সাক্ষাতকার
'যারা শহিদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করে, তাদের শুধু ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহ গণহত্যা উপলব্ধি করলেও হবে'
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪, ২১:২৪
'যারা শহিদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করে, তাদের শুধু ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহ গণহত্যা উপলব্ধি করলেও হবে'
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

মার্চ মাস, স্বাধীনতার মাস। দিন কয়েক পরেই আমরা উদ্‌যাপন করবো মহান স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন এবং ২৫ মার্চ বাঙালির উপর পাকিস্তানি সেনাদের অন্যায়ভাবে চালানো অমানবিক গণহত্যার প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিন, ছাত্রজীবনের আন্দোলন সংগ্রামসহ নানা বিষয়ে বিবার্তা প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, বিএম এর সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সারওয়ার আলী। সেই আলাপচারিতার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো;


বিবার্তা : আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠার গল্পটা শুনতে চাই।


ডা. সারওয়ার আলী : আমার জন্ম ময়মনসিংহে। আমার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ক্যাপ্টেন আইয়ুব আলী হিসেবেই বেশি পরিচিত। চিকিৎসক ছিলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।


আমার স্কুলজীবনের মূল সময়টা ছিল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। আমাদের সময় এসএসসি পরীক্ষা ছিল না, ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষা। আমি খুব অল্প বয়সেই ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রার্থী হয়ে যাই। তখন আমার বয়স বাড়িয়ে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪২-এ নিয়ে যাওয়া হয়। কিছু ছেলেপেলে থাকে দেখবেন পরীক্ষায় প্রথম হতে না পারলে কেঁদে বুক ভাসায়, আমি ওই ধরনের ছিলাম, পড়াশোনা করাটাই ছিল জীবনের মূল লক্ষ্য। মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করি। ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাশ করি। এরপর ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হই।


বিবার্তা : ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন কখন?


ডা. সারওয়ার আলী : ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। তখনই জীবনে একটা বড় পরিবর্তন ঘটল। ষাটের দশকের যে ছাত্র আন্দোলন আমি তার গোড়া থেকে যুক্ত। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, তাতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয় আমার।


১৯৬২ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হন, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, আমার সৌভাগ্য হয় সেই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার। আমার জীবনের সোনালী সময় হচ্ছে ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন।


এই ছাত্র আন্দোলনই ধাপে ধাপে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ হয়। ছাত্র আন্দোলনে আমাদের অস্ত্র ছিল ইট, ইটের টুকরা। আর পুলিশের রাইফেল। ট্যাংক নিয়ে নেমেছিল ২৫ মার্চ রাতে এবং ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ।


বিবার্তা : ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালির উপর যে পাশবিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী- সেই রাতের কথা স্মরণ করে বলুন।


ডা. সারওয়ার আলী : আমাদের বাসা ছিল নয়া পল্টনে। দুই তিন বাড়ি পরে একটা বস্তি, তার সামনে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইকবাল হলে সিন্ধু প্রদেশের ন্যাপের নেতা হায়াত বক্স এসে বলেন- সেই রাতে আমরা যেন ঘরে না থাকি, তারা বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করতে এসেছিলেন। মূলত তারা সংসদ অধিবেশনে যোগদান করতে এসেছিলেন। যাই হোক, আমাদের বলা হলো, যেন আমরা ঘরে না থাকি। আগেই একরকম ধারণা করা গিয়েছিল ২৫ মার্চ কিছু হতে পারে। দেখবেন ২৫ মার্চ রাতে ছাত্র নেতারা সেরকমভাবে নিহত হননি, সাধারণ ছাত্ররা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সেই রাতে বাসায় ফিরছিলাম। দুই ব্লক পড়েই একটা বস্তি, তখন ছিল ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন, পুরান ঢাকায়। সেটা তেজগাঁও পর্যন্ত গিয়েছে। এখন যেটা রাস্তা হয়ে গেছে, সেখানে ছিল বস্তি। ২৫ মার্চ রাতে বস্তিটি ট্যাংকের গোলায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়।


ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল সেই বস্তিতে। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ২৫ মার্চ রাতে এই যে এত সাধারণ মানুষ, বস্তির মানুষকে মারা হয়েছিল, তাদের অপরাধ কী জানেন? ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকা ছিল। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মূল শক্তিটাই কিন্তু ছিল সাধারণ মানুষ এবং ছাত্রসমাজ। এরা মিলিতভাবেই ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছিল। এই অপরাধেই হাজার হাজার মানুষ ২৫ মার্চ রাতে মারা হয়েছিল। আমি শুধু ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহতার কথা বললাম। কিন্তু এটা তো সকলেই জানে যে, ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে পাকিস্তানিরা অপরাধ দমনের নামে সারা দেশে গণহত্যা চালিয়েছে। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম বা শহর নেই যেখানে তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়নি, গণকবর নেই এমন কোনো গ্রাম বা শহর নেই। এটা আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।


বিবার্তা : ২৫ মার্চের কথা শুনলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা বলুন।


ডা. সারওয়ার আলী : ২৫ মার্চের পর কারফিউর মধ্যেই আমি ফিরে এলাম ঢাকা মেডিকেলে। তখন যেহেতু আমি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে রয়েছি এবং ছাত্রনেতা ছিলাম। ফলে সবাই আমাকে সেখানে থাকার জন্য নিষেধ করল।


এরপর আমি চলে গেলাম হলি ফ্যামিলিতে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর বুঝতে পারলাম যুদ্ধ করতে হলে গ্রামাঞ্চলে যেতে হবে। এরপর আমরা রায়পুরে চলে গেলাম, আমি, রণেশ দাশগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, মতিউর রহমান। কিন্তু সমস্যা হলো মতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে। আমরা প্রথমে কাপাসিয়া গেলাম। মতিয়া চৌধুরী বোরকা পরলেও সে তো অগ্নিকন্যা- তাকে দেখে, তার চালচলনে গ্রামবাসী বুঝে ফেলল আমরা কে। ফলে রায়পুরে যেতে হল। সেখানে আমরা সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য অস্ত্র চালানো শিখলাম। এরপর আমরা ভৈরব দিয়ে আখাউড়া হয়ে আগরতলা গেলাম। সেখানকার ক্রাফট হোস্টেলে উঠলাম, এরপর তো যুদ্ধ।


বিবার্তা : বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক চেতনা বেড়েছে, নানা ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি- সে সম্পর্কে বলুন।


ডা. সারওয়ার আলী : সাম্প্রদায়িক বা উগ্রবাদী চেতনা শুধু বাংলাদেশ নয়, শুধু ভারতবর্ষ বা উপমহাদেশে নয়, সারা বিশ্বজুড়েই আছে। এটা থাকবেই। কিন্তু বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে সমানতালে অগ্রসর হয়েছে এর মধ্য দিয়ে, পাকিস্তানের যে সাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের জাতি পরিচয় মুছে দিতে চেষ্টা করেছিল বাঙালি তার ধর্ম পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখে জাতি পরিচয়ে ধন্য হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল।


বাংলাদেশের স্বাধীনতার মর্মবাণীই হচ্ছে, একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র থেকে একটি সর্বজনের সমঅধিকারের রাষ্ট্র গড়ে তোলা যেটি আমরা ১৯৭১ সালে পেয়েছি এবং স্বাধীনতার সেই মর্মবাণী বাহাত্তরের সংবিধানে এসেছে। গত কয়েক দশক ধরে এই মূল লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ পথভ্রষ্ট হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা হতে পারে না। তবে এই দায় শুধু রাষ্ট্র বা সমাজের নয়। সকলকেই চেষ্টা করতে হবে বাহাত্তরের সংবিধানের যে মূলনীতি তার প্রতিফলন যেন আমাদের জীবনে থাকে।


বিবার্তা/অলক/এসবি/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com