
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি, তখন তারা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। বুদ্ধিজীবী ও নিরীহ মানুষের রক্তে হাত রাঙানোর সেই নীলনকশা থেকে বাদ পড়েনি যশোরও। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে এ জেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন অসংখ্য মানুষ। তাঁদের মধ্যে অন্তত ২৮ জনকে দুটি স্থানে গণকবর দেওয়া হলেও আজও সেগুলো সরকারিভাবে চিহ্নিত হয়নি। বরং একটি স্থানে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানার স্থাপনা-যেন ইতিহাসের বুকেই বসেছে দখলের কালো ছায়া। গণকবর দুটির একটি যশোর সদর উপজেলার নীলগঞ্জ মহাশ্মশান এলাকায় ভৈরব নদের তীরে। অপরটি যশোর পৌরসভার উপশহর এলাকার খালপাড়ে।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশের প্রথম জেলা হিসেবে শত্রুমুক্ত হয় যশোর। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জেলায় ৩৬টি নির্যাতন কেন্দ্র, ৩৩টি গণকবর ও ৩৯টি বধ্যভূমি শনাক্ত হয়েছে। গণহত্যার শিকার হন অন্তত ৫৮৯ জন। শংকর কুমার মল্লিকের গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ: যশোর জেলা, আসাদুজ্জামান আসাদের মুক্তিযুদ্ধে যশোর এবং রুকুনউদ্দৌলার মুক্তিযুদ্ধে যশোর গ্রন্থে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল নীলগঞ্জ এলাকা থেকে নয়জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। নীলগঞ্জ মহাশ্মশান সংলগ্ন ভৈরব নদের তীরে নির্মমভাবে তাঁদের হত্যা করা হয়। পরে নদীর পাড়ে গর্ত খুঁড়ে লাশগুলো মাটি চাপা দেওয়া হয়। সেদিন কবর খোঁড়ার জন্য পাকিস্তানিরা জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল নীলগঞ্জ সাহাপাড়া এলাকার কয়েকজনকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুই ভাই আলিম উদ্দীন ও আমিন উদ্দীন। আলিম উদ্দীন স্মৃতিচারণ করে বলেন, দুই পাকিস্তানি সেনা আমাদের বাড়িতে এসে কোদাল নিতে বলে। আমি আর আমার ছোট ভাই আমিন তাদের সঙ্গে যাই। গিয়ে দেখি, ভৈরব নদের তীরে নয়জনের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে আছে। তাঁদের মধ্যে শুধু নীলগঞ্জ এলাকার মোয়াজ্জেম হোসেন বিশ্বাসকে চিনতে পেরেছিলাম।কিন্তু আজ সেই ভৈরব নদের তীরে গণকবরের কোনো চিহ্ন নেই। জায়গাটি বেদখল হয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানার স্থাপনা।
শহীদ মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে মাহবুবুর রহমান বলেন,আব্বাকে গণকবর দেওয়ার কথা শুনে আমরা পরে সেখানে যাই। গণকবরের পাশে আব্বার পকেট নোটবুক আর পাঞ্জাবি পেয়েছিলাম। এখন সেখানে কিছুই নেই, সব মুছে গেছে।
একই অবস্থা যশোর পৌরসভার উপশহর এলাকার খালপাড়ের গণকবরেরও। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল এখানে ১৯ জনকে ধরে এনে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। লাশগুলো পড়ে থেকে পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করলে স্থানীয় কয়েকজন সাহস করে এগিয়ে আসেন। তাঁরা খালপাড়ের একটি স্থানে গর্ত খুঁড়ে সবাইকে একসঙ্গে দাফন করেন।আজ সেখানে কোনো স্মৃতিফলক নেই, নেই কোনো চিহ্ন। ফাঁকা পড়ে থাকা খালপাড়ের জমিতে দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় নেই—এখানেই শুয়ে আছেন মুক্তিযুদ্ধের ১৯ জন শহীদ।
যশোরের এই দুটি গণকবর শুধু মাটির নিচে চাপা পড়া লাশ নয়, এগুলো জাতির ইতিহাস, আত্মত্যাগ ও রক্তের সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও এসব গণকবর চিহ্নিত না হওয়া এবং দখলে চলে যাওয়া জাতির জন্য গভীর লজ্জার। ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত সরকারি উদ্যোগে গণকবর চিহ্নিতকরণ, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন। কারণ স্মৃতি হারালে ইতিহাস হারায়, আর ইতিহাস হারালে জাতির আত্মপরিচয়ও ঝাপসা হয়ে যায়।
বিবার্তা/আবেদ/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]