গাজায় মানবিক বিরতির প্রস্তাব পাস, রাজি নয় ইসরায়েল
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ২০:২২
গাজায় মানবিক বিরতির প্রস্তাব পাস, রাজি নয় ইসরায়েল
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বুধবার ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবিক বিরতির প্রস্তাব পাস হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরু হওয়ার প্রায় দেড় মাসের মাথায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ প্রস্তাব পাস হয়। নিরাপত্তা পরিষদে দ্রুত লড়াই থামিয়ে গাজায় আরও মানবিক প্যাসেজ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে ইসরায়েল।


১৬ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা এপি এ খবর জানিয়েছে।


ইসরেয়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিওর হাইয়াত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ২৩৯ জন পণবন্দিকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল লড়াই থামাবে না। আপাতত গাজায় নতুন কোনো করিডোর বা প্যাসেজ তৈরির প্রশ্ন ওঠে না বলেও জানিয়েছেন তিনি।


ইসরায়েলের আকাশপথ ও স্থল হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। ক্রমবর্ধমান এ সংকট মোকাবিলায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের গাজায় ‘জরুরি ও বর্ধিত মানবিক বিরতির’ আহ্বান জানিয়ে বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে মাল্টা।


এ প্রস্তাবের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১২ সদস্যই ভোট দিয়েছে। বিপক্ষে ভোট দেয়নি কোনো দেশ। ভেটো শক্তিও প্রয়োগ করেনি পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের কেউ। তবে বিপক্ষে কেউ ভোট না দিলেও ভোটদানে বিরত ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া।


উত্থাপিত প্রস্তাবে বেশ কয়েক দিনের জন্য গাজা উপত্যকায় সংঘাত বন্ধ ও করিডর খোলার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের সহযোগিদের পূর্ণাঙ্গ, নিরাপদ ও বাধাবিহীন চলাচলের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে।


এছাড়া, গাজায় হামাসের হাতে বন্দি সব ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিককে মুক্তি দেয়ার দাবিও জানানো হয়।


বস্তুত, জাতিসংঘের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, গাজা থেকে আহত, অসুস্থ মানুষ-সহ বেসামরিক ব্যক্তিদের বার করার জন্য আরও নতুন প্যাসেজ তৈরি করা হোক। এখন কেবলমাত্র মিসরের সীমান্তে একটি করিডোর ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু মূলত বিদেশিদের বার করার জন্যই ওই রাস্তা ব্যবহার করা হচ্ছে।


ইসরায়েল জানিয়েছে, এমন কোন করিডোর তৈরি করার কোন প্রশ্নই নেই এখন। প্রথমে পণবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে, তারপরেই লড়াই বন্ধ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলের দাবি, জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে হামাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে হবে। গাজা স্ট্রিপের নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গাজায় ইসরায়েলের আধিপত্য মেনে নেয়ার কথাই ঘুরিয়ে বলতে চেয়েছে ইসরায়েল।


এর আগেও, গাজা যুদ্ধের ইস্যুতে চারবার বৈঠকে বসেছে নিরাপত্তা পরিষদ। তবে এতদিন ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের বাধায় কোন প্রস্তাবই পাস হয়নি।


মাল্টার জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত ভেনেসা ফ্রেজিয়ার বলেছেন, আজ আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রথম ধাপ অর্জন করেছি। অপরিণামদর্শী সশস্ত্র এ সংঘাতে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং শিশুদের দুর্দশা প্রতিরোধে আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকব।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি


ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী সারা নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্ত্রী জিল বাইডেনকে একটি চিঠি লিখেছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, হামাস যাদের পণবন্দি করেছে, তাদের মধ্যে ৩২ বছরের এক নারী বন্দি অবস্থাতেই এক সন্তানের জন্ম দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সারা জানিয়েছেন, বন্দিদের মধ্যে ৩২ জন বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। দ্রুত তাদের মুক্তির জন্য জিল বাইডেনকে আবেদন জানাতে বলেছেন সারা। তাদের যৌথ আবেদনের ভিত্তিতে বন্দিদের যাতে মুক্ত করা যায়, সে কথা চিঠিতে জানিয়েছেন তিনি।


ইসরায়েল জানিয়েছে, এমন কোন করিডোর তৈরি করার কোন প্রশ্নই নেই এখন। প্রথমে পণবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে, তারপরেই লড়াই বন্ধ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলের দাবি, জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে হামাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে হবে। গাজা স্ট্রিপের নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।


বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গাজায় ইসরায়েলের আধিপত্য মেনে নেওয়ার কথাই ঘুরিয়ে বলতে চেয়েছে ইসরায়েল।


জাতিসংঘের প্রস্তাব নিয়েও বিতর্ক


বুধবার জাতিসংঘ যে প্রস্তাব পাস করেছে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য- যাদের হাতে ভেটো দেয়ার শক্তি আছে, কেউই সেই ভোটে অংশ নেয়নি। মাল্টা এই প্রস্তাব টেবিলে রেখেছিল। বাকি ১২টি দেশ তা সমর্থন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য ছিল, ‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। প্রস্তাবে হামাসের বিষয়েও কোন কথা বলা হয়নি। ৭ অক্টোবরের ঘটনার কোন উল্লেখ নেই।


প্রস্তাবে সম্মত নয় ইসরায়েল


তবে এ প্রস্তাব মানছে না ইসরায়েল। প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার পরপরই নিরাপত্তা পরিষদে দেয়া ভাষণে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি দূত গিলাড এরডান বলেন, ইসরায়েল এ প্রস্তাব মানবে না। তার দাবি, গাজায় মানবিক পরিস্থিতির উন্নয়নে ইসরায়েল এমনিতেই সাধ্যমতো সবকিছু করছে।


এরডান বলেন, এ পরিষদ মাত্রই যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে, তা দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত। এ পরিষদ এখনো গত ৭ অক্টোবর হামাসের চালানো হামলা নিয়ে নিন্দা জানাতে পারেনি। প্রস্তাবটিতে কেবল গাজার মানবিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কী কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো, তার উল্লেখ নেই।


ইসরায়েলি দূত এরডানের দাবি, আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার কথা ইসরায়েলকে মনে করিয়ে দিতে কোন প্রস্তাবের প্রয়োজন নেই। ইসরায়েল সব সময় আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে। জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনাটা ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকারের বিষয়। লক্ষ্য পূরণে ইসরায়েলের যা কিছু করার, তা করবে।


গিলাড এরডান এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবটিকে অর্থহীন বলে উল্লেখ করেছেন। তার দাবি, হামাস এ প্রস্তাব মানা তো দূরের কথা, পড়েও দেখবে না।


হাসপাতালে অভিযান


গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালে এখনও অভিযান চলছে ইসরায়েলের। ইসরায়েলের দাবি, হাসপাতালের ভিতর থেকে তারা অস্ত্র পেয়েছে।


অন্যদিকে ডাব্লিউএইচও জানিয়েছে, হাসপাতালের ভিতর ইসরায়েলের এই অভিযান কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অবিলম্বে এই অভিযান বন্ধ হওয়া দরকার।


হামাস জানিয়েছে, হাসপাতালের ভিতর থেকে তারা লড়াই চালায়নি। ইসরায়েলের দাবি সর্বৈব মিথ্যা। এদিকে, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, এখনো হাসপাতাল চত্বরে মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে।


মসজিদে আবারো বোমা হামলা: নিহত ৫০


এদিকে এখনো গাজায় বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উপত্যকার সাবরা এলাকার একটি মসজিদে বোমা হামলায় অন্তত ৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ডজন খানেক আহত হয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার মধ্যেই বিভিন্ন হাসপাতাল ও মসজিদগুলোতে বোমা হামলা করছে তেল আবিব। ইরানি সংবাদমাধ্যম প্রেস টিভি এ খবর জানিয়েছে।


বুধবার বিকালে প্রেস টিভির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নামাজের সময় মসজিদে বোমা হামলা করেছে ইসরায়েল। আক্রমণের সময় মুসুল্লিতে পরিপূর্ণ ছিল মসজিদ।


তাছাড়া দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরের টেলিকমিউনিকেশন টাওয়ারে বিমান হামলা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই হামলায় একজন শিশু নিহত হয়েছে।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর গাজাবাসীকে দক্ষিণ গাজায় সরে যেতে বলেছে ইসরায়েল। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা বলছে, গাজার সব জায়গায় বোমা হামলা করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গাজার কোনো স্থানই আমাদের জন্য নিরাপদ না।


ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে অন্তত ১১ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৪ হাজার ৭১০ জন শিশু এবং ৩ হাজার ১৬০ জন নারী রয়েছেন। তাছাড়া ৩২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com