‘ভাষা শহীদদের আদর্শের বাস্তবায়ন পূর্ণতা দিতে পারে বাঙালি জাতিকে’
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩০
‘ভাষা শহীদদের আদর্শের বাস্তবায়ন পূর্ণতা দিতে পারে বাঙালি জাতিকে’
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনের এক অবিস্মরণীয় দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনে লড়াই, সংগ্রামের এক গৌরবময় ঐতিহ্যের বড় একটি অধ্যায়। ১৯৫২ সালের এই দিনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকার রাজপথে জীবন দেন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে।


বায়ান্নর সেই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধিকার আদায়ের দাবিতে প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল বাঙালি জাতি। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রতিটি গণআন্দোলনে প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তাসী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এসব লড়াই, সংগ্রামে অনুঘটক হিসেবে প্রেরণা জুগিয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন।



বিশিষ্টজনরা বলছেন, একুশের চেতনায় বাঙালি উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বলে একাত্তরে আমাদের আত্মপরিচয় হয়েছে। একুশে বাঙালির আত্মচেতনার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা নানা আন্দোলন, সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়। ভাষা শহীদরা একটি আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছিলেন। একবিংশ শতাব্দীর এই প্রহরে তাদের আদর্শ ভুলে গিয়ে মাতৃভাষা দিবস পালন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে আদর্শের জন্য তারা জীবন দিয়েছেন সে আদর্শ প্রতিষ্ঠাই কেবল তাদের ত্যাগের পূর্ণতা দিতে পারে।



জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, একুশ আমাদের জাতিসত্তার বীজ। একাত্তরে সেটাই মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। ভাষা আন্দোলনের শুরুটা ছিল ৪৮-তে আর তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল বায়ান্নতে।


তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তখন ছাত্রনেতা। ভাষা আন্দোলন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। সেই সময়ে ১১ মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং সেদিন ঢাকা শহরের মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। সেখান থেকে তিনি সহ প্রায় ৪০জন গ্রেফতার হয়েছিলেন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক আহত হলেন। ১১ মার্চের বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে যাচ্ছেন তার প্রাক্কালে তখন তিনি বলেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝখানে ১২০০ মাইলের দূরত্ব। এই দূরত্বে স্বাধীন মাতৃভাষা এবং স্বাধীন মাতৃভূমি দরকার।


আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, পরবর্তীতে আমরা দেখেছি সেই বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। পুরোটা সময় তিনি একই পথে চলেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন শুরু করলেন তখন এর সাথে আসলো বাঙালির আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক এবং মুক্তির অধিকার। সে অধিকার গুলো আদায়ের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিলেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে ছয় দফা পেলাম, পরে গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম।


তিনি বলেন, আজকে আমরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ঠিক একইভাবে ভাষা আন্দোলনের নেতা, বাংলাদেশের নির্মাতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্মাতা জাতির পিতার আদর্শ স্মরণ করা দরকার। বাংলা ভাষা শুধু এখন বাঙালি জাতির নয়; একুশে ফেব্রুয়ারি এখন সারা পৃথিবীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমরা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি যে, ভাষার জন্য জীবন দেয়া যায়। আমরা জীবন দিয়ে সেটা প্রমাণ করেছি। আমাদের উচিত হবে বাংলা ভাষা বটেই সকল মাতৃভাষাকে কিভাবে সুরক্ষা করা যায়, সমৃদ্ধ করা যায় সেই প্রচেষ্টা করা।


একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বিবার্তাকে বলেন, সাতচল্লিশ সালে ভারত বিভক্তির হয়েছে। পাকিস্তান হলো যার একটি অংশ ছিল পূর্ব বাংলা। সেসময় মূলত ছিল ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজনটা হয়েছিল এবং সেখানে বলা হয়েছিল আমাদের প্রধান পরিচয় হবে আমরা মুসলমান। কিন্তু পরে ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রকৃত আত্মপরিচয়ের সন্ধান দিল। আমরা প্রথমে বাঙালি। তারপর মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। এটি ছিল আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনা। প্রকৃত অর্থে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার চেতনা।


তিনি বলেন, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এসব না হলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হতো না। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় হয়েছে আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে। যেখানে চার মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’কে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় মুক্তিযুদ্ধকালে, ভাষা আন্দোলনের সময় যারা আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল তাদের রাজনীতি এখনো সক্রিয় এখনো আছে। ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করা হয়েছে। যা ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।


শাহরিয়ার কবির বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি যখন আমরা ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাই তখন মনে রাখতে হবে তারা একটি আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের আদর্শ ভুলে গিয়ে মাতৃভাষা দিবস পালন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে আদর্শের জন্য তারা জীবন দিয়েছে সে আদর্শ আমরা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করতে পারি তবেই আমরা পূর্ণ বাঙালি জাতি হিসেবে দাবি করতে পারি।


বিবার্তা/সোহেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com