
প্রতিবছরই তৈরী হয় সুদৃশ্য অবকাঠামো। বাহারি আলোক ঝলকানিতে রঙিন হয় শত শত স্টল এবং প্যাভিলিয়ন। ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষের পদচারণায় মুখর হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা প্রাঙ্গণ। কিন্তু মেলা শেষে ভেঙ্গে ফেলা হয় সব কিছু, সাঙ্গ হয় সব আয়োজন।
প্রতিবছরই বাণিজ্য মেলার এমন চোখ ধাঁধানো আয়োজনে রাষ্ট্রের ব্যয় কতো? আর ব্যয়ের বিপরীতে আয়ের অংকটাই বা কেমন? কতোটা রফতানি আদেশ আসে এবং কতোটা বাড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য? আন্তর্জাতিক নাম দেয়া হলেও এই মেলার প্রকৃত চরিত্র কি বলা যায়- ‘সোর্সিং’ নাকি ‘কনজ্যুমার’ ফেয়ার?
কবে শুরু হবে ২৪তম বাণিজ্য মেলা?
কোনো ব্যতিক্রম না হলে, প্রতিবছরই জানুয়ারির প্রথম দিনই শুরু হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। উদ্বোধন করেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এবার ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে মেলা শুরুর দিনক্ষণ।
ইপিবি সচিব জানান, বোর্ড সভায় ২৪তম বাণিজ্য মেলার প্রাথমিক দিন নির্ধারণ হয়েছে ৯ জানুয়ারি। তবে, নির্বাচন এবং নতুন সরকারের দায়িত্ব বুঝে নেয়াসহ আনুসাঙ্গিক কাজ শেষ হবার পরই চূড়ান্ত দিনক্ষণ নির্ধারণ হবে। মেলা যেদিনই শুরু হোক, ব্যপ্তি হবে এক মাস। দুর্যোগ এবং বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাড়তে পারে মেলার সময়।
অবকাঠামো ব্যয় কতো?
রাজধানীর শেরে বাংলানগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশেই প্রতিবছরই আয়োজন হয় ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা’। জানুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় মেলার কার্যক্রম। তবে, মেলার বিশাল আয়োজনে দুই মাস আগ থেকেই মাঠ প্রস্তুতের কাজ শুরু করে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, ইপিবি। বছরের বেশিরভাগ সময় মেলার আয়োজনকে ঘিরেই ব্যস্ত থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এই প্রতিষ্ঠান। স্থায়ী মেলা প্রঙ্গণ না থাকায় প্রতিবছর অবকাঠামো তৈরী হয়; মেলা শেষে ভেঙ্গে ফেলা হয় সব কিছু। কিন্তু মেলার ব্যয় কতো?
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো’র সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান জানান, এ বছর অবকাঠামো তৈরী করতে ব্যয় হবে ২৪ কোটি টাকার বেশি। গেল বছরে যা ২৩ কোটি টাকায় সম্ভব হয়েছিল। মূলত তিনটি খাতে ব্যয় হয় বেশি অর্থ। এগুলো হলো, আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যয়, পিডব্লিউডি এবং বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ। মেলায় থাকা সব স্টল তৈরী করে দেয় ইপিবি। প্যাভিলিয়ন এবং ডিজাইন তৈরীর ক্ষেত্রে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানই ব্যয় নির্বাহ করে। কিন্তু প্যাভিলিয়ন তৈরীর ক্ষেত্রে জায়গা সমতল করে দেবার কাজটি করে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো।
ইপিবি সচিব জানান, প্রতিবছরই মেলার অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে। তবে, ব্যয়ের তুলনায় আয় বেশি। স্থায়ী মেলা প্রাঙ্গণ তৈরী না হওয়া পর্যন্ত ব্যয় সংকোচন সম্ভব নয়।
নির্মাণ অগ্রগতি কতোটুকু?
জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে মেলা শুরু হলে নির্মাণ কাজে যে গতি আসতো, এখন তা নেই। তবে, মেলা প্রাঙ্গণে বরাদ্দ পাওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের অবকাঠামো নিমার্ণ কাজ শুরু করেছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান স্টিলের কাঠামো তৈরী করলেও আছে ভিন্নতা। কাঠ দিয়েও নির্মাণ হচ্ছে দৃষ্টি নন্দন অবকাঠামো। ইটের ব্যবহার করেও নির্মাণ করছেন কেউ কেউ। শেরে বাংলা নগরে বিশাল এলাকা জুড়ে এখন বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবে, এখনও নির্মাণ হয়নি ইপিবি’র অফিস, পার্কসহ কয়েকটি সরকারি স্থাপনা। ইট ব্যবহার করে প্রধান ফটক দিয়ে চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে। তবে, প্রধান ফটক তৈরীর জন্য অবকাঠামো নির্মাণ এখনও শুরু হয়নি। বিদেশি প্রতিষ্ঠান এখনও প্যাভিলিয়ন নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারেনি। ওয়ালটন, হাতিল, আরএফএলসহ স্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ শুরু করেছে।
কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানায়, প্রাথমিক ভাবে ১০ জানুয়ারি মেলা শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ওই দিনের আগেই সব নির্মাণ কাজ শেষ হবে। মেলা প্রাঙ্গণের মধ্যে হাঁটাচলার রাস্তা এখনও ঠিক হয়নি। এখনও মাটি সমান করে ইট বেছানোর কাজ শুরু করেনি পিডব্লিউডি। তবে, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। যেখান থেকে সার্বিক দিক তদারকি করবে আইন শৃংখলা বাহিনী।
বরাদ্দ পাচ্ছে কতো স্টল-প্যাভিলিয়ন?
সব মিলিয়ে ৫২৪টি স্টল এবং প্যাভিলিয়ন বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইপিবি। তার মধ্যে থাকবে ১৮টি জেনারেল প্যাভিলিয়ন, রিজার্ভ প্যাভিলিয়ন ৯টি, মিনি প্যাভিলিয়নের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬১টি। ফরেন প্যাভিলিয়ন ২৬টি; কিন্তু আবেদন বাড়লে সংখ্যা বাড়ানো হবে। জেনারেল মিনি প্যাভিলিয়ন হবে ২৯টি, রিজার্ভ মিনি প্যাভিলিয়ন হবে ২৯টি, রিজার্ভ মিনি প্যাভিলিয়ন সংখ্যা দাঁড়াবে ৬টি। এছাড়া প্রিমিয়ার মিনি প্যাভেলিয়ন হবে ৩৮টি, ফরেন মিনি প্যাভিলিয়ন হবে ৯টি।
প্রিমিয়াম স্টলের সংখ্যা হবে ৬৯টি, ফরেন প্রিমিয়াম স্টল ১৩টি, জেনারেল স্টল দেয়া হবে ২১টি এবং ফরেন স্টলের সংখ্যা হবে ২২টি। এবারের মেলায় ২০টি দেশের প্রায় ৪০টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নেবার আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানিয়েছে ইপিবি। প্রতিষ্ঠানটির সচিব জানান, দূতাবাসের মাধ্যমে জি টু জি ভিত্তিতে আবেদন আসছে, এগুলো বরাদ্দ দেবার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের চেম্বার অব কমার্স এবং ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও স্টল ও প্যাভিলিয়ন স্থাপনের আগ্রহ দেখানো হচ্ছে।
এটি ‘সোর্সিং’ নাকি, ‘কনজ্যুমার’ ফেয়ার!
নাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হলেও ধরণ ভিন্ন। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা সোর্সিং ফেয়ার নয়, এটি কনজ্যুমার ফেয়ার বলে স্পষ্ট করলেন ইপিবি সচিব। বললেন, মেলার দুই ধরণের চরিত্র থাকে। একটি সোর্সিং অন্যটি কনজ্যুমার। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রে মূলত সোর্সিং মেলা হয়। কিন্তু উপমহাদেশের ভারতসহ এসব দেশগুলোতে যে মেলাগুলো হয় তার বেশিরভাগেরই চরিত্র কনজ্যুমার ফেয়ার। সেই বিবেচনায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা কোনো রফতানি মেলা নয়। এটি কনজ্যুমার ফেয়ার। এক মাসব্যাপী মেলায় ক্রেতা-বিক্রতারা আসেন, পণ্যের প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়। তবে, লুকায়িত উদ্দেশ্য রফতানি আদেশ আসা হলেও মূল উদ্দেশ্য সখ্য তৈরী করা। এই মেলায় তরুণ উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য নিয়ে আসেন, আবার বিদেশিরাও তাদের পণ্য তুলে ধরেন। এতে পণ্যের গুনগত মান এবং দামের প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
কতোটা বাড়ছে রফতানি আদেশ?
মেলার মূল উদ্দেশ্য রফতানি আদেশ বাড়ানো না হলেও প্রতিবছরই বিশ্ব বাজারে বাড়ছে দেশি পণ্যের চাহিদা। ইপিবি’র তথ্য বলছে, ২৩তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা মোট রফতানি আদেশ আসে ১৬৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। তবে, এর আগের বছর অর্থ্যাৎ ২২তম মেলায় রফতানি আদেশ আসে ২৪৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে ২১তম বাণিজ্য মেলায় রফতানি আদেশ এসেছিল ২৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার। তবে, ২০১৪ এবং ২০১৫ সনে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে কমে যায় রফতানি আদেশ। ২০১৫-তে মাত্র ৯৫ কোটি ৮০ লাখ এবং ২০১৪ সালে আসে ৮০ কোটি টাকার রফতানি আদেশ। ইপিবি সচিব জানান, ২৪তম বাণিজ্য মেলায় রফতানি আদেশ বাড়বে। তবে, রফতানি আদেশ আসা চলমান প্রক্রিয়া। মেলা শুরুর সময় স্পট অর্ডার পাওয়া যায়, এছাড়া মেলা শেষ হয়ে যাবার পরও আদেশ আসে। কিন্তু সেই তথ্যগুলো হিসেবে আসে না। কারণ ব্যবসায়ীরা সেই তথ্য ইপিবিকে দেয় না।
স্থায়ী মেলা প্রাঙ্গণ নির্মাণ অগ্রগতি কতোটুকু?
শুরু হয়েছে স্থায়ী বাণিজ্য মেলা প্রাঙ্গণ তৈরীর কাজ। রাজধানীর পূর্বাচলে নির্মিতব্য নতুন মেলা প্রাঙ্গণের নির্মাণে জোর দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২০০৯ সালে মেলা প্রাঙ্গণ তৈরীর উদ্যোগ নেয়া হলেও সেই কাজ এখনও শেষ হয়নি। তখন ব্যয় প্রাক্কলন হয় ২৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু সেই ব্যয় প্রায় পাঁচগুণ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। নতুন মেলা প্রাঙ্গণে থাকবে প্রতিটি নয় বর্গমিটার আয়তন বিশিষ্ট ৮০৬টি বুথ। দুটিবড় হল রুম নির্মাণ, এক হাজার ৫০০ কার পার্কিং ব্যবস্থা এবং সম্মেলন কক্ষ, প্রেস সেন্টার, সভাকক্ষ, বাণিজ্য তথ্য কেন্দ্র, অভ্যন্তনা কেন্দ্র, সার্ভিস রুম, সাব স্টেশন নির্মাণ। ইপিবি’র সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্মাণ কাজ শেষ হবার কথা। তারপরই ২০২০ সালে সেখানে মেলার আয়োজন সম্ভব নয়। তাই নতুন স্থানে মেলা শুরু হবে ২০২১ সালে।
বিবার্তা/মৌসুমী/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]