স্মরণ-শ্রদ্ধার পরদিনই কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার যেন বিনোদন পার্ক!
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৩১
স্মরণ-শ্রদ্ধার পরদিনই কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার যেন বিনোদন পার্ক!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

জুতো পরে কেউ তুলছে সেলফি, কেউ দিচ্ছে আড্ডা। আবার কেউবা বাদামের খোসাসহ বিভিন্ন উচ্ছিষ্টাংশ এখানে ফেলছে। এ যেন কোনো বিনোদন পার্ক। তবে সুস্থ বিবেকবোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক কোনো মানুষের কাছে এ দৃশ্য ভালো লাগবে না।


কেননা, স্থানটি ভাষা শহিদদের সম্মানে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। যে স্থানে একদিন আগে অর্থাৎ মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি"- গানের সুরে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। সে স্থানে একদিন পরেই তার উল্টো দৃশ্য। এই দৃশ্য অবমাননার, এই দৃশ্য লজ্জার।


বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গিয়ে দেখা যায়, এ যেন পার্কের দৃশ্য। মিনারের মূল বেদীতে জুতো নিয়ে ওঠার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কে শুনছে কার কথা? মিনারের মূল বেদীর দিকে ঢুকতেই দুই দিকে দুটি বড় সাইনবোর্ড রয়েছে। আর তাতে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে, শহিদ মিনারের গাম্ভীর্য রক্ষা করুন। আর মূল বেদীতে জুতো পায়ে ওঠা ও বসা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ।



এ নির্দেশনার পর কয়েক কদম সামনে গেলে বুঝা যায়, নির্দেশনাটি শুধু সাইনবোর্ডেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে কেউ এটার তোয়াক্কা করছে না। এখানে আগত অনেকে মিনারের মূল বেদিতে উঠে গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কেউ নিজের ইচ্ছামত মিনারের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেলফি তুলছে। আবার অনেকে পায়ে জুতো নিয়েও মিনারের মূল বেদিতে উঠে পড়ছে। সেখানে খোশ-গল্পতে মেতে থাকছে।



আবার কাউকে পরিবার নিয়ে মিনারের পাদদেশে বসে থাকতে দেখা যায়৷ তখন তাদের ছোট সন্তানরা মূল বেদীতে উঠে খেলছে। তারাও তৃপ্তি নিয়ে তাদের সে খেলা দেখছে। এ যেন খেলার স্থান!



অবাক করার বিষয় হলো, কেউ তাদের নিষেধও করছে না। যেন শহিদ মিনারকে দেখার কেউ নেই? অথচ একদিন আগেও এ স্থানে বেজেছে একুশের গান। সেদিন মানুষের শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। অথচ পরের দিনই করা হচ্ছে অবমাননা!



এদিন সরেজমিনে আরও দেখা যায়, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের চারপাশে দর্শনার্থীরা বাদামের খোসাসহ নানা ধরনের খাবারের উচ্ছিষ্ট মিনারের পাদদেশে ফেলছে। ফলে মিনার প্রাঙ্গণ হয়ে উঠছে অপরিচ্ছন্ন, নোংরা। এরপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে এ এলাকায় ভীড়ও বাড়তে থাকে। মিনার প্রাঙ্গণে আলোর ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়।



বাদাম বিক্রেতা মো. আনিস বিবার্তাকে বলেন, এই এলাকায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এলে অসামাজিক-অবৈধ কাজও চলে। কেউ বসে গাঁজা খায়, আবার কেউ আরও নানা খারাপ কাজ করে। এসবের খোঁজ রাখে না কেউ।


এদিন মূল বেদীতে জুতো পায়ে দিয়ে বসে কয়েকজন যুবক খোশ-গল্পে ব্যস্ত ছিল। জুতো পায়ে দিয়ে বেদীতে বসে আছেন কেন? তাদের এ প্রশ্ন করলে প্রথমে তারা প্রতিবেদককে উত্তর না দিয়ে তার পরিচয় জানতে চায়। এরপর প্রতিবেদক তার সাংবাদিক পরিচয় দিলে তারা উত্তরে বলেন, আমরা এখানে প্রায়ই আসি। আর জুতোও খুলি না। কিন্তু কেউ তো কিছু বলে না।



কেউ কিছু না বললেও আপনারা জুতো নিয়ে এখানে বসতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা জানি এটা ঠিক নয়। এরপরে তারা সেখান থেকে উঠে যান।


শহিদ মিনারের মূল বেদীর পাশে আরো কয়েকজন যুবক সিগারেট টানতে টানতে বাদাম খেয়ে উচ্ছিষ্টাংশ মিনারের পাদদেশে ফেলছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদক তাদের পরিচয় জানতে চাইলে একজন বলেন, তার নাম বিজয় হোসেন । তিনি আজিমপুর থেকে বন্ধুদের নিয়ে শহিদ মিনারে এসেছেন।


কী উদ্দেশে এখানে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘুরতে ও আড্ডা দিতে এসেছি। শহিদ মিনার আড্ডা দেয়ার জায়গা কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই এখানে আড্ডা দেয় তাই আমরাও আড্ডা দিচ্ছি। সবার এখানে আড্ডা দেয়ার বিষয়টা ঠিক হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে বন্ধুদের নিয়ে অন্যত্র চলে যান।


শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিশাদুর রহমানের সাথে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এটা কোনো বিনোদন পার্ক। মানুষ ইচ্ছেমত যা খুশি, তা এখানে করছে। এমনকি অসামাজিক-অবৈধ কাজও এখানে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভাষা শহিদদের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থান এভাবে মর্যাদাহানি হচ্ছে, বিষয়টা ভাবতে অবাক লাগছে। কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে ভাষা শহিদদের স্মৃতি অক্ষুণ্ন রাখা উচিত।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী খালেদ হাসান বিবার্তাকে বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন ভাষা শহিদরা। তাদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে মাতৃভাষা বাংলা। তাই ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। এই শহিদ মিনার ও ভাষা শহিদদের নিয়ে দেশের মানুষ গর্ববোধ করেন। অথচ একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবসের আগে-পরে কিছুদিন এ শহিদ মিনারের কদর থাকলেও সারাবছরই অবহেলা আর অযত্নে পড়ে থাকে এ স্মৃতির মিনার। এটা কোনভাবে মানা যায় না।


নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য বিবার্তাকে বলেন, কোনো বড় ধরনের অনুষ্ঠান ছাড়া এ স্থানের প্রতি কারও নজর থাকে না। যার ফলে এখানে শহিদ মিনার অবমাননাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ হয়ে থাকে। অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে শহিদ মিনারকে রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তার জোরদারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।


ভাষাসৈনিক রেজাউল করিম মুঠোফোনে বিবার্তাকে বলেন, ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে নির্মিত শহিদ মিনার অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে এ বিষয়টা আমাদের খুব দুঃখ দেয়। আমরা আরো বেশি দুঃখ পাই যখন শুনি, আমার বন্ধুদের বুকের উপরে জুতো পরে ঘুরে বেড়ানো হয়। সরকারের উচিত শহিদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।


ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধার পরদিনই শহিদ মিনারের অবমাননার বিষয়ে অবগত করা হলে অমর একুশে উদযাপন ২০২৩ কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূইয়া বিবার্তাকে বলেন, ২১ শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। কিন্তু মাত্র ১ দিন যেতে না যেতেই জুতো পায়ে মূল বেদীতে উঠাসহ মিনারকে নানাভাবে নাজেহাল করা খুবই দুঃখজনক। আমাদের অবশ্যই কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের ভাব গাম্ভীর্য প্রটেস্ট করা উচিত।


 


তিনি বলেন, ভাষা শহিদদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে মাতৃভাষা বাংলা। কাজেই ভাষা শহিদদের স্মৃতি বিজরিত শহিদ মিনারের অবমাননা কোনভাবে মানা যায় না। এক্ষেত্রে সরকারিভাবেও উদ্যোগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাথে রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যাতে মিনার প্রাঙ্গণের ভাব গাম্ভীর্য বজায় থাকে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বিবার্তাকে বলেন, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার উন্মুক্ত এলাকা হওয়ার কারণে জাতির এই স্মৃতির মিনারকে যেভাবে রাখা দরকার, সেইভাবে রাখা যাচ্ছে না। আসলেই কোন উন্মুক্ত এলাকাকে সঠিকভাবে রাখা যায় না।  


তিনি বলেন, শহিদ মিনার ভাষা আন্দোলনের প্রতীক, বাঙালি জাতির প্রতীক। দর্শনাথীসহ সবাই সহযোগিতা করলে জাতির এই নিদর্শনকে সুন্দর রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে শহিদ মিনারের সম্মান রক্ষার্থে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com