শিরোনাম
প্রকৃতির অজানা শত্রু পার্থেনিয়াম !
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:৩৪
প্রকৃতির অজানা শত্রু পার্থেনিয়াম !
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে মানুষ বসবাস করে থাকে। আর এই প্রকৃতির অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে উদ্ভিদ। মানুষের বসবাসের কেন্দ্রের চারদিক ঘিরে থাকে নানান উদ্ভিদ, গাছ, লতা ও পাতা। আর এই গাছ, লতা ও পাতার মধ্যে কিছু উদ্ভিদ, লতা, পাতা রয়েছে যা প্রাণী জগতকে উপকার করে। আবার এমন কিছু লতা, পাতা ও উদ্ভিদ রয়েছে যা প্রাণী জগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।


কোন উদ্ভিদ গুলো আমাদের জন্য উপকারী এবং কোনগুলো ক্ষতিকর এই বিষয়ে আমরা প্রায় ধারণা রাখি না, ফলে এই সকল উদ্ভিদের কাছে যাওয়ার ফলে মানুষ ও প্রাণীকুলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। আমাদের চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমনই একজাতীয় ক্ষতিকর উদ্ভিদ সম্পর্কে আজ আলোচনা করবো। যার নাম পার্থেনিয়াম। প্রকৃত অর্থে পার্থেনিয়াম এক ধরনের বিষাক্ত আগাছা। যা পরিবেশে থেকে মানুষ ও প্রাণীদের নানান ক্ষতি করে।


পার্থেনিয়ামের ইংরেজি রূপ PERTHENIUM এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম Parthenium Hysterophorus. বাড়ির আশেপাশে, রাস্তার ধারে, বনজঙ্গলে বা ফসলের ক্ষেতে পার্থেনিয়াম জন্ম ও বিস্তার লাভ করে। এই বিষাক্ত উদ্ভিদটি সাধারণত উচ্চতায় ১-১.৫ মিটার পর্যন্ত হয়। পার্থেনিয়াম দেখতে সাধারণত হাইব্রিড ধান গাছের মতো। শাখা বিস্তারের মাধ্যমে এর আকৃতি গম্বুজ আকৃতির অথবা ঝোপ আকারের হয়ে থাকে। পার্থেনিয়ামের পাতা সাধারণত গাজরের পাতার ন্যায় শাখা যুক্ত ত্রিভুজের মতো তারকা আকৃতির বিন্যাস্ত থাকে। এই উদ্ভিদে নিদিষ্ট বয়সে ফুল ফোটে। সাধারণত ফুলকপির মত গোলাকার, সাদা, আঠালো এবং পিচ্ছিল হয়ে থাকে এর ফুল।



পার্থেনিয়ামের মূল উৎপত্তিস্থল মেক্সিকো। মেক্সিকোতেই সর্বপ্রথম এই উদ্ভিদের জন্ম হয়। সেখান থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে একে একে আমেরিকা, আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশেসহ বিভিন্ন দেশে। পার্থেনিয়ামের একটি গাছ চার হাজার থেকে ২৫ হাজার অতিক্ষুদ্র বীজের জন্ম দিতে পারে। একটি গাছ বাঁচে তিন থেকে চার মাস। এই সময়ের মধ্যেই তিনবার ফুল ও বীজ দেয় গাছটি। এই বীজ এতো ক্ষুদ্র যে সাধারণত গবাদিপশুর গোবর, গাড়ির চাকার কাদামাটি, পথচারীদের জুতা-স্যান্ডেলের তলার কাদামাটি, সেচের পানি ও বাতাসের সঙ্গে এর বিস্তার ঘটে।


পার্থেনিয়াম একজাতীয় ছোট উদ্ভিদ হলেও প্রাণী জগত ও মানবজীবনে পার্থেনিয়ামের রয়েছে নানান ক্ষতিকর প্রভাব। এই আগাছায় sesquiterpene lactones নামক টক্সিন বা বিষ থাকে। যা গঠিত হয় caffeic acid, vanillic acid, ansic acid, p-anisic acid, chlorogenic acid, এবং parahydroxy benzoic acid দ্বারা। এই বিষ মানুষ সহ অন্যান্য জীবের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়াও এই আগাছা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা অন্যান্য ফসলের বৃদ্ধি হ্রাস করে।


কিছুদিন আগেও পার্থেনিয়ামের প্রকোপ সামান্য ধারণা করা হলেও বর্তমানে এর কু-প্রভাব আবিষ্কার করা হয়েছে ব্যাপক হারে।


পার্থেনিয়াম উদ্ভিদেরমারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে। ক্ষেতের ফসল বা উদ্ভিদের নিকটে পার্থেনিয়াম থাকলে সেই ফসলের ফলন মারাত্মক হারে কমে যায়। এছাড়া কীট-পতঙ্গের পরাগায়নের দ্বারা পার্থেনিয়ামের পরাগ রেণু অন্য উদ্ভিদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে কীটপতঙ্গ ও ফসল উভয়ের ক্ষতি করে। পার্থেনিয়াম উদ্ভিদের শোষণ কৃত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণে বাধা প্রদান করে এবং সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বাধা প্রদান করে।


পার্থেনিয়াম আগাছা ফসলি জমিতে থাকলে ফসলের উৎপাদন প্রায় চল্লিশ শতাংশ কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে ভুট্টার ক্ষেত্রে এ আগাছা ফল ধরার পর প্রাথমিক অবস্থায় মোচার ফল ধারণ ক্ষমতা ত্রিশ শতাংশ হ্রাস করে। এছাড়া ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন, এবং মরিচের ক্ষেত্রে এ আগাছা বীজের অঙ্কুরোদগম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়ে ফসলের ফলন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। পার্থেনিয়াম গাছের সমস্ত অংশটাই ক্ষতিকারক। গোঁড়া থেকে আগা এর পরাগ, ডালপালা সবই মারাত্মক ক্ষতিকর।


উদ্ভিদ জগতের পাশাপাশি পার্থেনিয়াম প্রাণীজগতেও মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। পার্থেনিয়াম আগাছাযুক্ত মাঠে গবাদিপশু চরানো হলে পশুর শরীর ফুলে যায়, তীব্র জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় এবং পশুর বদ হজম দেখা দেয়।


পার্থেনিয়াম গাছ ভক্ষণ করলে গবাদি পশু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর এই ভাইরাস আক্রান্ত পশু জবাই করে এর মাংস ভক্ষণ করলে মানুষের শরীরও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। যার ফলে মানব শরীরে দেখা দেয় এজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে ক্যানসার সহ বিভিন্ন রোগ। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তির যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়।


পার্থেনিয়াম আগাছা হাত দ্বারা স্পর্শ করলে বা চটকালে ছোট থেকে পরবর্তীতে বড় ধরনের রোগ দেখা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় হাত-পা চুলকায়, লাল হয়ে যায় এবং বৃহৎ আকারে ত্বকে ক্যানসারের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত ব্যক্তি ঘন ঘন জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং অসহ্য মাথা ব্যথা ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগে।


যত দিন যাচ্ছে পার্থেনিয়ামের ভয়াবহ ক্ষতিকারক দিক আবিষ্কার হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে এই আগাছার পাশ দিয়ে হাটাও ক্ষতিকর। সবচেয়ে আতঙ্কের খবর হলো, ভারতের পুনেতে পার্থেনিয়ামজনিত বিষক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।


বিশেষজ্ঞ পরিবেশবিদগণ বলেন, সবার উচিত পার্থেনিয়াম সম্পর্কে পরিচিত হওয়া। যেখানেই পার্থেনিয়াম দেখতে পাওয়া যায় সেখান থেকেই এই আগাছা পরিষ্কার করা উচিত। পার্থেনিয়াম আগাছা তোলার সময় গাছটির সরাসরি স্পর্শ এড়ানোর জন্য অবশ্যই হাতে প্লাস্টিক অথবা পলিথিন গ্লাভস পরতে হবে। পার্থেনিয়াম আগাছা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে সেজন্য এর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং এটি নিয়ন্ত্রণে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।


বর্তমানে বিজ্ঞানীরা পার্থেনিয়ামের কিছু উপকারিতাও আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। পার্থেনিয়াম আগাছাটি একটি ঔষধি উদ্ভিদও। বর্তমানে এই আগাছা থেকে মানুষের আমাশয়, প্রচণ্ড জ্বর, বদহজম, টিউমার, ক্যানসার সহ নানা ধরনের জটিল রোগের প্রতিষেধক তৈরি করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা পার্থেনিয়াম নিয়ে তাদের গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এ বিষয়ে আরও নতুন কিছু জানা যাবে।


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com