সাক্ষাতকার
'ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধারণ করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ'
-সাক্ষাৎকারে ড. দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩, ১১:০৫
'ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধারণ করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ'
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

ড. দেলোয়ার হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এর সদস্য হিসেবেও। আন্তর্জাতিক এই বিশ্লেষক ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জাপান থেকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের স্কলার হিসেবে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরে মনবুশো স্কলার হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রি নেন জাপানেরই ফেরিস ইউনিভার্সিটি থেকে।


বরেণ্য এই অধ্যাপক সম্প্রতি আন্তর্জাতিক নানা বিষয় নিয়ে বিবার্তা২৪ডটনেটের সাথে একান্ত কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবার্তা প্রতিবেদক মহিউদ্দিন রাসেল।


বিবার্তা: সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই উত্তরগুলোকে আপনি কিভাবে দেখেন?


ড. দেলোয়ার হোসেন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে যেমন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান, অন্যদিকে তিনি একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলেরও প্রধান। তিনি দুটো সত্ত্বা নিয়ে কাজ করে আসছেন। গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন-সমৃদ্ধি সাধিত হয়েছে, সেখানে তাঁর দুটো সত্ত্বাই কাজ করেছে। ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, সেটা হোক সাক্ষাৎকারে কিংবা কোনো ফোরামে- এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হয় যে, কোনো একটা দেশের নির্দিষ্ট পলিসি কিংবা কোন অবস্থান বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেটি নিয়ে প্রতিবাদ কিংবা বক্তব্য রাখা সমীচীন। তাছাড়া সরকারের যে দর্শন আছে, যে কর্মসূচি আছে তার বিরুদ্ধে গেলে নিঃসন্দেহে মানুষের সেন্টিমেন্ট তথা আবেগকে প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেন। এই কাজটি তিনি সফলভাবে করেই যাচ্ছেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের ইতিহাস, বাঙালি জাতির গৌরব, আত্মমর্যাদার বিষয়ে কারো কাছে মাথা নত না করা জাতি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে। আরেকটা বিষয়, আমরা জানি বিশ্ব রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে চলমান। ফলে সেখানে প্রতিটি রাষ্ট্রই স্বাধীন এবং সার্বভৌম। এই জায়গা থেকে প্রধানমন্ত্রী একদিকে সরকারের নীতি অবস্থানের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, একইসঙ্গে জনগণের যে আবেগ অনুভূতিরও প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। যার মাধ্যমে তিনি বলার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় আছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে স্টেক হোল্ডার আছে, তারা সেই বিষয়গুলোকে মোকাবিলা করবেন। তার মাধ্যমে ক্রমাগত পরিবর্তন হবে আর বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।



বিবার্তা : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দুনিয়া জুড়ে যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ হলো, তাকে কি যুক্তরাষ্ট্র হুমকি হিসেবে দেখছে?


ড. দেলোয়ার হোসেন : রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট কিংবা ইউরোপ অর্থাৎ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ভেতরে এক ধরণের হুমকি আবিষ্কার করেছে। যেটির ধারণা আগে থেকে ছিল আর সেই রকম বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। তবে এটিও আমরা দেখেছি যে, ১৯৯৮-২০১৪ পর্যন্ত রাশিয়া জি-৭ এর সাথে যুক্ত ছিল অর্থাৎ এটা তখন জি-৮ বলে পরিচিত ছিল। তখন রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। আমরা জানি যে, এক সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বরিস নিকোলায়েভিচ য়েলৎসিন, তিনি পশ্চিমা বিশ্বের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তখন পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে হানিমুন রিলেশন ছিল। পরবর্তীতে পুতিন যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনিও পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু যে জিনিসটা রাশিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে সেটা হলো- ন্যাটোর এক্সপানশন তথা সম্প্রসারণ পূর্বমুখীতা। আর এই সম্প্রসারণটা এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল বা পৌঁছেছে সেখানে রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্টগুলো ন্যাটোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এর সদস্য হয়েছে। ফলে রাশিয়া এক ধরণের হুমকি পশ্চিমা বিশ্বের থেকে পেয়েছে। এদিকে রাশিয়ার যে অস্ত্রভাণ্ডার আছে, বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক ভাণ্ডার তাদের আছে। ফলে রাশিয়ার ভেতর থেকেও এক ধরণের হুমকি ছিল। সেই হুমকি মোকাবেলা করার জন্য পশ্চিমারা রাশিয়াকে ইন্টিগ্রেড করার চেষ্টা করেছে। আর ইন্টিগ্রেড যেহেতু হয়নি, সেহেতু রাশিয়া তার একটা অবস্থান তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করে। বিশেষ করে পুতিনের নেতৃত্বেই এই কাজ হয়। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে অনেকের এক ধরণের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। একটা পর্যায়ে দেখা গেল, ইউক্রেনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের যুক্ত হওয়া, আবার রাশিয়ারও একই ঘটনায় যুক্ত হওয়া।


২০১৪ সালে ক্রিমিয়া যখন রাশিয়ার দখলে আসে, তখন দেখা যায় পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক খুবই তলানিতে গেল। এক্ষেত্রে আমি বলব না ছিন্ন হওয়া কিন্তু রাশিয়ার হুমকিটা তাদের কাছে বড় আকারে সামনে আসল। তারই ধারাবাহিকতায় ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি যে, মেরুকরণের জায়গা থেকে শুধু রাশিয়া না , এখানে চীনও একদিকে আছে। এক্ষেত্রে আমি বলব যে, এখানে মেরুকরণ হচ্ছে ভিন্ন পরিবেশে অর্থাৎ একটা বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার ভেতরে হয়েছে। এটা স্নায়ু যুদ্ধের সময় পঞ্চাশের দশক কিংবা ষাটের দশকের মতো না।



এখানে মেরুকরণের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট, চীন বা রাশিয়ার মধ্যে হচ্ছে। অন্যদিকে ভারত, জাপান, আফ্রিকার দেশ কিংবা ব্রাজিলসহ অনেক দেশ কিন্তু এর বাহিরে অবস্থান করছে। আবার চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক আছে। ফলে জটিল একটা ব্যবস্থার মধ্যে মেরুকরণ হচ্ছে। সেই দিক থেকে নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই মেরুকরণের কারণে হোক বা অন্য কারণে হোক তাদের নিয়ন্ত্রণ একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে। আর এই চ্যালেঞ্জটা কিভাবে মোকাবিলা করবে তার অংশ হিসেবে রাশিয়ার যে হুমকি তথা উত্থান সেটিকে কিভাবে দমন করা যায়, সে প্রচেষ্টা এখানে থাকা স্বাভাবিক।



বিবার্তা: গত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে এবং উন্নয়নসারথী হিসেবে চায়না এদেশে কাজ করছে- সেটা কি যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূল হলো?


ড. দেলোয়ার হোসেন: দেখুন, এক্ষেত্রে আমি বলব চক্ষুশূল না। বাংলাদেশ গত ১৪ বছরে যে উন্নয়ন অর্জন করেছে, সেটাকে আমরা ব্যাপক মাত্রায় দেখতে পাচ্ছি। এই দেশ এখন পৃথিবীতে উন্নয়নের বড় ধরণের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-পশ্চিমা দেশগুলোও এই দেশের উন্নয়নের ব্যাপারে অনেক প্রশংসা করেছে। কিন্তু চীনের অংশগ্রহণের বিষয়টা হলো, চীন বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একমাত্র রাষ্ট্র নয় অর্থাৎ চীন অনেকগুলো অংশীদারের মধ্যে একজন। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের যে সম্পৃক্ততা, এটিকে এককভাবে বিবেচনা করে অর্থাৎ চীনের কারণে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে, ব্যাপারটা একেবারে তা না। চীন আমাদের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে, যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র রাখছে, জাপান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, ভারত আমাদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গে আমরা ১৮ বিলিয়ন ডলারের রূপপুর পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি চুক্তি করেছি। আমাদের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে অনেক রাষ্ট্র আছে। ফলে এটি এককভাবে চীনের উপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নাই। তারপরেও চীনের একটা ভূমিকা আছে। আমরা জানি যে চীন বাংলাদেশের বেশকিছু মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে, যেভাবে জাপানও করছে। চীনের অংশগ্রহণ শুধু অর্থনৈতিকভাবে না, অন্যান্য দিক থেকে চীনের অংশগ্রহণ শুধু বাংলাদেশ কেন, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা কিংবা মালদ্বীপেও তাদের উপস্থিতি বেড়েছে। সেটিকে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা দেশগুলো তাদের কূটনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ এটাকে কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সেই চেষ্টা করছে।



কিন্তু তার জন্য বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষতি না করে বরং আমরা যেটা দেখতে পাই যে, পশ্চিমা বিশ্ব কিন্তু অনেক বড় বড় প্রজেক্ট নিচ্ছে। ৬০০ বিলিয়ন ডলারের একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট জি সেভেনের গত সামিটে নিয়েছে। ফলে যে জায়গাগুলোতে চীনের আলাদা সুবিধা আছে, শক্তি আছে, সেখানে পশ্চিমা বিশ্ব অবকাঠামোর যে খাতগুলো আছে সেখানে সহায়তা করার যে ক্যাপাসিটি সেটা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ফলে আমি মনে করি, চীনের অংশগ্রহণটাকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যে বৈরিতা সেটার মাধ্যমে দেখার কারণে চীনের অবস্থানটা তাদের কাছে কিছুটা উদ্বেগের বিষয়। এক্ষেত্রে আমি বলবো না এই বিষয়টা চক্ষুশূল। একইসঙ্গে তারা এটাও জানে যে, বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে। ফলে চীন কিংবা অন্য যে কোন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হোক না কেন এর সামরিক কিংবা নিরাপত্তার কোন বিষয় নাই। কারণ বাংলাদেশ একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সংলাপ করছে, নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে অর্থাৎ অংশীদারিত্বের সম্পর্ক তৈরি করেছে।



বিবার্তা: যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শীতল সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে কি-না?


ড. দেলোয়ার হোসেন: এখানে শীতল সম্পর্ক বলতে যেটা বুঝায়, সেটা এখনো সেভাবে হয়নি। কারণ আমরা জানি যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। আমরা ২০১২-১৩ সালেও দেখেছি, ড. মুহাম্মদ ইউনুস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের মতপার্থক্য ছিল। রানা প্লাজার পরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। সেটি নিয়েও দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। একইসঙ্গে বহুবছর ধরে বাংলাদেশ চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোটা ফ্রি বাজারে প্রবেশ করতে। সেটিও বাংলাদেশ এখনও পাইনি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গাতে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একদিকে মতপার্থক্য অন্যদিকে বলা যায় যে, একটা দরকষাকষির সম্পর্ক আছে। সেই দিক থেকে আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের যে অবস্থান ব্যক্ত করছে, সেটি আসলে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে মাথায় নিয়ে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক, তার মধ্যে শীতলতা কিংবা বৈরিতা- সেটি আমি মনে করি না। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সেই ধরণের সুযোগ বা সেই অবস্থায় যাবে সেটাও আমার মনে হয় না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে বাস্তববাদ বড় একটা বিষয়।


আমরা জানি যে, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে আমরা দেখলাম যে, অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ৪ মাসের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র দেশগুলোও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এটি বিবেচনা করলে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় একটা র‍্যাশনাল অ্যাপ্রোচ বজায় রাখার চেষ্টা করে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যে বিবেচনায় থেকে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে, সেই বিবেচনাগুলো তারা সবসময় পুনর্মূল্যায়ন করেন অর্থাৎ পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ আছে। সেই দিক থেকে আমি মনে করি না যে, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বড় ধরণের কোন পরিবর্তন ঘটবে। কারণ বাংলাদেশের যে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, অর্থনৈতিক সক্ষমতা- এই বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র ভালো করে জানে। ফলে বাংলাদেশকে তাদের প্রয়োজন আছে। চীন, ভারত বা অন্যান্য রাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দেয়, একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশ নিজে থেকে কোন রাষ্ট্রের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করে না এবং সেই ধরণের কোন পলিসি বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার যে নীতি, সেটার মধ্যে অটুট আছে। ফলে আমি মনে করি না দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঐভাবে বড় কোন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। হয়তো সাময়িক এক ধরণের মতপার্থক্য কিংবা টেনশন কাজ করতে পারে। সেটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর বড় ধরণের কোন রেখাপাত করবে না।


বিবার্তা : যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলছে। শেখ হাসিনার ওই একই কথা। বিএনপি তো ঘোষণা দিয়েছে এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না- কিন্তু তারা ভীষণ উল্লাসিত। তারা কি চায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিক?


ড. দেলোয়ার হোসেন: আমরা অনেক দিন যাবত লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তার করে আসছে। এক সময় টুইজডে গ্রুপ ছিল। বাংলাদেশের কিছু কিছু সংকট মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘ কিংবা কমনওয়েলথের উদ্যোগ ছিল। এগুলো আসলেই কখনোই অভিপ্রেত ছিল না, কাম্য ছিল না। এখনো যে ধরণের তৎপরতা চলছে, এটি কোনভাবেই স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। আমরা জানি যে, গত ৫১ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশকে শাসন করেছে। ফলে তাদের কাউকে এমন না যে, অন্য কেউ বসিয়ে দিয়েছে বা বসিয়ে দেওয়া সম্ভব। এটি এখানকার রাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারাই নির্ধারিত হয়। আমি মনে করি না যে, যুক্তরাষ্ট্র যে ধরণের তৎপরতা সেখানে কারো খুশি হওয়ার কোন কারণ আছে। এই তৎপরতাগুলোর কোন প্রয়োজন নাই। সেটি আসলেই পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দেওয়া উচিত। আমরা দেখি যে, বিশ্বে ভারতসহ অনেক উন্নত দেশই আছে যারা অন্য কোন দেশের তৎপরতা তাদের দেশে রাজনৈতিকভাবে সবপক্ষই বর্জন করে অর্থাৎ অপতৎপরতার কোন সুযোগ তৈরি করতে দেয় না। আমাদের এখানে আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে লক্ষ্য করছি যে, এই ধরণের তৎপরতা রাষ্ট্রগুলো থেকে দেখানো হয় আবার এখানে তৎপরতাগুলোকে জায়গা করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এর কোনটাই আসলেই কাম্য নয়। শেষ পর্যন্ত ফলাফল যাই হওয়ার তাই হবেই অর্থাৎ এই তৎপরতার মাধ্যমে কোন ধরণের কাঙিক্ষত পরিবর্তন কখনো দেখিনি। আর দেখার কোন সম্ভাবনাও নাই। যেটা বাস্তব সেটা হচ্ছে, একটা দেশের ভেতর জনগণ, রাজনৈতিক শক্তিসমূহ এবং তাদের যে আচরণ বা চেষ্টা, সেটাই মূল ভূমিকা রাখে।


কারণ ১৯৭১ সালে আমরা যে মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছি তার আগের দীর্ঘ সংগ্রাম, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা জায়গাতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষ আন্দোলন করেছে। তখন কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে অন্য দেশ এসে তাদের পক্ষে কথা বলা বা তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার কথা বলেনি। সেই দিক থেকে আমি মনে করি এই তৎপরতার প্রয়োজন নাই। কাজেই এই তৎপরতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য কখনো সহায়ক নয়।



বিবার্তা : আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান?


ড. দেলোয়ার হোসেন: জাতি হিসেবে আগামীর বাংলাদেশকে স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট হিসেবে দেখতে চাই। বাংলাদেশ আগামীর পথে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, ইতোমধ্যে বেশকিছু মাইলফলক অর্জন করেছে। যেমন- বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এখন এটাকে একটা মধ্য আয়ের দেশও বলা যায়। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তার যাত্রা শুরু করবে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এই মুহূর্তে পাকিস্তান, ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের যে জিডিপি সেটি পাকিস্তানের চেয়েও বেশি অর্থাৎ যে দেশগুলো আমাদের থেকে এগিয়ে ছিল, আমরা এখন তাদেরকেও পেছনে ফেলেছি। আমাদের অগ্রগতির যে ধারা, সেই ধারাটা গত দেড় দশকে ব্যাপকতা লাভ করেছে। এটি আরও চলমান থাকবে। আর এর মাধ্যমে ২০৪১ সালের যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, ২০৪১ সালে এই দেশ উন্নত, স্মার্ট রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে। আর এটি হচ্ছে একটি প্রতীক। মূল বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ, উন্নত এবং স্থিতিশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কারণ আমরা অতীতে লক্ষ্য করেছি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য ম্লান হয়ে গেছে কিংবা অর্জন করতে পারিনি অনেক কিছু। বাংলাদেশ ক্রমাগত বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এই দেশে ক্রমাগত হরতাল, সহিংসতার মধ্যে ছিল, ক্রমাগত কলকারখানা বন্ধ ছিল। এগুলো থেকে আমরা বের হতে চাই। আমরা শিক্ষিত এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে চাই। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনে যে ঝুঁকিগুলো রয়েছে সেগুলোও আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করতে চাই। যে কারণে ২১০০ সালের যে ডেল্টা প্ল্যান সেটিও বাংলাদেশের সামনে আছে। সবমিলিয়ে আমি মনে করি আমাদের যে ইতিহাস, ঐতিহ্য আছে সেটাকে ধারণ করে আমরা একটি আত্মনির্ভরশীল, সমৃদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে এগিয়ে যাব।


বিবার্তা: বিবার্তাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।


ড. দেলোয়ার হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা / রাসেল/ রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com