সাক্ষাতকার
‘সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ব্যবধান খুবই সামান্য’
সাক্ষাৎকারে শরীফ নুরুল আম্বিয়া
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৩, ১৮:৫০
‘সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ব্যবধান খুবই সামান্য’
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এর। পথ পরিক্রমায় দলটি একাধিকবার ভাঙনের মুখে পড়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে দলটি আবার ভাঙনের মুখে পড়ে। দলের একাংশের নেতারা বাংলাদেশ জাসদ নামে দল গঠন করেন।


২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছিলেন দলটির নেতারা। 'রাজনৈতিক দল' হিসেবে সেই সময়ে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি দলটি।


তবে নানা প্রতিকূলতা মাড়িয়ে গত ১৯ জুন উচ্চ আদালতের নির্দেশে মোটরগাড়ি প্রতীকে নিবন্ধন পেয়েছে বাংলাদেশ জাসদ। আর এর মধ্য দিয়ে আগামী সংসদ নিবাচনে নিজস্ব প্রতীকে অংশ নিতে পারবেন দলটি। এদিকে আর ছয় মাস পর অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দল গোছানোসহ নির্বাচনে ঘিরে দলটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে সম্প্রতি বিবার্তার সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশ জাসদ সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিবার্তা প্রতিবেদক সোহেল আহমদ। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো-


বিবার্তা: বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নসহ ২৩ দফা নিয়ে ১৪ দল গড়ে উঠেছিল। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ জাসদ সেই জোট ছেড়ে এসেছে, এর কারণ কী?


শরীফ নুরুল আম্বিয়া: এটার প্রধান কারণ হলো- যে ঘোষণা দিয়ে ১৪ দলীয় জোট গঠন হয়েছিল সে ঘোষণা বাস্তবায়নের পক্ষে এই জোটের প্রধান দল, যারা প্রকৃতপক্ষে ইঞ্জিন বা চালিকাশক্তি বলা যায় সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের কোনো মনোযোগ বা ইচ্ছা ছিল না। বিশেষত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে... যে নির্বাচনকে বিতর্কিত বললেও খাটো হয়। এই নির্বাচনটা বাস্তবে একেবারে নির্বাচনই হয়নি। রাতের আঁধারে নির্বাচন হয়েছে। আমরা কখনো এরকম দেখিনি। কোনো নির্বাচনই ত্রুটিহীন এটা বলা যায় না। কিন্তু এরকমের একটা ভুয়া নির্বাচন উপহার দিলো, ইলেকশন কমিশন ও সরকার মিলে... এটা কখনো কাম্য ছিল না।


জনগণের যে অধিকার, এই দেশের ওপর জনগণের যে কর্তৃত্ব সেটা টোটালি খারিজ হয়ে গেছে। তারপরে এটা জোটে বলেছি। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি ১৪ দলের যে ঘোষণা; সেই ঘোষণা অনুযায়ী এই জোট পুরোপুরি অকার্যকর। সে বিবেচনায় আমরা কথাবার্তা বলে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছি এবং অন্যদের বলেছি তোমরাও চলে আসো। অনেকে বলেছেন, আপনি যা বলেছেন তা ঠিক। কেউ কেউ বলেছেন, এটাও ঠিক। তবে এর মধ্য থেকে সংগ্রাম করতে হবে। আমরা মনে করিনি ভেতরে থেকে সংগ্রাম করতে হবে, এর চেয়ে বাইরে থেকে সংগ্রাম করা ফলপ্রসু হবে।



বিবার্তা: জোটে যাওয়া বা জোটে গঠন করার বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?


শরীফ নুরুল আম্বিয়া: ইলেকশন করার জন্য আমরা আগে এনটাইলেড ছিলাম না। আমরা সবসময় নির্বাচন করতে চেয়েছি। আগেও আমরা ইলেকশন করেছি। সে সমস্ত বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে দল কি কৌশলে আগাবে দলের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হবে। মিটিং এখনো হয়নি। ঈদের পর আমরা বসব। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে। তবে একটা কথা বলতে পারি, দেশে সুষ্ঠু এবং বিতর্কের উর্ধ্বে মানুষ যাতে ভোটটা দিতে পারে, এটা আমরা চাই।


দেশে গণতন্ত্র নিয়ে একটা সংকট চলছে। সংকট উত্তরণের জন্য আলাপ-আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ অনুসরণ করতে হবে। গায়ের জোরে কথাবার্তা বলে, যে আমি পাওয়ারে আছি এটা বললাম আর ইলেকশন হয়ে যাবে; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সেরকম নাই। যে ইচ্ছে করলে (নির্বাচন) করে ফেলতে পারব এবং গ্রহণযোগ্য হবে, সেই ধরণের পরিস্থিতি নেই।


যে সংকট আছে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সে সংকট মিমাংসা করে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দেখছি একজন আরেকজনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। বাস্তবে দেশের মানুষের স্বার্থকে কেউ এড্রেস করছে না। আমরা মনে করি, দেশের সকল কনসার্ন পার্টি দেশের স্বার্থকে এড্রেস করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তারা কার্যকরী আলাপ-আলোচনায় মনোযোগ দেবে।


বিবার্তা: সম্প্রতি উচ্চ আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাসদকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নতুনরা এই দলে কেন আসবেন বলে মনে করেন?


শরীফ নুরুল আম্বিয়া: নতুনরা রাজনৈতিক কারণেই আসবে। যারা দেশে গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার ও সমতাভিত্তিক ব্যবস্থা চায়। তারা এই দল করবে। দেশে এখন সমাজবৈষম্য সীমাহীন পর্যায়ে চলে গেছে। গণতন্ত্রের অস্তিত্বই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ন্যায় বিচার সমাজে কাঙ্খিত জিনিস। আমাদের দেশে অনেক দল আছে কিন্তু ভালো দল, আদর্শিক দল নেই। আদর্শ বাস্তবায়ন করার জন্য চারিত্রিক দৃঢ়তা আছে এবং সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে তেমন একটা রাজনৈতিক দলের ঘাটতি আছে। সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য জাসদ অবিরাম কাজ করে যাবে।


বিবার্তা: ১৯৭২ সালে জাসদ গঠনের পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির অনেকে জাসদে আশ্রয় নিয়েছিল এমন অভিযোগ করা হয়। নিবন্ধন পাওয়ার মধ্য দিয়ে আপনাদের নতুন করে পথচলা শুরু হয়েছে। দলে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির অনুপ্রবেশ রোধ নিয়ে কি ভাবছেন?


শরীফ নুরুল আম্বিয়া: ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের দলের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর। জাসদ কখনো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে জায়গা দেয়নি। আমাদের দলের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আছে বলে আমরা মনে করি না। বরং আজকের ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা ছিলো তাদের বেশি অনুপ্রবেশ হয়েছে, তাদের নিজের দলের লোকেরা বলেছেন। এটাতে ক্ষমতাসীন দলের মনোযোগ দেয়ার বিষয়। আমরা মনে করি না এ বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেয়ার বিষয় আছে। কারণ আমরা ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় রাজনীতি করছি।


বিবার্তা: সময়ের সাথে সাথে জাসদ এখন তিনভাগে বিভক্ত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বহুধা বিভক্ত জাসদের এখন কেবল কঙ্কালটাই অবশিষ্ট আছে। আপনি কি মনে করেন?


শরীফ নুরুল আম্বিয়া: যে দল ভাঙে তার অভ্যন্তরীণ নানা কারণ থাকে। নিশ্চয়ই জাসদের মধ্যেও বিভিন্ন বিষয়, কারণ ছিল। যার কারণে দলে ভাঙন হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতা... গোয়েন্দা বিভাগ এত বেশি অ্যাকটিভ বিভিন্ন সরকারের সময়। বিশেষত সামরিক শাসনের পরে যে অ্যাকটিভি হয়েছে। তারপরে তো সামরিক-বেসামরিক সরকার এসেছে। এখন তো রাজনৈতিক সরকার। ইলেকশনটা বিতর্কিত হলেও সবাই কনস্টিটিউশনাল সরকার বলে।


রাজনৈতিক সংস্কারে অনেকগুলো দিক, বিষয় আছে। সে সমস্ত সংস্কার যদি নেয়া হয়, রাজনীতিতে চর্চা হয়- তাহলে আজকে বেশি আছে কালকে কমে যাবে। আজকের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও ৬ ভাগে ভাগ ছিল। আমাদের দলেও অনেকগুলো ভাগ। অনেক শাখা-উপশাখা হয়ে গেছে। অন্য কে শাখা হয়ে গেলো এসব নিয়ে চিন্তা করি না। আমাদের নীতি-আদর্শ আছে, আমরা সেই নীতিতে কাজ করি। জাসদ এই নীতি-আদর্শে জনগণকে সম্পৃক্ত করে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারা জন্ম দিতে সক্ষম হবে।


বিবার্তা: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দলটিকে নিষিদ্ধের দাবিও উঠেছিল। অথচ গত ১০ জুন সেই দলটি প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে রাজধানীতে সমাবেশ করেছে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?


শরীফ নুরুল আম্বিয়া: ২০০৫ সালে ১৪ দল গঠন করার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিস্তবায়ন, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস পরাস্ত করা রাজনীতির অন্যতম উপাদান ছিল। একজন ব্যক্তি যুদ্ধপরাধ করলে ব্যক্তির বিচার হবে। যেই দল দলগতভাবে যুদ্ধপরাধ করেছে সেই দল নিষিদ্ধ হওয়া বাঞ্চণীয় এবং আমরা সেটা মনে করি। কিন্তু সরকার সেটাকে ঝুলিয়ে রেখেছে দলগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে গৌণ করেছে। রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে তখনই এটাকে অবৈধ ঘোষণা করা উচিত ছিল এবং সেটা করা সম্ভব ছিল।


এই সরকারের আমলে আমরা দেখছি আকস্মিকভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীকে। এই বিষয়ে নিয়ে একেক মন্ত্রী একেক রকমের বক্তব্য দিয়েছে। আমি শুধু এটুকু বলব, আপনাদের (আওয়ামী লীগের) পলিটিক্যাল পজিশন কি সেটা বিবৃতি দিয়ে ফরম দ্যা হাইয়েস্ট অথরিটি এটা স্পষ্ট করা উচিত, আপনাদের অবস্থান কী? মুক্তিযুদ্ধকে ভাঙিয়ে তারা অর্থবিত্ত এবং রাজনীতির ফায়দা তোলার চেষ্টা করে। সেই জায়গা থেকে সরে আসা উচিত, এটা বন্ধ করা উচিত। এটা বন্ধ করার জন্য অনেক সংগ্রাম, লড়াই হয়েছে। আজকের যে অবস্থা সেটাকে আবার লড়াইয়ের একপর্যায়ে ফেরত আনার জন্য ওনার যদি এটা করেন- তাহলে অন্যান্য প্রতিপক্ষ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়, সেই অভিযোগ মূ্ল্যহীন হয়ে যায়।


আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলো- বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে দুই দলের ব্যবধান খুবই সামান্য। এবং ওই ঘটনার (জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি) মধ্য দিয়ে এই দূরত্ব আরো কমেছে।


বিবার্তা: আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েছে। বাংলাদেশের এই পথচলা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?


শরীফ নুরুল আম্বিয়া: দেশকে তৈরি করার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। ৫০ বছরে ভুল-ত্রুটির পরও আমাদের অগ্রগতি হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে। আবার অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নিলে দেখা যায় হয়তো এসব জায়গায় আমরা একটু বিশৃঙ্খল হয়েছি। রাজনীতির অঙ্গণে স্থিতিশীল একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারিনি। এটা আমাদের এক নম্বর সমস্যা। দুই নম্বর হলো স্বাধীনতার পর জনগণের ক্ষমতায়ন হওয়ার সুযোগ ছিল এবং সেইখানে আমরা কাঙ্খিত সফলতা অর্জন করতে পারিনি। সেই সমস্ত জায়গায় সংগ্রাম করার বিষয় আছে। সংগ্রাম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবে দেশ এটা স্বাভাবিক।


বর্তমান মুহূর্তে বিশ্ব রাজনীতি পরিবর্তনশীল। আমরা একটা নতুন বিশ্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কোন পথে অগ্রসর হলে আমাদের ডেভেলপমেন্ট, সমাজের কল্যাণ হবে এবং আমরা একটা অগ্রসর সমাজে পরিণত হবো সেই পন্থাটা রাজনৈতিকভাবেই নিরূপণ করতে হবে।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com