প্রাথমিক শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ : শিক্ষার্থীরা চেনে না বর্ণই!
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৩, ১০:০৫
প্রাথমিক শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ : শিক্ষার্থীরা চেনে না বর্ণই!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ শিশু বাংলা বর্ণই চেনে না! ইংরেজি বর্ণ চেনে না ১৬ শতাংশ শিশু। গণিতেও একই অবস্থা। এ বিষয়ে ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ শিশু এক অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যা শনাক্ত করতে পারে না। সব থেকে ভয়াবহ অবস্থা ইংরেজিতে। এ বিষয়ে ছেলে শিশুর মধ্যে ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের একটি বর্ণও পড়তে পারে না। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।



এই বিষয়ে জরিপ সংশ্লিষ্টরাসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা বলছেন, যোগ্য শিক্ষককের অভাবসহ নানা কারণে এমনটি হচ্ছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতসহ নানামুখী কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে এই সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব।



বুধবার, ১৪ জুন ‘শিক্ষার্থীদের শিখন স্তরের বর্তমান অবস্থা ও শিক্ষার গুণগত মান অর্জন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে এই জরিপের ফল তুলে ধরা হয়। দ্য সাউথ এশিয়ান অ্যাসেসমেন্ট অ্যালায়েন্স কমিউনিকেশনস অ্যান্ড কোলাবোরেটিং ফর চেঞ্জ (ইওএল) প্রকল্পের মাধ্যমে ওয়েভ ফাউন্ডেশন খুলনা ও রাজশাহী জেলায় ৮৮টি গ্রামের ৭১টি বিদ্যালয়ে এবং ১ হাজার ৭৬০টি পরিবারের ১ হাজার ৫৩৩ জন শিশুর ওপর সিটিজেন লেড অ্যাসেসমেন্ট নামক জরিপটি পরিচালনা করা হয়।


জরিপে বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সাড়ে ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না। এর মধ্যে রয়েছে ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী ও ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী, যার গড় দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অপরদিকে গণিতেও একই অবস্থা। এ বিষয়ে ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ শিশু এক অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যা শনাক্ত করতে পারে না। শুধু ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দুটি যোগ সমস্যার সমাধান করতে পারে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের দুটি বিয়োগ ও দুটি ভাগ সমস্যার সমাধান করতে পারে না যথাক্রমে ৭৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং ৯৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ শিশু। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ইংরেজিতে। এ বিষয়ে ছেলে শিশুর মধ্যে ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের একটি বর্ণও পড়তে পারে না!


জরিপে অভিভাবকদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও যাচাই করা হয়। এতে দেখা গেছে, যেসব শিশুর পিতা-মাতার মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ছিল, তারা ভাষার দক্ষতার ক্ষেত্রে ভালো করেছে, তাদের তুলনায় স্বল্প শিক্ষিত পিতা-মাতার শিশুদের ভাষার দক্ষতা সন্তোষজনক ছিল না।


জরিপ পরিচালনাকারী সংগঠনটি বলছেন,শিক্ষার্থীদের (৫-১৬ বছর বয়সী) অভিগম্যতা পর্যালোচনা ও শিক্ষার গুণগত মান পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের মৌলিক পঠন ও গাণিতিক শিখন যাচাই করার জন্য এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।


এই বিষয়ে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বিবার্তাকে বলেন, ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সব ছেলে ও মেয়ে যাতে কার্যকর, ফলপ্রসূ অবৈতনিক, সমতাভিত্তিক ও গুণগত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষালাভের সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করতে আমাদের ফাউন্ডেশন কাজ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উদ্যোগে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ওয়েভ ফাউন্ডেশনের ইওএল প্রকল্পের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো- শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা; অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা; শিক্ষকদের ক্লাস পরিচালনায় নিয়মিতকরণে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।


তিনি বলেন, শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে শ্রেণির পড়া শ্রেণিতেই সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা; অবকাঠামোগত উন্নয়ন তথা পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা; শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; শিক্ষকদের বেতনকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো; শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা; সময়োপযোগী পাঠ্যপুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও বিতরণ করা; স্কুল ফিডিং কার্যক্রম প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিশেষ করে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় চালু করা এবং শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে নীতিনির্ধারক, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সব অংশীজনের মতামতের আলোকে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।


এই বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধরী বিবার্তাকে বলেন, আমাদের মাথায় রাখতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা একজন শিশুর ভিত্তি গড়ার স্থান। কাজেই এই স্থান থেকে আমাদের শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে কাজ করতে হবে। আর এই কাজের জন্য যা যা দরকার, সেই সব উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র আয় বাড়লে শিক্ষার উন্নতি হবে, তা নয়। যে গবেষণা ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। আমার আহ্বান, ভবিষ্যতে যেন গবেষণার পাশাপাশি সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরা হয়।


এদিকে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা বলছেন, যোগ্য শিক্ষককের অভাবসহ নানা কারণে প্রাথমিকের শিক্ষায় এই সংকট। এক্ষেত্রে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতসহ নানামুখী কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে এই সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব।


এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, এটা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং যারা এই পেশায় আসবে তাদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে শিক্ষকতায় আনতে হবে। তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবীরা থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা যে বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পায় আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা পায় না। তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় কেন যেতে চাইবে?


প্রাথমিকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার উপায় কী জানতে চাইলে ড. আরেফিন সিদ্দিক বলেন,যেকোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তিটা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। কাজেই প্রাথমিক শিক্ষায় যদি আমরা মেধাবী শিক্ষকদের না রাখতে পারি, তাহলে আমরা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে রাখবো। শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি শক্তিশালী করতে হয়, মানসম্পন্ন করতে হয় তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। আর এখানে গুরুত্বারোপ করার প্রথম শর্তই হচ্ছে, ভালো শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। আর ভালো শিক্ষক পেতে হলে অবশ্যই ভালো সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।


বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ বলেন, এখানের ( প্রাথমিকের) শিক্ষকদের বন্ধু -বান্ধব তো সরকারিসহ অন্যান্য জায়গায় যাবে। ফলে তাদের সাথে শিক্ষকদের বেতনও সমকক্ষ হওয়ার দরকার আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীরা এখানে সুযোগ পেলেও তাদেরই অনেকে এখানে থাকার আগ্রহ পাচ্ছেন না! কেন পাচ্ছেন না? কারণ, এখানে বেতনভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা কম রয়েছে। কাজেই ভালো শিক্ষকদের ধরে রাখতে আমাদের এদিকটিতে অবশ্যই উন্নতি করতে হবে।


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, একটা কথা আমি সবসময় বলি,শিক্ষকদেরও একটা ক্ষমতায়নের বিষয় আছে। এই ক্ষমতায়ন অন্যান্য পেশার মতো পাওয়ার এক্সেসাইজের বিষয় নয়। শিক্ষকরা নিজেদের যে ফ্রীডম, মর্যাদা, তা অন্য ক্যাডারের সঙ্গে যখন তুলনা করে তখন তার মধ্যে অনেক সময় হীনমন্যতা কাজ করে। প্রশাসনিকভাবেও আমরা দেখেছি, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডারের এক ধরণের সামাজিক বৈষম্য কাজ করে। ক্যাডারের বিভিন্ন জায়গায় অনেক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে। আর তাদের ক্ষমতা থাকতেই পারে, সেটা নিয়ে আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু শিক্ষকদের যখন মনিটরিংসহ অন্যান্য জায়গায় তাদের অধীন করা হয়। তখন একজন প্রাইমারী শিক্ষকও দেখেন নিজেকে ক্ষমতাবৃত্তির বাহিরে থেকে অধীনস্থ হয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষকতা যে ক্রিয়েটিভ ও সৃজনশীল জায়গা, সেই বিষয়টিও তখন তাদের মাথায় থাকে না। যারা ক্ষমতার চর্চা করেন, সেই ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে যদি শিক্ষক পড়ে যান তখন এই চাকরির প্রতি শিক্ষকের অনীহার সঙ্গত কারণ আছে। কারণ সে চাইবে না তার সমরূপ বা সম পর্যায়ের কেউ তার উপর কর্তৃত্ব করুক। কিন্তু বাস্তবতা তাই হচ্ছে।


এই শিক্ষাবিদ বলেন, অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে শিক্ষক যাতে ক্ষমতাহীন না হয়ে যায়, সেই বিষয়টি দেখতে হবে। তাহলে শিক্ষকদের মধ্যে ফ্রীডম আসবে। আর কিছু বিষয় তো আছেই। শিক্ষকতায় কাজ করলে কিছু সুযোগ সুবিধার ঘাটতি থাকে। সেগুলো তো একদিনে বাড়ানো যাবে না। তবে তাদের সুযোগ সুবিধা অবশ্যই দিতে হবে। শিক্ষকদের সে প্রাইমারি স্কুল হোক বা অন্য জায়গার হোক তাদের দেশে- বিদেশে উন্নততর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাটা আবশ্যক


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com