নাজাবত আলী খানের মৃত্যুর পর নিজেকে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব নাজিম হিসেবে প্রচারণা চালান ও ১৭৭০ সালের ২১শে মার্চ মুর্শিদাবাদের খাহার ব্যালিশে দুর্গে অফিসিয়ালি নবাব হিসেবে আসন গ্রহণ করেন মীর জাফর বাহাদুরের চতুর্থ সন্তান সৈয়দ আশরাফ আলী খান বাহাদুর। কিন্তু সিংহাসনে আরোহণের কিছুদিন পরই ১৭৭৩ সালের ২৪শে মার্চ তিনিও গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।


আশরাফ আলীর মৃত্যুর পরে বংলার নবাব হন মীর জাফরের পঞ্চম সন্তান মুবারক আলী খান। ৬ই সেপ্টেম্বর ১৭৭৩ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন আশরাফ আলী খানের অন্যতম প্রধান স্ত্রী ফাইজ-উন-নিসা বেগমের পুত্র নবাব নাজিম বাবর আলী খান। বাবর ১৯৭৩ সালে সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে ১৮১০-এর ২৮শে এপ্রিল তার মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮১০ সালে বাবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র জৈনুদ্দিন আলী খান নাবাবের সিংহাসনে আরোহণ করেন। জাইন উদ্দিন ছিলেন বাবর আলী খান ও বাবু বেগমের জ্যেষ্ঠপুত্র। ১৮১০ সালের ৫ই জুন তাঁর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। ১৮২১ সালের ৬ই আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তবে মৃত্যুর সময় তিনি তিনটি কন্যাসন্তান রেখে যান। কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সৎ-ভাই আহমেদ আলী খান সিংহাসনে আরোহণ করেন। এভাবে নাজাফি রাজবংশ ব্রিটিশদের ছায়াতলে বংলা শাসন করেছে এবং বাংলায় নিজেদের বংশ বিস্তার করেছে ও তাদের অনুসারী একটি এলিট শ্রেণীর তৈরি করেছে যারা মূলত ছিল শোষণকারী।


এদিকে শত শত বর্ষ ধরে শোষণ, বঞ্চনা আর দূর্ভিক্ষে নিঃশেষ হয়েছে বাঙালী জাতি। এর পরে অনেক জল গড়িয়েছে বাংলার বুকে। পুতুল সরকার এসেছে আর গেছে। শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। তারপরে কিভাবে আবার বাঙালীরা নিজেদের স্বাধিকার ফিরে পেয়েছে?


নবাব আলীবর্দী খান মেধাবী ও বুদ্ধিমান মীর জাফরকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন। সেই চতুর ও কপট মীরজাফরের বেঈমানির জন্য ২৩ জুন ১৭৫৭ পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীন বাংলার নবাব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়। পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত ২১৪ বছর বাঙালী জাতি পরাধীন বা বিদেশীদের দ্বারা শাসিত হয়ে এসেছে। এই শাসন আর বঞ্চনা থেকে মুক্ত হবার জন্য বাঙালী বারবার চেষ্টা করেছে, আত্নত্যাগ করেছে, রক্ত দিয়েছে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা জোটেনি বাঙালীর ভাগ্যে।


ইংরেজ গেল তারপরে আসল পাকিস্তান নামক আরেক হায়েনার দল। শতবছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে বাঙালীদের স্বাধীনতার স্বাদ ফিরিয়ে দিতে এবং বাঙালিদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দল আত্নপ্রকাশ করে। তারপরে আরো ২৩ বছর আন্দোলন আর সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে এ জাতি এবং বাংলা ভাষাকেকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড উপহার দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হয়ে যান টুঙ্গিপাড়ার দুরন্ত ছেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তার ইতিহাসের অংশীদার হয়ে যান বাংলার দামাল ছেলেরা যাদের আমরা বলি “বীর মুক্তিযোদ্ধা”।


১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার সাথে সাথে বাঙালি জাতির সূর্য সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ হয় মুজিবনগর। কিন্তু বসে থাকেনি রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি নামধারী নব্য মীরজাফর। তারা হত্যা করেছে নিরীহ বাঙালীদের এবং বাঙালীকে মেধাশূন্য করে দেবার জন্য নিরস্ত্র বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়। একদিকে হানাদার আরেকদিকে তাদের সহযোগী বেঈমানের দলের বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতা আর বীরত্বের স্বাক্ষর রেখে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে এই দেশকে শতবর্ষের পরাধীনতার জাল থেকে মুক্ত করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।


স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, বাংলাদেশ। দুইশত বছর পরে আবার স্বাধীন বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় বাঙালী জাতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশ গঠন শুরু করেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালীদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন তাদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরী দেন। সবাইকে নিয়ে দেশ গঠন করতে মনোযোগী হন জাতির পিতা। যাতে সবাইকে নিয়ে এ দেশ চলতে পারে এবং বাঙালী জাতির মেরুদণ্ডে যেন মুক্তিযোদ্ধারাই থাকেন এটাই চেয়েছিল বাঙালী জাতি। কিন্তু বসে থাকেনি নব্য মীরজাফর ও তার বংশধরেরা। তারা এখনো বসে নেই।


আজ ১৭ই এপ্রিল। ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। আজকের দিনে শপথ এই হোক “মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় মীরজাফরের ঠাঁই নাই, মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই”।


তথ্যসূত্রঃ


১। Encyclopedia Britannica of India volume III page 382 ISBM 978-81-8131-008-8


২। রজতকান্ত রায় (১৯৯৪)। পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা ১৩৫।


৩। ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, (বাংলাদেশের ইতিহাস), আলীবর্দী ও মারাঠা আক্রমণ, পৃ. ২৯৩–২৯৯


৪। "Forgotten Indian history: The brutal Maratha invasions of Bengal"।


৫। Mohammad Shah (2012), "Mir Jafar Ali Khan", in Sirajul Islam and Ahmed A. Jamal, Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second সংস্করণ), Asiatic Society of Bangladesh


লেখক : ফ্রিল্যান্স লেখক ও সাবেক সহ-সভাপতি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ


বিবার্তা/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com