খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম ঝরনা দুটির নাম তৈদুছড়া ঝরনা। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তৈদু’ মানে হল ‘পানির দরজা’ আর ছড়া মানে ঝরনা। অসাধারণ সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা এই ঝরনাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। খাগড়াছড়িতে যে কয়টি দর্শনীয় স্থান রয়েছে তৈদুছড়া তাদের মধ্যে অন্যতম।
এখানে পাহাড় আর সবুজ বুনো জঙ্গেলর মাঝে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের ভাঁজ দিয়ে বয়ে চলে ঝরনার জল। শীতল স্বচ্ছ টলমলে জলের কলকল করে ছুটে চলার শব্দে মুখিরত চারিপাশ। ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়া পানি এসে পড়ছে পাথুরে ভূমিতে। অন্য সকল ঝরনার মত এর পানি সরাসরি উপর হতে নিচে পরছে না। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মত তৈরি হওয়া পাথুরে ধাপগুলো অতিক্রম করে নিচে পড়ছে।
দীঘিনালা খাগড়াছড়ি জেলার একটি উপজেলা। ঢাকা কিংবা খাগড়াছড়ি হতে গাড়ি নিয়ে সরাসরি যাওয়া যায় দীঘিনালায়। তৈদুছড়া ভ্রমণের জন্য খাগড়াছড়িতে রাত্রি যাপন না করে দীঘনালায় থাকাই উত্তম। এখানে থাকার জন্য একটি ভাল মানের রেস্টহাউজ আছে।
যোগাযোগ করলে হয়তো আগে থেকেই এটি বুকিং করা সম্ভব, অথবা গিয়েও বুকিং করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বুকিং পাওয়াটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হবে। আর একান্ত রেস্টহাউজ না পেলে এখানকার স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে কোন না কোন একটি থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গাড়ি নিয়ে দীঘিনালা হতে সামনে এগিয়ে চাপ্পাপাড়া পর্যন্ত যাওয়া যায়। এর পর আর গাড়ি চলার কোন পথ না থাকায় বাকি পথটুকু হেঁটেই যেতে হবে।
দীঘিনালা হতে সব মিলিয়ে তৈদুছড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগে। নির্ভর করে হাঁটার গতির উপর। সুতরাং সকালে রওয়ানা দিলে অনায়েসেই সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসা সম্ভব। এই আসা যাওয়ার পথটি মোটেও বিরক্তিকর নয়। হাঁটতে হাঁটতে যতটা না ক্লান্তি আপনাকে গ্রাস করবে তার চাইতেও বেশি গ্রাস করবে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নেশা। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় যে আপনি আসক্ত হবেনই।
কেবল দীঘিনালা থেকে তৈদুছড়া নয়, খাগড়াছড়ি প্রবেশের পর হতে আপনার জন্য কেবল বিস্ময় অপেক্ষা করবে। যে দিকেই চোখ যাবে কেবল সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ আর সাদা কুয়াশার মত মেঘ আপনাকে মোহাবিষ্ট করে রাখবে। পাহাড়ের পর পাহাড়, মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঘর। এমন নির্জন আর নির্মল প্রকৃতি হয়তো কখনো আপনি আর দেখেননি। অবাক হয়ে শুধু ভাবতে হয় বাংলার প্রকৃতি এত সুন্দর কেন? আকাশ আর পাহাড়ের মিতালি আপনাকে বিমুগ্ধ করবে আর ভ্রমণের সময় কেটে যাবে মুহূর্তের মাঝে।
চাপ্পাপাড়া কিংবা পোমাংপাড়া হতে দুর্গম পথ, অনেক গুলো ঝিরি, উঁচুনিচু পাহাড়, কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও বুক সমান পানি আর বুনো জঙ্গল পাড়ি দিয়ে অবশেষে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটার পর আপনি পৌঁছবেন প্রথম ঝরনাটিতে। এটি প্রায় ৬০ ফুট উঁচু। ঝরনামুখ হতে পানি পাহাড়ের গাঁয়ে পরে তা পাহাড় বেয়ে নিচে এসে ছোট একটি হ্রদের মিলিত হয়েছে। অসাধারণ সেই দৃশ্য।
প্রথম ঝর্ণার ডানপাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠলে খুব কাছাকাছি পেয়ে যাবেন দ্বিতীয় ঝরনাটি। এখানে প্রায় ৮০-৮৫ ডিগ্রি এঙ্গেলের ঢাল বেয়ে বানরের মত প্রায় ১০০ ফুট উপরে উঠতে হবে। উপরে উঠলে প্রথমেই চোখে পড়বে ঝরনা মুখ যেখান হতে প্রথম ঝরনার পানি পড়ছে। দ্বিতীয় ঝরনা হতে ঝিরি পথে পানি আসছে এখানে। ঝিরি পথ ধরে প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটলে পরে পৌঁছানো যায় দ্বিতীয় ঝরনাটিতে। এই চলার পথটি যেমন কষ্টকর তেমনি রোমাঞ্চকর আর আহামরি সুন্দর। উপর থেকে প্রচণ্ড বেগে পানি নেমে আসছে। এই বেগ ঠেলে পানি বরাবরই হাঁটতে হয়। ডানে বায়ে যেখানে পানির স্রোত কম সেখানে শ্যাওলা জমেছে।
একটুতেই পা পিছলে যায়। মাঝে মাঝে এখানে পানির স্রোত খুব বেশি যে ধাক্কা দিয়ে নিচে নিয়ে যেতে চায়। তাই এখানে পা টিপে টিপে অনেক সাবধানে হাঁটতে হবে। একবার পিছলে গেলে কয়েকশ হাত দূরে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। এখান হতে আরো উপরে উঠতে হবে। চলার পথে পারি দিতে হবে বড় বড় পাথর আর কোমর সমান পানি। অতপর পেয়ে যাবেন দ্বিতীয় তৈদু ঝর্ণা।
অপূর্ব অসাধারণ আর নয়নাভিরাম সে ঝরনা। এটি এতই দৃষ্টিনন্দন আর ব্যতিক্রম যে কারো আর তর সইবে না। ঝরনার নিচে ঝাঁপিয়ে পরতে মন চাইবে। ঝরনাটি প্রায় ৮০ ফুট উঁচু। ঝরনার পানি এসে সরাসরি যেখানে পড়ছে সেখানে সিঁড়ির মত অনেকগুলো পাথুরে ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো বেয়ে পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে।
ধাপগুলোতে দাঁড়িয়ে অনায়েসেই গোসলের কাজটি সেরে নেয়া যায়। দীর্ঘ ক্লান্তিকর হাটার কষ্ট মুহূর্তেই ধুয়ে যাবে ঝরনার জলে। ঝরনার জলের শীতল পরশ আপনাকে ক্ষনিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে আবার কতটা পথ আবার হাঁটতে হবে ফেরান জন্য।
এখানে সারা বছরই পানি থাকে। শীতে জলপ্রবাহ কমে যায়। আর বর্ষার হয়ে উঠে পূর্ণ যৌবনা। তবে শীতের আগে ও বর্ষার শেষে এখানে ঘুরতে যাওয়া উত্তম সিদ্ধান্ত। ঝরনার আশে পাশে কেবল যেন সবুজেরই সমারোহ। পাশের পাহাড়গুলোতে চলে জুম চাষ। পাহাড়ের সবুজের মাঝে জুম ফসলের মাঠ যেন যোগ করেছে ভিন্ন এক সবুজের।
মনে হবে যেন সবুজের মাঝে সবুজের আঁচল। শুধু তাই নয় এখানকার আদিবাসীদের আথিতেয়তা আপনাকে মুদ্ধ করবে। আদিবাসীদের সাথে পরিচয় ও আলাপচারিতা আর যাত্রা পথের দৃশ্যাবলী অবলোকন হতে বঞ্চিত হলে আপনার তৈদুছড়া ভ্রমণটি অপূর্ণই থেকে যাবে। জলপ্রপাত, ঝিরি, পাহাড়ি জীবন, আকাশ আর পাহাড়ের মিতালি, শিবছড়ি পাহাড়ের পাথরের শিব মূর্তি, পাথরের হাতি ও পাথরের সাপ সব কিছু মিলিয় আপনার চোখ ভরে যাবে তৃপ্তিতে, আপনি তুলবেন প্রাপ্তির ঢেঁকুর।
যেভাবে যেতে হবে: ঢাকা থেকে বাসে করে খাগড়াছড়ি। কিছু পরিবহন প্রতিদনিই ছেড়ে আসে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে। খাগড়াছড়ি হতে বাসে করে আসতে হবে দীঘিনালায়। দীঘিনালায় রাত্রি যাপন, সাথে তৈদুছড়া আসার জন্য প্রশাসনের অনুমতি গ্রহণ ও গাইড নির্বাচন, পরেরদিন ভোরে দীঘিনালা হতে গাড়িতে/মোটরসাইকেলে করে চাপ্পাপাড়া। চাপ্পাপাড়া হতে পায়ে হেঁটে তৈদুছড়া। তিন ঘণ্টা হাঁটার পর পৌঁছবেন প্রথম ঝরনায় এবং আরো এক ঘণ্টা পাহাড় ট্রেকিং ও ঝিরি পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে দ্বিতীয় ঝরনাতে।
কোথায় থাকবেন: যারা খাগড়াছড়ি থাকতে চান তারা এখানে থাকার জন্য অনেক ভাল মানের হোটেল পাবেন। তবে দীঘিনালায় থাকার জন্য ভাল ব্যবস্থা বলতে একটি। সেটি হল দীঘিনালা রেস্ট হাউজ।
পরামর্শ: দীঘিনালা হতে তৈদুছড়া যাবার পথে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য ও পানীয় নিতে হবে। ব্যাকপ্যাক হালকা নিতে হবে। না নিয়ে পারল উত্তম। সাথে কিছূ শুকনা কাপড় রাখতে পারেন। মোবাইল ও ক্যামেরার জন্য জলনিরোধ ব্যাগ নিতে হব স্যালাইন, গ্লুকোজ ও ফাস্ট এইড।
বিবার্তা/জিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]