সাক্ষাতকার
‘জনগণকে সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গুরোধী পরিকল্পনা জরুরি’
সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী ড. কবিরুল বাশার
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৩, ২১:৩৭
‘জনগণকে সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গুরোধী পরিকল্পনা জরুরি’
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি বছর এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-আতঙ্ক। দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই ভয়ংকর হচ্ছে। আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। এ রোগ ভয়াবহ আকারে ছড়ানোর কারণ কী, এডিস মশা ও ডেঙ্গু কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং জনগণের করণীয় সম্পর্কে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী ড. কবিরুল বাশার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিবার্তার প্রতিবেদক এস এম রিয়াদ রহমান।


বিবার্তা: রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের মানুষ মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অন্য বছরের তুলনায় বেশি। এবার পরিস্থিতি ভয়াবহ কেন?


ডা. কবিরুল বাশার: রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে মশার কয়েকটি প্রজাতি আছে। বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা পাওয়া গেলেও ঢাকাতে আমরা পাই ১৪ থেকে ১৬ প্রজাতির মশা। তার মধ্যে কিউলেক্স, এডিস, অ্যানোফিলিস, হেমাগোগাস, ম্যানসোনিয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রজাতি আছে। কিউলেক্স মশা যেমন ড্রেন বা নর্দমাতে হয়। এটি সাধারণত শীতকালে বেশি হয়। এডিস মশা পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে হয়। আমাদের দেশে বর্ষাকালে বেশি হয়। মশা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে আমরা যেটি দেখি যে, কোনো জায়গায় ময়লা আর্বজনায় যদি পানি জমে থাকে তাহলে সেখানে কিউলেক্স মশা বেশি হয়। আর যেকোনো পাত্র যেখানে-সেখানে পড়ে থাকলে তাতে পানি জমে থাকে এবং এডিস মশা ডিম দেয়। সেখান থেকে এডিস মশা বেড়ে যায়। সেজন্য এডিস মশা বা কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে অর্থাৎ পানি জমে না থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে।


বিবার্তা: গত পাঁচ বছরের মধ্যে জুন মাসের আগে কোনো ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়নি। অথচ এ বছর মে মাস পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের এবং চলতি জুন মাসেই ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। কারণ কী?


ডা. কবিরুল বাশার: বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা যেটা দেখছি যে, মে মাসের আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এত ডেঙ্গু আগে কখনো হয়নি। এ বছর প্রথম জুন মাসের আগেই এত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তার মূল কারণ হিসেবে আমরা দেখি সেটি হচ্ছে ঢাকায় নগরায়নের বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকায় বড় বড় ভবন হয়েছে, ভবনগুলোর নিচে যে গাড়ি রাখা হয় বা গাড়ির ধোঁয়া হয়, সে জায়গায় পানি জমে, সেখানে আমরা এডিস মশা পাই। নির্মাণাধীন ভবন দীর্ঘ সময় ধরে হয়, এসব নির্মাণাধীন ভবনে ও আশপাশে আমরা ডেঙ্গু পাই। ঢাকায় কিছু কিছু জায়গায় পানি পাওয়া যায় না। তারা ড্রামে করে পানি জমিয়ে রাখে সেখানে আমরা এডিস মশা পাই। যে পাত্রগুলোর কথা আমি বললাম তার সাথে বৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই। এ পাত্রগুলো সারা বছর বিদ্যমান, ফলে এসব জায়গায় আমরা সারা বছর এডিস মশা পাই। যে কারণে জুন মাসের আগে এত মৃত্যু হয়েছে এবং এত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। চলতি জুন মাসেও মৃত্যু বেড়েই চলছে। মৃত্যু হওয়ার আরেকটি কারণ হল দীর্ঘ সময় ধরে যখন কোনো একটি দেশে ডেঙ্গু থাকে এবং ডেঙ্গুর যেহেতু চারটি সেরোটাইপ আছে, এর একটি সেরোটাইপ দিয়ে একবার কেউ আক্রান্ত হলে পরবর্তী সময়ে অন্য আরেকটি সেরোটাইপ দিয়ে যদি একই ব্যক্তি যদি দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হয়, তখন মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। সে কারণেও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার আরেকটি কারণ।


বিবার্তা: ডেঙ্গুর ভিন্ন ভিন্ন ধরন সম্পর্কে যদি বলতেন। এসব ধরন কীভাবে আলাদাভাবে বোঝা যায়?


কবিরুল বাশার: আমরা জানি চারটি সেরোটাইপ দিয়ে ডেঙ্গু হয়- ডেঙ্গু ওয়ান, টু, থ্রি এবং ফোর। এই ধরনকে আলাদা করার আসলে কোনো প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষ করতে পারবে না। এটি যদি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে পিসিআর করা হয় এ ভাইরাসের তখনই শুধু আলাদা করা যায়। তাছাড়া এটিকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এটি আলাদা করার তেমন কোনো প্রয়োজনীতাও নেই। চারটি সেরোটাইপের যেকোনোটি দিয়েই আক্রান্ত হোক না কেন, চিকিৎসা ব্যবস্থাটা যেহেতু একই রকম। তাই কোন সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে সেটি আমাদের সাধারণ নাগরিকদের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।


বিবার্তা: এই সময়ে এডিস মশার ভয় কতটা? জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে পরিস্থিতি কী হতে পারে?


কবিরুল বাশার: জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই তিনটি মাস বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রধান মৌসুম বা পিক টাইম। এ সময় ডেঙ্গু আমাদের দেশে খুব বেশি হয়। তাই এ সময় এডিস মশা কামড়ানো আমাদের জন্য অবশ্যই ভয়ংকর। এ সময় আমাদের এডিস মশা থেকে মুক্ত থাকতে হবে।


বিবার্তা: বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা বাড়ে। এখন দেখা যায় সারা বছর এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হচ্ছে। কারণ কী?


কবিরুল বাশার: বর্ষার সময় এডিস মশা অবশ্যই বাড়ে। এখন বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা বাড়ার কারণ হচ্ছে বৃষ্টির পানি বিভিন্ন জায়গায় আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা পাত্রে পানি জমা হয় এবং সেখানে এডিস মশার প্রজনন হয়। সে কারণে বর্ষার সময় এডিস মশা বাড়ে। তবে আমরা এখন সারা বছর এডিস মশা পাচ্ছি। কারণ সারা বছরই বিভিন্ন জায়গায় নানান পাত্রে পানি জমে থাকে। তাই সারা বছরই এডিস মশার কার্যক্রমটি পরিচালনা করতে হবে।



বিবার্তা: ডেঙ্গু হেমোর‌্যাজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এত ভয়াবহ কেন? ডেঙ্গু হেমোর‌্যাজিক ফিভার আসলে কী?


কবিরুল বাশার: ডেঙ্গু হেমোর‌্যাজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এ দুটি অবশ্যই ভয়ংকর। তার কারণ হল ডেঙ্গু হেমোর‌্যাজিক ফিভারে রক্ত চলে আসে দাঁত দিয়ে, পায়খানা অথবা বমির সাথে। অথবা চোখ দিয়েও রক্ত চলে আসতে পারে। রক্ত যখন বেরিয়ে আসে তখন আমাদের দেহে রক্তশূন্যতা তৈরি হয়। রক্তশূন্যতা তৈরি হলে একটি মানুষের ব্লাড প্রেশার কমে যায়। তাতে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়ে যেতে পারে এবং তার মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এ জন্য ডেঙ্গু হেমোর‌্যাজিক ফিভার হলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।


বিবার্তা: এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এখনও ঠিক কোথায় ঘাটতি রয়েছে? অগ্রগতিই বা কতটুকু হয়েছে?


কবিরুল বাশার: এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের বেশকিছু করণীয় রয়েছে। এর মধ্যে নগরবাসীর মধ্যে জনসচেতনতা জরুরি। সিটি করপোরেশন তার নিজ উদ্যোগে উন্মুক্ত স্থান, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ, এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণ, উড়ন্ত মশা নিয়ন্ত্রণ করবে। আর সাধারণ নাগরিক যারা আছেন তারা তার বাড়ির আঙিনা, ঘরের কোনা, ছায়াময় স্থান, একটু স্যাঁতসেঁতে জায়গা, রান্নাঘরের বেসিন বা বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন। ছাদে বা ভবনের আশপাশে নিশ্চিত করবেন যাতে কোথাও কোনো পাত্রে যেন পানি জমে না থাকে।


বিবার্তা: বাংলাদেশে মশক নিধনে কীটনাশক কাজ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারপরও সিটি করপোরেশন কেন ব্যবহার করছে?


কবিরুল বাশার: বাংলাদেশে মশক নিধনে কীটনাশক কাজ করে না, এটা ঠিক। আবার সব কীটনাশক কাজ করে না, এমনও না। তবে দু-একটি কীটনাশক কাজ করে না, এটা সত্যি। যখন দীর্ঘ সময় ধরে কোনো একটি কীটনাশক দেশে অথবা বিদেশে ব্যবহার করা হয়, তখন সে কীটনাশকের বিরুদ্ধে মশাটি প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সেজন্য কয়েক বছর পরপর কীটনাশক পরিবর্তন করে নতুন কীটনাশক ব্যবহার করা প্রয়োজন। তার সাথে কীটনাশকটি মাঝে মাঝে পরীক্ষা করা যে, কীটনাশকটির কার্যকারিতা কতটুকু আছে সেটি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।


বিবার্তা: এই মুহূর্তের কি করণীয়? রাজধানীর যদি অবস্থা এই হয়, তাহলে সারা দেশে কী ঘটবে?


কবিরুল বাশার: এই মুহূর্তে দেশে ডেঙ্গুর অবস্থা আমরা যা দেখছি, আমার কাছে মনে হচ্ছে, আগামী মাসগুলোতে ডেঙ্গু আরও বাড়বে। বিশেষ করে ঢাকা থেকে ডেঙ্গুটি কোরবানির ঈদের পরে প্রতিটি জেলাতে ছড়াবে। সেজন্য প্রতিটা জেলাতেই এডিস মশা নিধন কার্যক্রম শুরু করা দরকার। জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার, জনগণকে সচেতন করা দরকার এবং প্রতিটা জেলা শহরেই এডিস মশা ও ডেঙ্গু প্রতিরোধী প্লান এই মুহূর্তে করা দরকার।


বিবার্তা: অনেকেই বলছেন যে, কয়েল, স্প্রেতেও মশা মরছে না। কারণ কী?


কবিরুল বাশার: কয়েল বা স্প্রেতে মশা মরছে না অনেকটা ঠিক। কারণ এতে ব্যবহার করা কীটনাশক দীর্ঘ সময় থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে তাই মশা মরছে না। এতে নিয়মিত এসব কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার।


বিবার্তা: মশার ভোগান্তি থেকে বাঁচার টেকসই সমাধান কী হতে পারে?


কবিরুল বাশার: মশার ভোগান্তি থেকে বাঁচার জন্য টেকসই সমাধান যদি আমরা বলি, মশার প্রজাতি ভেদে দীর্ঘ মেয়াদি সময়ে দশ বছর বা পাঁচ বছর মেয়াদি বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি প্রজাতির মশা ধরে ধরে আলাদাভবে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা যদি আমরা বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে পরিচালিত করতে পারি তাহলেই মশা নিয়ন্ত্রণে টেকসই সমাধান হবে।


বিবার্তা: মশা নিয়ন্ত্রণে দায় কার? তারা কি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন?


কবিরুল বাশার: মশা নিয়ন্ত্রণে দায় যদি বলি, আমি বলব এ দায় সকলের। মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু সিটি করপোরেশনের দায় ব্যপারটি এমন নয়। মশা নিয়ন্ত্রণে দায় আমার আপনার সকলের।


বিবার্তা: এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধে এখনই কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?


কবিরুল বাশার: এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করার জন্য এখনই যে পদক্ষেপটা নেওয়া দরকার তা হলো- কোনো জায়গায় কোনো ধরনের পাত্রে পানি জমা থাকা যাবে না। যদি পানি জমিয়ে রাখা প্রয়োজন হয় তাহলে প্রতি সাত দিন পরপর ব্লিচিং পাওডার বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালোভাবে পরিস্কার করে তারপর পানি রাখতে হবে। যেকোনো জায়গায় পানি জমে থাকলেই এডিস মশার জন্ম হতে পারে। এই পানি রাখা বা জমার জায়গাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে পোকামাকড় নড়াচড়া করছে কি না। সেটি নিশ্চিত করতে পারলেই ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।


বিবার্তা: ধন্যবাদ আপনাকে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য।


ড. কবিরুল বাশার : আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/রিয়াদ/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com