শিরোনাম
ওই কাগজে লেখো, ‘কেয়ার অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ (পর্ব-২)
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২১, ২১:২২
ওই কাগজে লেখো, ‘কেয়ার অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ (পর্ব-২)
মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

বঙ্গবন্ধু পিজি হাসপাতালের ডাইরেক্টর নুরুল ইসলামকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, আমার কুদ্দুস কেমন আছে? মো. আব্দুল কুদ্দুসের শরীরের অবস্থা জানানোর পর নুরুল সাহেব বলেন, উনার একটু সমস্যা হয়েছে। সেটা হলো, উনার যে কাগজপত্র হাতে পেয়েছি, তাতে তো শুধু নাম পেয়েছি, কিন্তু উনার বাবার নাম নেই। বঙ্গবন্ধু বলেন, ওই কাগজে যেখানে ওর বাবার নাম নেই সেখানে লেখো, কেয়ার অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর শোন, তুমি যে কোনোভাবেই হোক, ওকে সুস্থ করে তোলো। আমি ওকে জীবিত দেখতে চাই। পরে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শেষে নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরে এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা পিজি হাসপাতালে চলে আসেন। এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলেন। এসব দেখে সব ডাক্তাররা তো হতভম্ভ! এ কি ঘটনা!


এভাবেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে নিজের ছাত্ররাজনীতি জীবনের স্মৃতিচারণ করছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি।


তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে সরাসরি রাজনীতি করার ফলে কাছ থেকে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ। বঙ্গবন্ধু একজন আদর্শ নেতা ছিলেন। তার সান্নিধ্যে থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমিও বঙ্গবন্ধুর নীতি আর আদর্শকে বুকে ধারণ করেছি। সে নীতি আর আদর্শ অনুসারে মানুষের সেবায় রাজনীতি করে যাচ্ছি।


সম্প্রতি বিবার্তা কার্যালয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন বরণ্যে এই রাজনীতিবিদ। একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নেতৃত্বে তাঁর রাজনৈতিক জীবন, বঙ্গবন্ধুর সাথে কাটানো বিভিন্ন মধুর স্মৃতি। তাঁর সেই বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতা বিবার্তায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ বিবার্তা২৪ডটনেটের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো দ্বিতীয় পর্ব।


বিবার্তা: জেনেছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আপনি সরাসরি রাজনীতি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে কাটানো সেই দিনগুলো কেমন ছিলো?


মো. আব্দুল কুদ্দুস: সেই গল্প বলতে গেলে শেষ হবে না। তবুও ছোট করে বলি। ১৯৭৪ সালে নাটোরের একটা অংশ, রাজশাহীর বাঘমারা, আত্রাই, ভবানীপুর, গোদাগাড়ী, তানোর এই অঞ্চলে বিপ্লবী সরকার গঠন করবে অহিদুর রহমান। প্রতিদিনই মানুষ খুন হয়। সন্ত্রাসীরা তিন মাসে ৩২৬ মানুষ খুন করেছে। ওরা নাকি জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠা করবে। রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন দখল করবে, বাংলাদেশের মুদ্রা পরিবর্তন করবে। এই সব হচ্ছে তাদের পরিকল্পনা। ডিগ্রি কলেজের একটা মেয়ে ছিলো। সে কলেজের মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক। ওর বাড়ি আত্রাইয়ে। তার রুমমেট আবার জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার সঙ্গে যুক্ত। ওর কাছে একটা বই মেয়েটা পড়তে দিয়েছে। ওই বইয়ের প্রথম দিকের কয়েক লাইনে বঙ্গবন্ধুর বংশ নিয়ে বিভিন্ন আজেবাজে কথা লিখেছে। ধ্বংস করতে হবে, খুন করতে হবে এসব আর কি। এছাড়া জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা সরকার গড়ার বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ছিলো।



মো. আব্দুল কুদ্দুসকে পিজি হাসপাতাল থেকে দেয়া ‘কেয়ার অব বঙ্গবন্ধু’ লেখা মেডিকেল সার্টিফিকেট


ওই বইটা আমার কাছে এসে পৌঁছে। আমি বুঝতে পারলাম এই কারণেই তো এতো লোক মারা যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, উচ্চ পর্যায়ের গোপন একটা খবর। বঙ্গবন্ধুকে জানানো দরকার। ঢাকায় গেলাম। সময়টা ১৯৭৪ এর মে মাস। স্রেফ আমি, বঙ্গবন্ধু আর রফিকুল্লাহ চেীধুরী (স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা)। উনি বঙ্গবন্ধুর সচিব ছিলেন। উনি বইটা পড়লেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেবকে ডাকলেন। উনি আসলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, মনুসর ভাই আপনে হচ্ছেন গিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আমি হচ্ছি প্রধানমন্ত্রী। আমাদের এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআই আছে। তারা কোনো খবর পেলো না, কুদ্দুস খবরটা নিয়ে আসলা। কী ব্যবস্থা নিবো বলেন? আপনি যা বলেন তাই হবে।


নেতা (বঙ্গবন্ধু) সেনাবাহিনী প্রধান শফিউল্লাহকে ডাকলেন। রক্ষীবাহিনীর চিফ ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও বিডিআরের চিফ মেজর জেনারেল সিআর দত্তকে ডাকলেন। ডিজিএফআই, এনএসআইকে ডাকার পর বললেন, আজকে প্ল্যান করেন। ওখানে কম্বিং অপারেশন হবে। এর পলিটিক্যাল লিয়াঁজো করবে কুদ্দুস। লিখিত দিয়ে দিলেন।


তিনদিনের মধ্যে বৃহত্তর রাজশাহীতে ৮টা ক্যাম্প হলো। হেড কোয়ার্টার ছিলো তানোর। সেখানে মেজর আশরাফের সাথে আমি থাকতাম। সবকিছু দেখাশোনা করতেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। নানা জায়গায় প্রায় আড়াই মাসের মতো অভিযান পরিচালিত হলো। হঠাৎ করে শোনা যায় তারাও সংগঠিত হচ্ছে। ক্যাম্পের কাছে একটা বিল ছিলো। খবর আসে সেই বিলের পাড়ে একটা বাড়ি দখল করেছে প্রায় ২০০ সন্ত্রাসী। তারা আমাদের মেইন ক্যাম্পে আক্রমণ করবে বলে ঠিক করেছিলো। আমাদের কাছে খবর এলো। পরে আমরা পরদিন সকালেই অভিযান চালাই। তখন জুলাই মাস। আমরা বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১১০ জনকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসি। এই তাদের পতন হয়ে গেলো।


এর দুই দিন পর জেনারেল শফিউল্লাহ ও মেজর জেনারেল জিয়া ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। জিয়া বলেন, এই আশরাফ তোমাদের গোলাগুলিতে নাকি বহু লোকজন মারা গেছে। লাশ কোথায়? আশরাফ বলেন, না স্যার, আমরা যাদের অ্যারেস্ট করেছি তাদের পুলিশে দিয়ে দিয়েছি। পুলিশ তাদেরকে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।


যুদ্ধের সময় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ইন্ডিয়ান আর্মির পক্ষ থেকে আমাকে একটা অস্ত্র দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছিলো। টেন্টে বালিশের ওপর ছিলো অস্ত্রটা। জিয়া কোথা থেকে সেই খবর পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার? আমি বললাম আমার। তিনি বললেন, এসব অস্ত্র সেনাবাহিনীর কাছে থাকে। অন্যের কাছে থাকা অবৈধ। এই বলে তিনি অস্ত্রটা নিয়ে নিলেন। আমি বললাম, এটা তো আপনারা দেননি। এটা রাখার পারমিশন আছে। আমি সাথে সাথেই বলেছি, এটা নিয়ে আপনি হজম করতে পারবেন না।


অভিযান শেষ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ঘটনা শোনার জন্য ঢাকায় ডাকলেন। সবকিছু শোনার পর বঙ্গবন্ধু চুমু দিলেন। আমার গায়ে বঙ্গবন্ধুর কত যে চুমু আছে, তার হিসাব নাই। কামরুজ্জামান হেনা ভাইয়ের বাসায় গেলাম। বললাম, আমার কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসলেন জিনিসটা কি পাবো না। তিনি বললেন, আমার কাছে নাই। বঙ্গবন্ধুর কাছে বলেন। পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বলি, নেতা আমার একটা ছোট্ট অভিযোগ ছিলো। অপারেশেনের সময় আমার কাছে একটা অস্ত্র ছিলো। জিয়াউর রহমান নিয়া গেছে। উনি শুনলেন। শোনার পর তিনি জিয়াকে ডাকলেন, এই জিয়া। জি-স্যার। আপনি কুদ্দুসকে চিনেন না। জিয়া বলেন, কামারুজ্জমান সাহেবের বাসায় মাঝে মাঝে দেখেছি। এতো বড় একটা ঘটনা তোমরা জানলা না। কুদ্দুস জানলো। অপারেশন হলো। মেজর আশরাফের সাথে থাকতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়ান আর্মি বৈধভাবে তারে অস্ত্রটা দিছে, আপনি নিয়া আসছেন কেন? জিয়া কোনো কথা বলেননি। তুমি এখানে দাঁড়াও তোমার ব্যাটসম্যান আছে না। বলেন, আছে। ওরে এখনই বাসায় পাঠাও কোথায় আছে বলে দাও নিয়ে আসবে। সেই অস্ত্র নিয়ে আসার পর বঙ্গবন্ধু আমার হাতে দিলেন। সেই অস্ত্র পরে আমি সেনাবহিনীর হাতে তুলে দিয়েছি।


মারাত্মক একটা ঘটনা বলি। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৩৬তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে যান বঙ্গবন্ধু। সফর সঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. নূরুল ইসলাম, গ্যাস ও অয়েল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমান, এম আর সিদ্দিকী এমপি, আসাদুজ্জামান খান এমপি, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ মোট ২৪ জন।


ওই সময় দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিলো। তো রাজশাহীতে লঙ্গরখানা ছিলো। আমি তখন ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অফিসে বসা। এসময় হঠাৎ একটা ব্যারেল দেখতে পাই। হঠাৎ আমাকে ব্রাশ ফায়ার করে। পর পর ৪টি গুলি করেছে। আমার শরীরে ঢুকে গেছে। পেটের দুইটা ছোট গুলি এখনও আছে। তো সবাই ভাবছে আমি মারা গেছি। বঙ্গবন্ধু তখন জাতিসংঘে। কামারুজ্জামান সাহেব, ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জানালেন। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথেই বলে ওঠেন আমার কুদ্দুস গুলি খাইছে।



বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে তৎকালিন ছাত্রলীগ নেতা মো. আব্দুল কুদ্দুস


এসব ঘটনার কথা পরে শুনেছি। তখন আমি অচেতন ছিলাম। কামারুজ্জামান সাহেব বলেছেন শেখ কামাল ফুটবল টিম নিয়ে চট্টগ্রামে ছিলো। আমার এ ঘটনা শোনার পর আমাকে দেখতে দ্রুত চলে আসেন। রাজশাহী হাসপাতাল থেকে আমাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করেছে। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান দোতলার যে কেবিনে চিকিৎসা নিয়েছিলেন সেখানে ভর্তি করা হলো। পরে শুনেছি। প্রতিদিন সকালবেলা শেখ কামাল আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসতেন। বিকেলেও আসতেন। বঙ্গবন্ধু পিজি হাসপাতালের ডাইরেক্টর নুরুল ইসলামকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, আমার কুদ্দুস কেমন আছে? আমার শরীরের অবস্থা জানানোর পর নুরুল সাহেব বলেন, উনার একটু সমস্যা হয়েছে। সেটা হলো, উনার যে কাগজপত্র হাতে পেয়েছি তাতে তো শুধু নাম পেয়েছি, কিন্তু উনার বাবার নাম নেই। বঙ্গবন্ধু বলেন, ওই কাগজে যেখানে ওর বাবার নাম নেই সেখানে লেখো, কেয়ার অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর শোন, তুমি যে কোনোভাবেই হোক, ওকে সুস্থ করে তোলো। আমি ওকে জীবিত দেখতে চাই।


বঙ্গবন্ধুর এপিএস হানিফ ভাই আমাকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু দেশে আসার আগে বাগদাদ শীরফ জিয়ারতে যান। সেখানে তিনি ৪টা গিলাফ দিয়েছেন। একটা মা, একটা বাবা, একটা নিজের নামে ও আরেকটা আমার নামে। ওখানে উনি ৪টা দুম্বা সদকা দিয়েছেন। এর মধ্যে একটা আমার নামে। এখন কাউকে বললে এগুলো কিন্তু রূপকথার মতো মনে হবে। বিশ্বাস করবে না। মহিউদ্দিন সাহেব আমাকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু প্রতিদিনই খোঁজখবর নিতেন। বঙ্গবন্ধু এতাদিন পর দেশে ফিরেছেন উনি হয় বঙ্গভবন যাবেন, আর না হয় ধানমন্ডি ৩২ যাবেন। মহিউদ্দিন সাহেব আমাকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট থেকে এখন যে বিজয় স্মরণি ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা পিজি হাসপাতালে চলে আসলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিলেন। এসব দেখে ডাক্তাররা তো হতভম্ভ হয়ে পড়েন।


বিবার্তা: বঙ্গবন্ধুর সাথে কাটানোর এমন কোনো স্মরণীয় স্মৃতি আছে, যা এখনো কেউ জানে না?


মো. আব্দুল কুদ্দুস: ১৯৭২ সালে হঠাৎ একদিন বঙ্গবন্ধুর এপিএস হানিফ সাহেব বললেন, ভাই, বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আপনাকে খুঁজছিলেন। কিভাবে বুঝলেন? তোফায়েল ভাই বলছিলেন, কুদ্দুসরে একটু ডাইকা দিয়ো তো। আমি পরের দিন বাসে ঢাকায় আসলাম। এসে তোফায়েল ভাইয়ের সরকারি বাড়িতে উঠলাম। পরে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলাম। তিনি বললেন, এই যে দেখ, আমাদের (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) এমপিএ'দের বিরুদ্ধে রিপোর্ট আছে, আমি দুর্নীতিবাজদের স্যাক করবো। তোরা একটা মিটিং কর। আমি কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর, রাজ্জাক, জিল্লুর আর সাজেদাকে পাঠাবো।


সেই মিটিং আয়োজন করা হলো। সরকারি দলের বিশাল আয়োজন। এমপিএ’রা আছে, মন্ত্রীরা আছে। আমরা ছাত্ররা আছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলো থেকে বাসে করে ছেলেরা এলো। তো ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমি প্রথমে একটা বক্তৃতা দিয়েছি। সেখানে রাজ্জাক ভাই, জিল্লুর ভাই আছেন, সাজেদা আপা আছেন, তারপর কামারুজ্জামান, রংপুরের মতিউর সাহেব, ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেব আছেন। সব নেতাই আছেন। শুরুতেই আমি বক্তব্য দিলাম। শুরুতেই বললাম, আমরা লক্ষ্য করছি যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পরিপন্থী কিছু কাজ হচ্ছে এবং এমপিএ'রা এবং রেডক্রসের লোকজন দুর্নীতি করে বেড়াচ্ছে। আমরা এইসব দুর্নীতি বরদাস্ত করবো না। এই বলার পর তৎকালীন রাজশাহী শহর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি, রেডক্রস সোসাইটি বৃহত্তর রাজশাহী ইউনিটের চেয়ারম্যান আব্দুল হাদী বলা শুরু করলেন, এই ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী করে। চাঁদাবাজি করে এই করে, সেই করে, শেষ করে দিলো।


তখন আমার সাথে থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী অ্যাডভোকেট কামরুল, মজিবুর রহমান, মইনুদ্দিন মন্ডল, আকতার সিদ্দিকিসহ সবাই বললেন, হাদী সাহেব একি বললো? নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলেই হামলা। ৫ মিনিটের মধ্যে সব ভেঙে তছনছ করে দেয়া হলো। সাথে সাথে সব ভাইগা চলে গেছে। খাওয়ার যা আয়োজন ছিলো সব উত্তরা গণভবনের পাশের লেকে ফেলে দিয়ে আমরা সব বাসে করে নাটোর চলে গেছি। নেতাদের একেকজন একেক জায়গায় চলে গেলেন।


পাবনার আবু সাইয়িদ নাখালপাড়ায় কামারুজ্জামান হেনা ভাইয়ের কাছে এসে বলেন, মিটিং ভন্ডুল করার পেছনে কুদ্দুসের মদদ আছে। কুদ্দুসের বিচার করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে হবে। এরই মধ্যে পত্রিকায় খবর হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগের উত্তরাঞ্চলের মিটিং কুদ্দুসের নেতৃত্বে বানচাল। দৈনিক ইত্তেফাক তো ছবিসহ ছাপাইছে। পরে গণভবনে আমার ডাক পড়লো। আমি আসলাম।


বঙ্গবন্ধু এসব কাটিং দেখে আমারে বলতেছে এসব কি? উনি তো গোয়েন্দাদের কাছ থেকে সব জেনেই গেছেন। বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, এইত পুরাই বদমাইশি করা হলো। আমাদের নেতাদের তুই মাইর খাওয়াইছিস। আমার মন্ত্রীদের একজনকে আরেকজনের গায়ের ওপর ফেলে দিয়েছে। এই রাজ্জাক, বল ওইখানে কী হইছে? উনি বলেন, হইছে। এখন আর কী করবেন। কেন হইছে কী হইছে সেটা তো অন্য জিনিস। জিল্লুর ভাই তো শান্তশিষ্ট মানুষ। উনি শুধু এটুকুই বললেন, কুদ্দুস তুমি বলো কাজটা ঠিক হইছে? আমি বললাম, হাদী সাহেব কেন আমাদের গালাগালি করবে। ছাত্রলীগকে কেন এবং কী জন্য গালাগালি করলো? বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ছাত্রলীগকে কী কইছে? আমি তখন হাদী সাহেবের দেয়া বক্তবের কথা বললাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, এই রেডক্রসের হাদী এইসব বলছে?


সামনে মন্ত্রীরা বসা, ওই অঞ্চলের নেতারা, আবু সাইয়িদও ছিলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, কুদ্দুস এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। এতো বড় অনুষ্ঠান বানচাল হলো? বিষয়টা কেমন হলো? আমি বললাম, নেতা সবাই তো খাইতে গেছিলো। কতগুলো গরু জবাই হইছে? এই দুর্দিনে? এগুলো যদি গরিব মানুষদের বিলিয়ে দিতো তাহলে ভালো হতো না? এবার বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, এই কামারুজ্জামান সাহেব, আপনার জেলায় কতগুলো গরু জবাই হইছে? সমস্ত উত্তর বাংলায় ১৬টা মহকুমা...। ও, তাইলে খাইতেই গেছিলা তোমরা। এই বল তো কী হইছে? আমি বললাম, হাদী সাব গালাগালি করেছে। খুব অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। আমাদের সন্ত্রাসী, বদমাইশ এসব বলেছে। ও তো তোরা কী করছিস? ছেলেরা এইসব শুনে সহ্য করে নীরব থাকতে পারেনি। ডায়াসে উঠে নেতাদের বলছে আপনার চলে যান। তো এই সময় এক নেতার গায়ে আরেক নেতা পড়ে গেছেন এই হইছে অবস্থা। এসময়ে সাজেদা আপা চইলা আসছেন। নেতা বলেন, এই সাজেদা, তোমার গায়ে কি কেউ হাত তুলেছে? না, আমার গায়ে তো কেউ হাত দেয়নি। বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, এই বেয়াদব কুদ্দুস, সবাইকে সম্মান করবি। ভুল করেছিস স্বীকার কর। বললাম, নেতা সেই সকাল বেলা এসে আপনারে কয়ে গেছি ভুল হইছে। নেতা বলেন, এই হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ছে ভুল হয়ে গেছে। যা যা যা...।


বিবার্তা: আপনি তো বঙ্গবন্ধুর খুব স্নেহের ও কাছের মানুষ ছিলেন। এই সুবাদে কখনো কি কোন সুযোগ নিয়েছেন?


মো. আব্দুল কুদ্দুস: বঙ্গবন্ধুর সাথে কত ভালো সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আমি কখনো কোনো সুযোগ গ্রহণ করি নাই। ১৯৭৪ সালে একদিন গণভবনে একেবারে ঘরোয়ার পরিবেশে বসা। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই এতো বোকা কেন? দেখ, মিরপুর, মোহাম্মদপুরের সমস্ত পরিত্যক্ত জায়গা বরিশালের লোক, কুমিল্লা-নোয়াখালীর লোক দখল করেছে। তুই একটা জায়গা দখল করে থাক। আমি তখন বঙ্গবন্ধুকে বলি, নেতা আমি একটা কথা বলি? বল। ৩২ নাম্বারের বাড়ি তো আপনার না। বঙ্গমাতার বাড়ি। তাইলে আপনিও একটা পরিত্যক্ত জায়গা দখল করেন। আমিও একটা দখল করি। তখন নেতা বলেন, হারামজাদা আমি যা করবো তোরও কি তাই করতে হবে নাকি। কি যে বলেন না নেতা? আপনি জাতির পিতা। আপনারে এটা বলতে পারি নাকি। এরকম খোলামেলা পরিবেশে সব সময় নেতার সাথে আলাপ হতো।


এরকম একটা ঘটনা রাজশাহীতেও ঘটেছে। তো রাজশাহীতেও এরকম পরিত্যক্ত অনেক জায়গা ছিলো। বণ্টন তালিকা করতে একটা কমিটি ছিলো। ডিসি আব্দুর রউফ ছিলেন সভাপতি, আমি ছিলাম সেক্রেটারি। হঠাৎ করে রাত ১২টার দিকে সার্কিট হাউসে হেনা ভাই বলতেছে, তোর তো বাড়ি ঘর নাই। এতো বড় নেতা তুই, আমার পরে। থাকিস তো শ্বশুর বাড়ি। এক কাজ কর উপশহরে তো অনেক পরিত্যক্ত জায়গা। একটা জায়গা নিয়ে নিলেই পারিস। আমি বললাম, নিতে তো পারি, সত্যি নিতে পারি। সত্যি নিবো। আপনারও তো কিছু নাই, আপনি নেন। তাহলে আমিও নিবো। তখন আব্দুর রউফ বলেন, আমি হচ্ছি ত্রাণ পুনর্বাসন মন্ত্রী। আমি লোকজনরে পুনর্বাসন করবো আর আমি...। তখন বললাম, আপনি নেতা, আমি কর্মী। আপনি নিজেও পুনর্বাসন হোন না। তাইলে অসুবিধা কী।


বিবার্তা: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী রাজশাহী জেলায় প্রথম আপনাকে গ্রেফতার করে। সে সম্পর্কে জানতে চাই।


মো. আব্দুল কুদ্দুস: আমাদের এসপি ছিলেন এসএম আবু তালেব। তিনি আমার কাছে কিছু অস্ত্র চেয়েছিলেন। এগুলো হলে তার প্রমোশন হতো। ডিআইজি হয়ে যেতেন। তো আমি অস্ত্র নিয়ে আর্মিদের দিয়ে দিছি। তাদের একটু ভালো জানতাম।



অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপির সাক্ষাতকার নিচ্ছেন বিবার্তার প্রতিবেদক সোহেল আহমেদ


১৯৭৫ এর ১৭ আগস্ট আমারে অ্যারেস্ট করলো। তার আগে আমি ঢাকায় কামারুজ্জামান ভাইয়ের বাসায় গেলাম। উনাকে পাইলাম না। তো ভাবি বললেন, উনি ৭ নম্বর ধানমন্ডি লেকের ধারে গেছেন। পাবনার আব্দুর রহমান বগা মিয়া, সেক্রেটারি ছিলেন। উনার জামাই ছিলেন মেজর। উনাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন হেনা ভাই। উনারে সেফ করার জন্য ওখানে নিয়ে গেছেন। আমি হেঁটে হেঁটে ওখানে গেলাম। গিয়ে দেখি ওখানে তিনজন আর্মি অফিসার। খালেদ মোশারফ, কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ। এরা গিয়ে বলছেন, স্যার আপনার যেসব লোকজন ঢাকায় আছে, তাদের স্ব স্ব এলাকায় যাইতে বলেন। আমরা খুব দ্রুত একটা বিদ্রোহ করবো। আমাকে বললেন, তুই রাজশাহী চলে যা। তো পরদিন প্লেনের টিকেট কেটে আমি রাজশাহী চলে যাই। এয়ারপোর্টে ১০০-১৫০ আর্মি পাহারায় ছিলো। দায়িত্বরত যিনি বিডিআরের চিফ ছিলেন, তিনি বললেন, আপনার তো সাহস কম না। সবাই রাজশাহী ছেড়ে পালাচ্ছে আর আপনি রাজশাহী আসছেন। কারণটা কী? বিমানের কিছু মাইক্রোবাস ছিলো। ড্রাইভার সব ছিলো আওয়ামী লীগপন্থী শ্রমিক। যাত্রীরা আমার পরিচিত। গাড়িতে ওঠার পর ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম। ড্রাইভার বললো, এই পরিস্থিতিতে আপনি কেন আসলেন। আমি বললাম, কোনো অসুবিধা নাই। বাড়ি পৌঁছাইয়া দাও।


বাড়ি ফেরার পর শাশ্বড়ি বললেন, ১৯৭১ সালে সারাদেশে অভিযান শুরু হইছে ২৫ তারিখ থেকে। আর এখানে তোমার কারণে শুরু হইছে ১ তারিখ থেকে। আমি বললাম, এমনি আসছি। খাওয়া-দাওয়া করে পুলিশ লাইনে গেলাম, রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে গেলাম। তারপর কর্নেল নওয়াজিশ ছিলেন, আব্দুর রশিদ বিডিআর চিফ ছিলেন, আলাপ করলাম। তখন ডিসি ছিলেন শফিউর রহমান। সেখানে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো ১৮ তারিখ চাপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রিপোর্ট জানাবো। তখনকার ডিসি অফিসের সিএ আব্দুর রহীম। যদিও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। তিনি এই নিউজটা এসপি আবু তালেবের কাছে আউট করে দিলেন। তিনি খন্দকার মুশতাককে বলেছেন। সাথেই সাথেই অর্ডার দিয়ে দিলেন অ্যারেস্ট হিম।


পরে আমারে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আরো নেতাদের নিয়ে আসছে। তাদের সবাইকে ছেড়ে দিছে। শুধু আমাকে রেখে দিছে। ১৮ তারিখ সকালে এসপি আবু তালেবের কাছে বসা। হঠাৎ করে বলে উঠলেন, কই আপনাদের জাতির পিতা কই। জাতির পিতা কই? আমি দাঁড়াইয়া গেছি। বলি, আপনি এসপি হইছেন কার দয়ায়? উনি বলেন, ওকথা ভুলে যান। এ কথা কখনোই ভুলব না। যখনই এই কথা বলছি তালেব বলেন, এই এরে হাজতখানায় ঢুকা, এরে বাইরে বসায় রাখছ ক্যান? ওই অবস্থাতেই খপ করে এসপির কলারে ধরছি। বলেছি, সাহস তো কম না। সাহসের জন্য দেশ স্বাধীন হইছে। আপনি একটা কলাবেরটর লোক এসপি হইছেন। বঙ্গবন্ধুরে মারছেন। এঘটনার পর আমাকে থার্ড ডিগ্রি দেয়ার নির্দেশ দিলো তালেব।


এ ঘটনা আর্মি জেনে গেছে। এসপিরে এসে বলতেছে, ইউ বাস্টার্ড, কলাবেরটর, পাকিস্তানি। আর্মিরা ক্ষমতা নিছে। আর্মিদের ব্যাপার আপনাদের কি? একজন মুক্তিযোদ্ধা মানুষ, কুদ্দুসকে আপনি জানেন না। আজকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে বাপ বাপ করতেন। এরে এখানে রাখা যাবে না। তখন আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়া যাওয়া হলো। ওখানে নিয়ে অফিসার্স মেসে রাখা হলো। পরে সেন্ট্রাল জেলে পাঠায়ে দিলো। ডিআইজি, জেলার ছিলো। উনাদের বললেন, এখানে রাজবন্দী হিসেবে রেখে গেলাম। উনার যেন কোনো অসম্মান না হয়। এরপরে কোনো নির্যাতন হয় নাই।


নভেম্বর মাসের ৯ তারিখে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হলো। আমার কাছে অস্ত্র চাইলো। আমি বলি অস্ত্র কোথায় পাবো? অস্ত্র তো কয়েকবার জমা দিছি। আমি কি কারখানার মালিক নাকি। এই কথা শুনে খালি মারে। একটা বীভৎস রুমে আমাকে পা উপর দিয়ে ঝুলাইলো। গরম পানি, শুকনা মরিচের গুড়া দিয়ে নাকের মধ্যে ঢুকাইছে। ২ মিনিট ছিলো। গোটা দিন যন্ত্রণায় গেছে। ওখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার ছিলেন। উনি বললেন, মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস জীবন। তার কাছ থেকে যদি কিছু থাকতো তাইলে বলে দিতো। তখন কি মনে করে আর মারে নাই।


আবার রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ওখানে গিয়ে শুনি আমি ৯ জন রাজাকার হত্যার একক আসামি। প্রটেকশনে রাজশাহী নিয়ে ট্রাইবুনালে হাজির করলো। ওখানে একজন কর্নেল, একজন মেজর আর দেলোয়ার সাহেব ছিলেন। তিন সদস্য। অভিযোগ পড়ে শোনালেন। অভিযোগ শুনে আমি বলি, এগুলো সব মিথ্যা বানোয়াট। একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি রাজাকারদের মেরে থাকে তো সঠিক কাজই করেছে।


পরে আমাকে আবার রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ওখানে বঙ্গবন্ধুকে গালাগালি করায় সুবেদার হাবিবুর রহমানকে মারলাম। এরপর সেখান থেকে সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা তারপার বগুড়া, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ ঘুরিয়ে রাজশাহী জেলে নিয়ে আসলো। এরপর বিচার শুরু হলো। যে দিন রায় হবে সেদিন সবাই স্বাক্ষী দিলো। আমি হত্যা করেছি। কর্নেল বললো, আপনার কোনো বক্তব্য আছে। তখন মার্শাল ল’ কোটে একটা নিয়ম ছিলো যিনি বিবাদী তার উকিল থাকবে না। আমি বললাম, আমার খুব ঘৃণা লাগতেছে আপনারা বিচার করতেছেন। বাদি রাজাকার। আপনারা ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা। চেয়ারম্যান, মেজর, দেলোয়ার সাহেব। আর দেলোয়ার সাহেব, উনার তো ভোলা বাড়ি। আমার নেতা চাকরি দিয়েছে। দেলোয়ার সাহেব সঠিক কি-না বলেন তো। হ্যাঁ, তোফায়েল সাহেব ব্যবস্থা করে দিছে।


তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার বিচার করতেছে। মামলার বাদি, সাক্ষী সব রাজাকার। তো আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হইতাম যদি একটা রাজাকারকে মারতে পারতাম। আমি তো নেতৃত্ব করছি। মার্ডার করি নাই। করলে তো ব্যর্থ হইতাম না। আমার অধীনে ৭-৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। সকাল ১১টা থেকে আমার মা, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি বারান্দায়। বিকাল ৩টার দিকে আবার বসলো।


মেজর আর দেলোয়ার সাহেব বললো, আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধার বিচার করার জন্য বসেছি। অথচ তিনি পদক পাওয়ার কথা। আজকে রাজাকারদের কথায় আমরা তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাই রাখছি। এরপর আমাকে খালাস দিয়ে দিয়ে দেয়া হলো।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে রাজশাহীতে আপনি প্রথম পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেন। সেই ঘটনাটি জানতে চাই।


মো. আব্দুল কুদ্দুস: ১৯৭১ সালের ১ মার্চ। আমরা রাজশাহীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিশাল মিছিলের আয়োজন করি। রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবনের ছাদে উঠি আমি, খুরশিদ ও সাব্বির রহমান মতিন। আমরা ৩ জন ছাদের ওপর উঠে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। এরপরে ফায়ার ব্রিগেড, জেলখানা, রেল স্টেশনে, বাংলাদেশ ব্যাংকে, কমিশনার অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানের পতাকা পুড়াইছি। ঢাকায় কিন্তু ২ তারিখে পুড়ানো হইছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হয়তো পুড়াইছে, তবে বিভাগীয় শহরে হিসেবে আমরাই প্রথম পুড়াইছি।


বিবার্তা: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোন বিষয়টি আপনাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ?


মো. আব্দুল কুদ্দুস: পাকিস্তানের ওইখানে এক ভূখণ্ড আর এইখানে আরেক ভূখণ্ড। মাঝখানে ভারত। ভারত আবার একটা স্বাধীন দেশ। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন উদাহরণ নাই। পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের ভাষার কোনো সম্পর্ক নাই। খাওয়া-দাওয়ার কোনো সম্পর্ক নাই। আমাদের পোশাক-আশাক, কালচারের সাথেও কোনো সম্পর্ক নাই। একটা মাত্র সম্পর্ক হচ্ছে আমরা সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান। তো এরকম তো বিশ্বে ৫৪টি দেশ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে তো আরব ভূখন্ড। একই ভূখন্ড তো। ভাষা আরবি, আরবীয় কালচার, সব কিন্তু মুসলমান। তাও দেখেন সৌদি আরব, ইরান ইরাক, আমিরাত, কাতার, কুয়েত ইত্যাদি সবাই কিন্তু একেকটা রাষ্ট্র। আর আমরা পূর্বে মুসলমান, পশ্চিমে মুসলমান আর তার মাঝখানে ভারত। দুইটা মিলাইয়া একটা দেশ। ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট ভাগ হওয়ার চার মাসের মাথায় ৪ জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের জন্ম। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম। যারা পাকিস্তান মুভমেন্ট করেছিলো তারা বুঝতে পেরেছিলো যে এসব ভুয়া। মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে এসব করা হয়েছে। তাই নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের চলতে হবে। প্রতিষ্ঠার মুহূর্তে মুসলিম শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে লড়াই, সংগ্রাম শুরু হলো।



অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি


ছাত্রলীগ সবসময় শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া প্রতিষ্ঠায় কাজ করতো। এই ছাত্রলীগের রাজনীতে করেই বড় হয়েছি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমার নেতা। তিনি ছিলেন অদম্য, দুর্বার ও বিদ্রোহের অগ্নিশিখা। তার বজ্রকণ্ঠের ভাষণ ইতিহাসের বড় দলিল। দীর্ঘ শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরু‌দ্ধে তার আহ্বানে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মু‌ক্তিযু‌দ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।


বিবার্তা/সোহেল/গমেজ/আরকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com