‘সীমান্ত নিরাপত্তা নয়, এখন বড় সংকট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল’
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২:১৯
‘সীমান্ত নিরাপত্তা নয়, এখন বড় সংকট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল’
সামিনা বিপাশা
প্রিন্ট অ-অ+

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রভাব সীমান্ত পেরিয়ে এসে পৌঁছেছে বাংলাদেশে। এই সংঘাত দীর্ঘ সময়ের হলেও চলতি বছরের মধ্য জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যেন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন। এই সংঘাতে স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধের মুখে বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমারের জান্তা সদস্যরা।


তবে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) সদস্যসহ ৩৩০ জন নাগরিককে বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানী নৌবাহিনী জেটিঘাট থেকে ধাপে ধাপে মিয়ানমারের জাহাজে তুলে দেয়া হয়।


জানা গেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৩০২ জন বিজিপি সদস্য, চারজন বিজিপি পরিবারের সদস্য, একজন সেনা সদস্য, ১৮ জন ইমিগ্রেশন সদস্য এবং ৪ জন বেসামরিক নাগরিকসহ মোট ৩৩০ জন মিয়ানমারের নাগরিককে সেদেশের বিজিপির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।


তবে, এদের ফেরত পাঠানো হলেও বাংলাদেশ কিন্তু শঙ্কামুক্ত নয়। বৃহস্পতিবার ( ১৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে ও শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেমে থেমে গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সর্বশেষ সীমান্ত এলাকা শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনের স্থানীয়রা।


শাহপরীরদ্বীপ সীমান্তে নাফ নদের ওপারে মিয়ানমারের মুন্ডু টাউনশিপের আশপাশে তিন ও চার কিলোমিটার এলাকায় গোলাগুলি হচ্ছে বেশি। শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল প্রায় এক ঘণ্টা প্রচুর গোলাগুলিতে সীমান্তের এপারের মানুষের ঘুম ভেঙেছে বলেও জানা গেছে। এদিকে শাহপরীর দ্বীপের ওপারে মিয়ানমারের মংডুতে সকালে হেলিকপ্টার উড়তে দেখা গেছে। এর কিছুক্ষণ পরেই কয়েকটি বিকট শব্দে কেঁপে উঠেছে সীমান্ত এলাকা।


উল্লেখ্য, মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া মর্টার শেলের আঘাতে ঘুমধুম সীমান্তে নারীসহ ২জন নিহত হয়েছিল গত সপ্তাহেই। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত এখনো চলমান।


এই অবস্থায় বাংলাদেশ কী ধরনের সংকট ও ঝুঁকিতে রয়েছে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় সরকারের করণীয় কী সে প্রসঙ্গে বিবার্তার সাথে একান্ত আলাপচারিতায় কথা বলেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার। সেটি তুলে ধরা হলো:


বিবার্তা : ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময়, শুধু অং সান সুচির শাসনের সময়কাল বাদ দিলে বাকি সময়টাতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত চলছে, এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।


মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার : দেখুন আমার বোঝাপড়া এবং জানাশোনা একটু ভিন্নরকম, ১৯৬২ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায়। অং সান সুচির ক্ষমতায় ছিল নামে মাত্র, মূলত তার কোনো ক্ষমতা ছিল না। আসলে সবকিছুই সেনাবাহিনী হুকুমেই পরিচালিত এবং যা কিছু তিনি করেছেন সবকিছুর কর্তৃত্ব সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। তা না হলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তিত্ব সারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত তিনি আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইতেন না, বলতেন না এখানে কোনো গণহত্যা হয়নি, কোনো জ্বালাও-পোড়াও হয়নি, ধর্ষণ, কোনো অপরাধ হয়নি। এরকম ডাহা মিথ্যা কথা তিনি বলতেন না, যদি তার ক্ষমতা থাকত। সুতরাং ক্ষমতা ওনার ছিল না।


১৯৫২ সাল থেকে এই পর্যন্ত সেনাবাহিনী কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় আছে। শুধু সুচির শাসনামলে আর তার আগে পাঁচ বছর- এই দশ বছর ইনডাইরেক্টলি অন্য সরকার দ্বারা শাসিত ছিল মিয়ানমার অর্থাৎ সিভিলিয়ান গভর্মেন্ট ছিল। বাদবাকি সময়ে কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীই মিয়ানমারের ক্ষমতায়।


২০০৮ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী যখন চিন্তা করল একটা সিভিলিয়ান সরকার দরকার তখন তারা পার্লামেন্টে এমন এক সংবিধান প্রণয়ন করে যাতে সব ক্ষমতা তাদের হাতে থাকে। পার্লামেন্টে এমনভাবে আইন পাশ করা হয় যাতে সব ক্ষমতা তাদের হাতে থাকে। আইন পাশ করার ক্ষমতা তাদের কাছে, তাদের চার ভাগের এক ভাগ সদস্য সেনাবাহিনী মনোনীত থাকে। তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, সীমান্ত রক্ষী বাহিনীসহ সব সেনাবাহিনীর হতে হবে।


বিবার্তা : মিয়ানমারে বর্তমানে চলমান সংঘাত সম্পর্কে বলুন।


মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার : এই যে যুদ্ধ ১৯৪৮ বা ৫০ সালের পর থেকে শুরু হয়েছে, কখনো তীব্রতা বেড়েছে কখনো কমেছে, কখনো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, কখনো দৃষ্টি আকর্ষিত হয়নি কিন্তু একটা দিনের জন্য ওখানে যুদ্ধ থেমে ছিল না। ছোটোখাটো যুদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু মিডিয়াতে আসেনি।


মিয়ানমারে শুধু রাখাইন অঞ্চলে নয়, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থাইল্যান্ড বর্ডারে কারেন, লাওস বর্ডারে কাচিন, এছাড়াও কারেন্নি ও শিন এইসব জাতিগোষ্ঠী, এরকম ছোটো ছোটো আরো জাতিগোষ্ঠী আছে যারা বিদ্রোহী গ্রুপ হয়ে উঠেছে, তারা অস্ত্রবাদী। মিয়ানমারের এরকম যত বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠী আছে, এরা মাঝে মাঝেই সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়, ওখানে অস্ত্র দিয়ে নিজেদের মধ্যে শাসন চালায়, চাঁদাবাজি করে নিজেদের খরচ চালায়। আবার কিছু বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতা পায়। এভাবে কোনো বিরতি ছাড়াই এই সংঘাত চলে আসছে।


আমাদের দেশের পাশে ওদের যে প্রদেশটি সেটা হচ্ছে রাখাইন। রাখাইনের মধ্যে একটা বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে তারা হচ্ছে রাখাইন আর্মি, তবে রাখাইনেই শুধু এটাই বিদ্রোহী গোষ্ঠী না, আরো অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে আরাকান আর্মি,আরাকান মুসলিম রোহিঙ্গা লিবারেশন ফ্রন্ট এরকম বহু বিদ্রোহী গোষ্ঠী আছে কোনোটা ছোটো কোনোটা বড়।


গত কিছুদিন ধরে আমরা যে সংঘাত দেখছি তাতে আরাকান আর্মির যে সামরিক সক্ষমতা সেটা দিয়ে তারা মিলিটারি জান্তা বাহিনীর বিভিন্ন ফাঁড়ি আছে সীমান্ত ফাঁড়িসহ বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে তারা কিছু সফলতা লাভ করেছে। এখন, এই যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ লেগে গেছে এবং সামরিক বাহিনী তা প্রতিহত করার চেষ্টা করছে।


বিবার্তা : মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় যে সংকট তৈরি হয়েছে, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা পালিয়ে এসেছে, আমাদের সীমান্তে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সেই বিষয়ে আমাদের করণীয় কী?


মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার : যুদ্ধটা হচ্ছে আমাদের সীমান্তের পাঁচশ বা ছয়শ বা এক হাজার গজের মধ্যে তার কারণে উভয়পক্ষ যে গোলাগুলি করছে তা সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের দেশে চলে আসছে এবং আমাদের দেশেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।


এখানে ফান্ডামেন্টাল একটা বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী অথবা আরাকান আর্মি কেউই কিন্তু বাংলাদেশের দিকে তাক করে কোনো গুলি ছোঁড়েনি বা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কোনো আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করেনি।


কিন্তু এরকম একটা যুদ্ধ যখন সীমান্তের পাঁচশ, ছয়শ বা এক হাজার গজের মধ্যে চলে তখন যে সমস্ত অস্ত্র তারা ব্যবহার করে সেগুলোর গুলিটা যখন তারা ছেড়ে দেয় সেগুলোর একটা ট্রাভেলিং ডিস্টেন্স থাকে, ধরুন একটা মর্টার শেল সেটা তিন কিলোমিটার পর্যন্ত যাবেই, মেশিনগান থেকে ছোঁড়া হলে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত যাবে।


এই ট্রাভেলের সময় কেউ যদি এই দুই বা তিন কিলোমিটারের মধ্যে পড়ে, তাহলে সেই হতাহত হবে। সুতরাং, গুলি ছেড়ে দিলে যাবেই, গুলি তো আর সীমান্ত চেনে না। যেহেতু যুদ্ধটা সীমান্ত ঘেঁষে হচ্ছে, তাই আমাদের সীমান্তেও তার প্রভাব পড়ছে কিন্তু তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে কিন্তু কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি।


আমাদের উপর যদি এই সংঘাতের প্রভাব না পড়ত এটা নিয়ে আমাদের চিন্তার কোনো কারণ ছিল না, কিন্তু যেহেতু আমাদের সীমান্তে এর প্রভাব পড়ছে তাই আমাদের মাথাব্যথা।


বিবার্তা : মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় কী করা উচিত এই মুহূর্তে?


মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার : মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ সেখানে আমাদের করণীয় কিছু নেই। এটা মিটমাটের কোনো সুযোগ আমাদের নেই।


যেটা আমরা করতে পারি, সেটা হলো দুই ধরনের। আমাদের সীমানার মধ্যে যারা বসবাস করেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।


সীমান্তবর্তী এলাকায় যারা আছেন তারা আতঙ্কে আছেন যেহেতু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। একইসাথে তাদের থাকা-খাওয়াসহ সবকিছুর সুব্যবস্থা করতে হবে।


যেহেতু যুদ্ধটা সীমান্ত ঘেঁষে হচ্ছে, আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় হচ্ছে সেক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের যা করণীয় সেটা আমাদের করতে হবে। সেটা যুদ্ধের কনভেনশন অনুযায়ী করতে হবে।


যুদ্ধের কনভেনশন অনুযায়ী, যখন এইরকম যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধের রেঞ্জের মধ্যে যারা পড়ে তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। আমাদের সেটাই করা হচ্ছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটাই করতে হবে।


যুদ্ধের তীব্রতা কয়েকদিন বেড়েছিল। আবার হয়ত কমবে, আবার বাড়বে। গত কয়েকদিন ধরে যুদ্ধের তীব্রতা কমে গেছে। আবার বাড়তে পারে। কিন্তু একবারেই যে বন্ধ হয়ে যাবে এমন নয়, বাড়বে, কমবে, আবার হয়ত আরো বেশি বাড়বে। যেহেতু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই।


আরেকটা ব্যবস্থা হলো, মিয়ানমার সরকারের প্রতি আমাদের কঠোরভাবে একইসাথে কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করে আলাপ-আলোচনা করে এই সংকট নিরসনে কাজ করতে হবে।


তাদের বলতে হবে যে, যেহেতু তোমাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছে কিন্তু আমরা যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করো যাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত না হই।


কিন্তু এটা তো মিয়ানমার সরকারের হাতে নেই। এখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীরাও আছে। সুতরাং এখানে মিয়ানমার সরকারের কিছু করারও নেই। বাস্তবতা হলো, আমাদের লোকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কিছু আমাদের করার নেই। সুতরাং এই ব্যবস্থাটাই করতে হবে। আমাদের সীমান্তে তো কোনো সমস্যা নেই, কোনো নিরাপত্তা সমস্যা নেই। তবে, আরেকটা বিষয় মিয়ানমারের যারা বিদ্রোহী গোষ্ঠী তারা সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে যেন পালিয়ে এসে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।


খেয়াল রাখতে হবে, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, বিদ্রোহী গোষ্ঠী, অস্ত্রধারী গোষ্ঠী এরা যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল, তারা তো এসে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে, নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছে, তাদের হ্যান্ডওভার করা হয়েছে, তারা তো আমাদের সাথে কোনো যুদ্ধ করতে করতে আসেনি। তাদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, আবার সেইভাবেই ফেরত দেওয়ায় হয়েছে, এটা তো আপাতত করা হলো। আর এই যুদ্ধ সহজে থামবে না। তিন মাস দুই মাস পর আবার যুদ্ধ বাড়বে।


বিবার্তা : মিয়ানমারের এই সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে কোনো হুমকির মুখে পড়বে কী?


মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার : সমস্যা হবে, আমাদের দেশে রোহিঙ্গা যারা আছে কক্সবাজারে বারো লক্ষ তাদের মধ্যে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে, এরাই ওদের ভিতরে গিয়ে যোগ দিতে পারে, পক্ষ-বিপক্ষ নিবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টা এমনিতেই অনিশ্চয়তার মুখে তার মধ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এই যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে তাদের ফেরত যাওয়ার সুযোগ একেবারে শেষ হয়ে গেল। কারণ, এই সহিংসতার মধ্যে তো রোহিঙ্গাদের ফেরত দিতে পারবে না। সেই পরিবেশ নাই। ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি রাজি হবে না, রোহিঙ্গারাও রাজি হবে না। মিয়ানমার সরকার তাদের নেওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না।


সুতরাং সীমান্তের নিরাপত্তা নয়, বড়ো সংকট হয়ে দাঁড়াল রোহিঙ্গাদের ফেরত দেওয়া এখন প্রায় অনিশ্চয়তার মুখে। এই বারো লাখ রোহিঙ্গা আর কখনো ফেরত যাবে এটা আশা করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের জন্য ভয়ানক নিরাপত্তার হুমকি সৃষ্টি হবে।


এই রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে তাদের সাথে সাধারণ রোহিঙ্গারাও যোগ দিবে। যেহেতু তারা কোনোদিন ফেরত যেতে পারবে না সেহেতু তারা অধিকার চাইবে। নাগরিক অধিকার চাই, আমরা এখানে আছি। ইতোমধ্যে তারা এরকম বলা শুরু করেছে, শোনা যাচ্ছে।


একসময় তারা বলা শুরু করবে, একসময় তো, দুইশ বছর ১৭৪০ সালের আগে, ১৬৬৬ তার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ষোড়শ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, আরাকান এক রাজ্য ছিল, বার্মা আলাদা ছিল। এই পাশ ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের আন্ডারে।


কিন্তু ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের সময়, আমাদের শায়েস্তা খাঁর আমলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার আলাদা হয়ে আমাদের অংশ হয়ে যায়, আর আরাকান আলাদা হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিন্তু এই চিন্তা অলরেডি শুরু হয়ে গেছে যে, এই দেশ তো একসময় আমাদের ছিল, এই বিষয়টা যখন তাদের মধ্যে উত্থাপিত হবে, বহু বিদেশি শক্তি বা লোক বা এজেন্সি আছে যারা এটাকে উসকে দিবে। বলবে, হ্যাঁ তোমরা তোমাদের দাবি-দাওয়া চাও।


তখন হবে, আমাদের জন্য বড় সংকট। সেই জন্য আমি বারবার বলছি, সীমান্তবর্তী এলাকার এই মুহূর্তের নিরাপত্তার চেয়ে আমরা বড় সংকটে পড়ব রোহিঙ্গাদের নিয়ে।


বিবার্তা : উত্তরণের কী উপায় এবং এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের করণীয় কী?


মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার : কক্সবাজার ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে খুব বড় ধরনের সমস্যায় পড়ব, সেটা নিয়ে ভাবাই আমাদের এই মুহূর্তের করণীয় হওয়া উচিত এবং আমি সাজেশন দিবো, কক্সবাজারে যে বারো লক্ষ রোহিঙ্গা আছে তাদের সংঘবদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না। অন্য জায়গায় বড় বড় ক্যাম্প করে তাদের বিভিন্ন স্থানে সরিয়ে নিতে হবে, যাতে তারা সংঘবদ্ধ হতে না পারে।


কক্সবাজার ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে রোহিঙ্গাদের সংঘবদ্ধ হয়ে কোনো অঘটন ঘটাতে দেওয়া যাবে না। জাতিসংঘসহ অন্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে আলাপ করে তাদের বোঝাতে হবে, আমরা আমাদের নিরাপত্তার হুমকিতে আছি, তাই রোহিংগাদের বিভিন্ন স্থানে সরিয়ে নিতে চাই।


আমি উদাহরণস্বরূপ বলবো, ধরুন এক ক্যাম্পে এক লক্ষ আরেক ক্যাম্পে এক লক্ষ এভাবে করে কক্সবাজার থেকে দূরে অন্য জেলাতে হতে পারে পঞ্চগড়, দিনাজপুর কিংবা বাগেরহাট এরকম বিভিন্ন স্থানে সরিয়ে নিয়ে রোহিঙ্গাদের আলাদাভাবে শরণার্থী শিবিরে তাদের ভালো সুব্যবস্থা দিয়ে রাখতে হবে। আর না হলে, অদূর ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ।


বিবার্তা : বিবার্তাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।


মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার : আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/এমজে/এসবি/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com